মাসকাওয়াথ আহসান
সরকারকে তেলাঞ্জলি দিয়ে ঢাকায় একটি প্লট পাওয়া বাঙ্গালির জীবনের লক্ষ্য। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, সাম্য এসব সুন্দর সুন্দর অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়ানো শুরু হয়। সেইখানে একটি বাড়ি দখল ও একটি প্লট পাওয়া ছিলো চালাক-চতুর লোকেদের একমাত্র লক্ষ্য।
যেসব লোক স্বাধীনতার আগে জনমানুষকে অমুক-তমুক অধিকার এনে দেবার গরম ভাষণ দিতো; তারা স্বাধীনতা পাবার পরেই নতুন বুর্জোয়া হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভুলে যায় সমস্ত অঙ্গীকারের কথা। এরপর যে যখন সরকারে থেকেছে; নিজের বাবার সম্পত্তির মতো ঢাকা শহরের প্লট উপহার দিয়েছে তার চাটার দলকে।
অভিনেতা আরেফিন শুভ একটিমাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পেলেও যেহেতু মুজিব বায়োপিকে মুজিব চরিত্রে অভিনয় করেছেন; তাই শিল্পী হিসেবে দশকাঠার একটি প্লট পেয়েছেন। তিনি তারকা বলেই তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাটা বেশি। কারণ তিনি যখন মাত্র এক টাকা সম্মানীর বিনিময়ে মুজিব বায়োপিকে অভিনয় করেছিলেন, তখন তার এই মহত্ব আমাদের পুলকিত করেছিলো। আবার ছবি মুক্তি পাবার কয়েক মাসের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্লট প্রাপ্তি; তার পার্থিব চাওয়া স্পষ্ট করেছে।
এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি। এই দেশকে কেউ কখনো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, জাতির জনকের প্রতি ভালোবাসা সবকিছুর মূল্য চুকাতে হয় দেশকে। সেটা প্লটে-পদকে-পদবীতে।
বঙ্গবন্ধু-জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনার শাসনামলে ঢাকা শহরের প্লট পেয়েছেন যারা; তাদের তালিকাটি উন্মুক্ত করা হলে দেখবেন; যারা এতোদিন বাংলাদেশের প্রতি অপত্য ভালোবাসা আর অশ্রুজলে আপনাদের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; তারা আসলে একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেননি; তারা যুদ্ধ করেছেন কেবল একটি প্লট পাবার জন্য।
সারাদেশের উন্মূল উদ্বাস্তু লোকেরাই ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় আসে; আসে নদী ভাঙ্গনের মানুষ। এই মানুষেরা তাদের পিঁপড়া বিদ্যা দিয়ে সরকারি প্লট পান, সরবরাহের ব্যবসা পান, ব্যাংক ঋণ পান, পদবী পান, পদক পান। দেশের প্রতি ন্যুনতম ভালোবাসা এসব লোকের নেই বলেই বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ বাংলাদেশ আমলে পাচার হয়েছে দেশের বাইরে।
অনেকে আক্ষেপ করেন বাংলাদেশে রাজনীতি সচেতন নির্দলীয় নাগরিক সমাজ এতো দুর্বল কেন! এর উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের প্রত্ন জিজ্ঞাসার কাছে।
বৃটিশ আমলে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে বৃটিশ চাটার দলকে জমিদারির বন্দোবস্ত দেয়া হয়। সম্পন্ন কৃষক শ্রেণীকে রাতারাতি জমিদারের প্রজাতে পরিণত করা হয়। সেসব জমিদার প্রজা নিষ্পেষণ করে সেকেন্ড হোম বানান কলকাতায় গিয়ে। পূর্ববঙ্গে সম্পন্ন কারিগর শ্রেণীর বিনাশে বৃটিশের মধ্যস্বত্বভোগীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এইভাবে পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে ফেলা হয়। এই দারিদ্র্য মনের দারিদ্র্যে অনুদিত হলে; পরিশ্রম নয় সরকারকে তেলাঞ্জলি দেয়াই সৌভাগ্যের প্রসূতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৃটিশ চলে গিয়ে পাকিস্তান উপনিবেশ এলে; তখন নতুন একটি বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি হয় সরকারের চাটার দলের মাঝ থেকে। ঢাকা শহরের প্লট বরাদ্দ ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় খাসজমি বরাদ্দ দেয়া শুরু হয়। পূর্ববঙ্গের সম্পদ লুট করে পাচার করা হয় পাকিস্তানে।
মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের মাঝ দিয়ে এই চাটার দল বুর্জোয়া তৈরির রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখা হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে এই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় আর নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পূরণ না হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারা অনেকটা বুঝে ফেলেছে; চোরের খনিতে চাটার দলই জিতে গেছে; এইখানে জনমানুষের পক্ষে রাষ্ট্রিক পরিবর্তন আর আসবে না।
সে কারণেই আরেফিন শুভ’র আওয়ামী লীগ সরকারের পুরস্কার হিসেবে প্লট পাবার ইস্যুটিতে ঠিকই অসাড় দুটো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একদল এর সমালোচনা করে; আরেকদল এর প্রশংসা করে। কেউই জানতে চায়না; এইদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে যে কৃষক শ্রমিক; সে তার সারাজীবনের শ্রমের পুরস্কার হিসেবে ঢাকা শহরে কোন প্লট পায় কীনা! স্বাধীন সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রে এরকম প্লট তো লটারির মাধ্যমে যে কেউ পাবার কথা। কেন বেছে বেছে অনুপাদনশীল লোকজন; রাজনৈতিক নেতা, আমলা, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষক এই প্লটগুলো পান সরকারকে তেলাঞ্জলি দিয়ে।
সারাজীবন কৃষক ও শ্রমিক দেশের অর্থনীতির জন্য যে শ্রম দেন, এর মূল্যায়ন তাহলে কে করবে! একটি বায়োপিকে অভিনয়, কয়েকটি টকশোতে সরকারের প্রতি তৈলমর্দন, সরকারের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর, কিংবা সরকারকে যেন তেন প্রকারেণ নির্বাচনে জিতিয়ে আনার অন্যায় কাজ করে “প্লট পুরস্কার” পাবে স্বাধীনদেশের অন্যায় সুবিধাভোগী কিছু লোক।
এই যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে না জাগা; আর শিক্ষিতের সার্টিফিকেট নিয়েও “শুভ যোগ্যতার ভিত্তিতে প্লট পেয়েছে; তাকে হিংসা কেন!” জাতীয় ফাঁপা প্রশ্ন উত্থাপন; এ হচ্ছে প্রজামানসের খোয়ারি; দলান্ধতার শীতকার!
শুভ তারকা বলে তাকে নিয়ে এতো আলোচনা; অতারকা বিভিন্ন সরকারের “চাটার দলে”র প্লট পাওয়ার ব্যাপারগুলো রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিছুকাল আগে তবু গত পনেরো বছর ধরে সরকারের পক্ষে মিডিয়ায় লিপসার্ভিস দেয়া সাংবাদিকদের প্লট প্রাপ্তি নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছিলো।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে; যে লোক একখণ্ড প্লটই নেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে; তারমুখে দেশপ্রেমের ফুলঝুরিকে আমি আর এক পয়সার দাম দেবো কেন!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।