মাসকাওয়াথ আহসান
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট; এই দুটি চিন্তার মাঝে অনেক মিল রয়েছে।
জায়নিস্ট মুভমেন্ট গড়ে ওঠে ইহুদিদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য। আওয়ামিস্ট মুভমেন্ট গড়ে উঠেছিলো বাঙ্গালির একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি একটি গণহত্যার মাঝ দিয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালি একটি গণহত্যার মাঝ দিয়ে যায়। ফলে উভয়েই গোটা বিশ্বের মানুষের সহানুভূতি লাভ করে।
কিন্তু ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড দখল শুরু করে জায়নিস্টরা। আবার ১৯৭২ সাল থেকেই অবাঙ্গালি ও হিন্দুদের বাড়ি ও জমি দখল করতে শুরু করে আওয়ামিস্টরা।
নিজেদের ওপর ঘটে যাওয়া গণহত্যার ভিকটিম কার্ড প্লে করে করে; প্রতিপক্ষের ওপর ক্রম গণহত্যা চালাতে শুরু করে জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট। প্রতিপক্ষের হামলায় এদেরও ক্ষয়ক্ষতি চলতে থাকে। কারণ এদের মাথায় যে আধিপত্যবাদের ভুত; তা তাদের এক মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেয়না।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের উভয়ের একটি অসাম্প্রদায়িক মুখোশ রয়েছে। যে কারণে লেখক-শিল্পী-কবিরা এদের ছায়াতলে ঘন হতে পেরেছে। অসাম্প্রদায়িকতার লিপ সার্ভিস দিতে তাই জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের রয়েছে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক জোট। জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট এর পরিবর্তে সাংবাদিক, সচিব ও শিল্প-সাহিত্যের লোকেদের প্লট উপহার দেয় আর পদক-পদবী পুরস্কার দেয়।
জায়নিস্টের রয়েছে শক্তিশালী মিডিয়া। আওয়ামিস্টের রয়েছে শক্তিশালী মিডিয়া। ফলে তাদের অন্যায়ের পক্ষে প্রচারণা আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর পেশাগত দক্ষতা রয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংক মালিক হিসেবে জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের রয়েছে অনুগত ঋষি-দরবেশ-মোল্লা-রাবাই-পুরোহিত। এরা নিয়ন্ত্রণ করে অন্ধকার ক্ষমতাজগত।
খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারির মতো বুদ্ধিজীবী রয়েছেন জায়নিস্টদের পক্ষে ইতিহাসের বয়ান বা ন্যারেটিভ প্রস্তুতের জন্য। খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন একই ভূমিকা পালন করে চলেছেন আওয়ামিস্টের পক্ষে।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের মাঝে রয়েছে ম্যাগালোম্যানিয়া বা শ্রেষ্ঠত্বের বোধ। ফলে ভিন্নমত পোষণকারীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তারা কল্পনাও করতে পারেনা। নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ, গোয়েন্দা কার্যক্রম, আড়িপাতা, গুম করে দেয়া, আয়নাঘরে নির্যাতন করা; এইভাবে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে সমালোচনা ও ভিন্নমতকে দমন করা জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের কল্পিত পুলিশি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য।
স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট মুভমেন্টকে সমর্থন করেছিলো অথচ যুক্তিবোধসম্পন্ন অহিংস ও মানবিক মানুষ যারা; তারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ মুখ ফুটে জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের সমালোচনা করেন।
প্যালেস্টাইনে আমরা যেমন জায়নিস্ট এলিট ফোর্সের ক্রসফায়ার দেখতে পাই; একই রকম এনকাউন্টার দেখতে পাই আওয়ামিস্ট এলিট ফোর্সের। জায়নিস্ট খুনিদের হাতে নিহত পিতার সন্তানদের আমরা যেমন অশ্রুসিক্ত চোখে পিতার জন্য অপেক্ষা দেখতে পাই; আওয়ামিস্ট খুনিদের হাতে নিহত পিতার সন্তানদেরও আমরা তেমনি অশ্রুসিক্ত চোখে বলতে শুনি, আব্বু তুমি কী কান্না করতেছো।
জায়নিস্টরা আপাত দৃষ্টিতে নিজেদের সেকুলার ও সুরুচির লোক হিসেবে উপস্থাপন করলেও প্রতিপক্ষের নেতাদের চরিত্র হনন করে নানা রকম গুজব প্রতিষ্ঠা করে। ইয়াসির আরফাতের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে জায়নিস্টদের নানা কুকথা বলতে শোনা যায়। আওয়ামিস্ট তাদের প্রতিপক্ষের নেতা খালেদা জিয়ার চরিত্র হনন করার জন্য সংবাদ সম্মেলন বসিয়ে নানা কুকথা বলে।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট এদের অস্ত্র ও পেশী শক্তির চেয়ে বড় শক্তি মুখে মুখে গুজব ছড়িয়ে মিথ্যাকে পরম সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার অভিলাষ। জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট মানেই কুঁচ কুঁচ করে মনগড়া ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার উকুন তোলার আসর। কলতলা ও পাতকূয়াতলার রগড়।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট উভয়েই অনুতাপহীন। সক্রেটিস বলেছেন, একজন অপরাধী যখন অপরাধ করে; সে ওটিকে অপরাধ ভাবে না। ভাবে ঠিক কাজটিই করছে। জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টের ক্ষেত্রে সক্রেটিসের ঐ পর্যবেক্ষণ নির্ভূলভাবে প্রমাণিত।
জায়নিস্টরা তাদের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য এমেরিকার ক্ষমতা কাঠামোর সমর্থন লাভ করেছে শুরু থেকেই। আওয়ামিস্ট তাদের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য শুরু থেকেই ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর সমর্থন লাভ করেছে।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট উভয়েই “তালগাছ আমার” মতবাদে বিশ্বাসী। ফলে কোনরকম শান্তি ও সংলাপ প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে চলে।
জায়নিস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিকটিম কার্ড প্লে করতে নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দর্শকের অশ্রুপাত ঘটায়। আওয়ামিস্ট একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বলে, কাঁদো বাঙালি কাঁদো”।
অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষেরা বেশিরভাগই বর্তমানের জায়নিস্ট ফ্যাসিজমের বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো বেশিরভাগ মানুষ আওয়ামিস্ট ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে। কাজেই ভিকটিম কার্ডের সুফল কুড়িয়ে চলেছে যুদ্ধে স্বজন না হারানো, শরণার্থী না হওয়া “বসন্তের কোকিল” ও ” কাঁকন দাসী” মহল। এরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে দোকানদারি করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। আর খুনি হিসেবে ছাড়িয়ে গেছে ১৯৪১-৪৫ সালের খুনে নাতসি ও ১৯৭১-এর খুনে পাকিস্তানি সেনাদের। গুজব প্রচারে হার মানিয়েছে গোয়েবলস ও রেডিও পাকিস্তানকে।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টদের অন্যদেশে সেকেন্ড হোম ও একাধিক দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে রাখতে দেখা যায়। নিজেদের পরিবারকে নিরাপদে রাখতে এ তাদের আত্মকেন্দ্রিক মনোভঙ্গি ও প্রস্তুতি।
তাই জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্টরা কখনো এসব খুন-দখলদারি-মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত হবে; এটা দূরাশা বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ বিদ্বেষ ও বিভাজনের আত্মঘাতী নেশা রয়েছে এদের। আর রয়েছে আলোচনার টেবিলে প্রতিপক্ষকে গান্ধা কইরা দেওয়ার গওহরডাঙ্গা মেথড। এরা ফট করে অশ্লীল কথা বলতে ও গলা চড়াতে ওস্তাদ। এরা নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আজকের দিনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। সাপের বাচ্চার মতো এরা ভিন্নমতের প্রবীণ মানুষদের দংশন করে বেড়ায়।
জায়নিস্ট ও আওয়ামিস্ট প্রকৃতিগতভাবেই অভিশপ্ত। এরা খুন করে, বাড়ি ও জমি দখল করে, দেশের সম্পদ লুট করে বড়লোক হয়; বাইরে বাইরে সুখের অভিনয় করে; কিন্তু অরিজিন্যাল সিন বা আদিপাপ তাদের দুখি করে রাখে। সেভেন ডেডলি সিনস ও ষড়রিপুর তাড়নায় এরা মানববৈশিষ্ট্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছে।
জায়নিস্টেরা টাকাপয়সাকে সেকেন্ড গড বানিয়ে সোনালি বাছুরের পূজা করে অভিশপ্ত করেছিলো নিজেদের। আওয়ামিস্টেরাও টাকা-পয়সাকে দ্বিতীয় ঈশ্বর বানিয়ে সুইস ব্যাংক ও কেমেন আইল্যান্ড-ভার্জিনিয়া দ্বীপপুঞ্জের সোনালী বাছুর পূজা করে অভিশাপে জর্জরিত হয়ে উঠেছে।
কাজেই অপেক্ষাকৃত মানবিক লোকেরা যারা মনুষ্যত্ব বোধ; ও জীবনের স্বাভাবিকতাকে গুরুত্ব দেন; যাদের মাঝে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ অবশিষ্ট রয়েছে; যারা নিউটনের তৃতীয় সূত্রে নিজের ও পরিবারের ওপর প্রকৃতির আসন্ন প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে চান; তারা জায়নিজন ও আওয়ামিজম থেকে দূরে সরে গিয়ে মানুষের জীবন যাপনের শেষ চেষ্টা করছেন।
“Make a habit of two things: to help, or at least to do no harm.” – Hippocrates.
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।