লুৎফুল কবির রনি
মানুষ স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে বুড়া হয়ে গেছে বলে নয়, মানুষ বুড়া হয় স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে বলে। — গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজগাব্রিয়েল
গার্সিয়া মার্কেজ বললেই লোকে তোতাপাখির মতো ‘ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজ্ম’ উচ্চারণ করে। জাদু-বাস্তবতা মানেই যেন, উঠোনে ঝোলানো শাড়ি বেয়ে কেউ স্বর্গে উঠে যাবে! অথচ, জাদুবাস্তব অন্য জিনিস। সেখানে সময়, তথ্য, কল্পনা স্পাইরাল ভঙ্গিতে জড়াজড়ি করে থাকে। ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ উপন্যাসে পুলিশ ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। তিরিশ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। লাশগুলি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। কলম্বিয়ার সরকারি ইতিহাস বলত, কোনও শ্রমিকের মৃত্যু হয়নি। গার্সিয়া মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিরিশ হাজার কাল্পনিক সংখ্যা। যদি লেখ, আকাশে গরু উড়ে যাচ্ছে, কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু চারশো গরু উড়ে যাচ্ছে লিখলে লোকে সত্যি ভাববে।’ খুঁটিনাটি তথ্য ছাড়া জাদু হয় না।
কলম্বিয়ার লেখক কত জনের মুখেই ভাষা জোগালেন! ‘অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক’! রাষ্ট্রনায়কের প্রাসাদে গরু চরে, সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কলম্বাসের রণতরী। পাশে মার্কিন ফ্রিগেট। উপনিবেশ তৈরির ভাষা বদলায় না। বদলায় না বলেই মুক্তিযুদ্ধের ঢাকা শহরে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ দেখে, বখতিয়ার খিলজির আঠারো অশ্বারোহীর পাশে ঢুকে আসছে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক।
কিংবা নোবেলজয়ী উপন্যাসের শেষটা! বংশের শেষ জনকে পিঁপড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তখনই মেলকুয়াদিসের পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করে ফেলে আউরিলিয়ানো বাবিলোনিয়া। মেলকুয়াদেস স্প্যানিশ হরফে সংস্কৃত ভাষায় লিখে গিয়েছিল, এত দিনে পড়া গেল। উপনিবেশ মাকোন্দো গ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষাও ভুলিয়ে দেয় যে!
‘ক্রনিক্ল অব আ ডেথ ফোরটোল্ড’ উপন্যাসের সান্তিয়াগো নাসারের মৃত্যুও মনে পড়ছে। ভিকারিও যমজ ভাইরা তাকে খুন করার আগে বাজারে জানায়, সান্তিয়াগোকে খুন করতে যাচ্ছে। তাদের বোন বলেছে, সান্তিয়াগো তার ইজ্জত নিয়েছে। দাবিটি সত্য কি না, উপন্যাসের শেষেও জানা যায় না। কিন্তু বাড়ির রাঁধুনি ভিক্টোরিয়া সব জেনেও চুপ। সান্তিয়াগো মাঝে মাঝে তার মেয়ের শরীরের এখানে সেখানে হাত দেয়। মাচিসমোর এই গল্প লিখেই গার্সিয়া মার্কেস আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বুঝিয়েছিলেন, মাচিসমো শুধু মেয়েদের ওপর পুরুষের দখলদারি নয়। পুরুষের প্রতি পুরুষের অত্যাচার, নারীর প্রতি নারীর ব্যবহারেও থাকে তার চিহ্ন।
কিন্তু শুধু জাদুবাস্তব আর শতবর্ষের নির্জনতা? ‘নীল পোশাকে স্কুল যায় সেই মেয়ে/ কেউ জানে না সে হাঁটে না ওড়ে/লঘুচপল ছন্দে সে হাঁটে, হাওয়ার তালে তালে।’ এটি ১৮ বছর বয়সি গার্সিয়া মার্কেসের লেখা কবিতা থেকে। যে মেয়েকে নিয়ে লেখা, তার বয়স ১৩। এই মেয়েই মার্সেদেস, পরে কবির স্ত্রী। প্রেমে পড়ে গোপনে কবিতা লেখার পরও গার্সিয়া মার্কেসকে বাঙালি বলা যাবে না?
আর ‘সরলা এরেন্দিরা’? সে গল্পে এরেন্দিরার হাতের কাচ কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও সবুজ আলোয় ভরে যাচ্ছে। ঠাকুমা বলছেন, ‘তুই প্রেমে পড়েছিস। প্রেমে পড়লে এই রকম হয়।’ পরে লেখক বলেছিলেন, ‘ওটাই জাদুবাস্তবতা। পৃথিবীতে প্রেমে পড়ার মুহূর্ত এত বার লেখা হয়েছে যে নতুন ভাবে কথাটা বলতে হল।’ আমাদের মতো প্রতিদিন যারা নিত্য নতুন প্রেমে পড়ে, অহরহ আতস কাচের রংবদল দেখে, জীবনে ভুলতে পারবে এই লেখককে? তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডও তো শেষ করেছিলেন প্রেমে। তখনও বিয়ে হয়নি। ইউরোপ যাওয়ার আগে বোহেমিয়ান তরুণ রাত দুটোয় বিমানবন্দরের মেলবক্সে ফেলে দিলেন মার্সেদেসকে লেখা চিঠি: এক মাসের মধ্যে উত্তর না পেলে আমি আর দেশে ফিরব না। গার্সিয়া মার্কেস প্রেমে পড়তেও শিখিয়েছেন।
এর পরও মন খারাপ না হয়ে পারে?
‘শতবর্ষের নির্জনতা’ ক’টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, স্প্যানিশ ভাষায় বাইবেলের পরই বিক্রিতে তার স্থান কি না, সে প্রশ্ন নগণ্য। আসলে গার্সিয়া মার্কেজ না থাকলে তৃতীয় বিশ্বের এই সুদূরে বসে আমরাও সময়কে বুঝতে পারতাম না। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চিলেকোঠায় বসে সোনার মাছ তৈরি করে। উদারনৈতিক দলের হয়ে ৩২ বার রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছে সে। তবু পরিবর্তন আসেনি। কেন না, সেই যুদ্ধের পিছনে কোনও আদর্শ ছিল না। রক্ষণশীলরা যখন সব নীল রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছিল, কর্নেল বিরক্ত হয়ে ওঠে। নীল রং তার পছন্দ নয়। ‘উদারনৈতিক আর রক্ষণশীলদের আজকাল একটাই তফাত। প্রথম দল বিকেল পাঁচটায় গির্জায় যায়, দ্বিতীয় দল রাত আটটায়।’
বাঙালি গার্সিয়া মার্কেজ বললে ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধুও বোঝে। ক্ষমতাবানদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন। কাস্ত্রো থেকে মিতেরঁ, বিল ক্লিন্টন, তাঁর বন্ধু। কিন্তু সীমারেখা টানতে জানতেন। বলেছিলেন, “আমার মাপা আছে, ফিদেলের সঙ্গে আমি কত দূর যেতে পারি।” তাঁর ভক্ত বাঙালি মেধাজীবীরা এই দূরত্ব মাপতে শিখলে ভালই হত।
কিন্তু শুধু জাদুবাস্তব আর শতবর্ষের নির্জনতা? ‘নীল পোশাকে স্কুল যায় সেই মেয়ে/ কেউ জানে না সে হাঁটে না ওড়ে/লঘুচপল ছন্দে সে হাঁটে, হাওয়ার তালে তালে।’ এটি ১৮ বছর বয়সি গার্সিয়া মার্কেসের লেখা কবিতা থেকে। যে মেয়েকে নিয়ে লেখা, তার বয়স ১৩। এই মেয়েই মার্সেদেস, পরে কবির স্ত্রী। প্রেমে পড়ে গোপনে কবিতা লেখার পরও গার্সিয়া মার্কেসকে বাঙালি বলা যাবে না?গার্সিয়া মার্কেজ প্রেমে পড়তেও শিখিয়েছেন।
ম্যাজিকাল রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতা, সাহিত্যের এমন এক মোহনীয় ধারার সাথে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন এ সময়ের একজন শক্তিশালী লেখক। তাকে সময়ের গন্ডিতে বেঁধে ফেলা অবশ্য ভুল হলো। কেননা, মোটে চল্লিশ বছর বয়েসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শতবছরের নিঃসঙ্গতাকে। স্প্যানিশ ভাষায় তার সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়েছিলো তার জীবদ্দশাতেই, পেয়েছেন তার স্বীকৃতিও। চতুর্থ লাতিন আমেরিকান হিসেবে নোবেল পান তিনি।
তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।
এক বিশেষ সাক্ষাতকারে চিলির ঔপন্যাসিক ইসাবেল আয়েন্দে পরলোকগত লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজেরর স্মৃতিচারণ করছেন। মার্কেজ কীভাবে লাতিন আমেরিকা ও সারা বিশ্বের প্রজন্মান্তরের চিন্তাবিদ ও লেখকদের প্রভাবিত করে আসছেন, সেই আলোচনা করেছেন তিনি। ‘তিনি সেরাদের সেরা’ বলছেন আয়েন্দে। ‘এক অর্থে পাঠক ও দুনিয়াকে তিনি জয় করে নিয়েছেন এবং আমাদের কথা, লাতিন আমেরিকার কথা জানিয়েছেন বিশ্বকে। বলেছেন আমরা কারা। তার লেখা পাতাগুলোয় এক অর্থে আয়নায় আমরা নিজেদেরই দেখি।’ প্রথম ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড পাঠ এবং সেটা কীভাবে তাকে প্রভাবিত করেছিল, তা বলেছেন আয়েন্দে— ‘কেউ যেন আমাকে আমার নিজের গল্পই বলছিল।’ আয়েন্দের সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন এমি গোল্ডম্যান ও হুয়ান গনসালেস।
এই বিশ্ব বিখ্যাত কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক বিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দুই যুগ তিনি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন। এ সময় তাঁর লেখালিখি কমে আসে। জনসংযোগ ও ভ্রমণ হয়ে পড়ে সীমিত। এমনকী ২০০৪-এ আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড লিভিং টু টেল আ টেইল প্রকাশের পর পরিকল্পিত ২য় এবং ৩য় খণ্ড আর রচনা করা হয়ে ওঠেনি। তিনি দূরারোগ্য লিম্ফেঠিক ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ২০১২’র জুলই থেকে তিনি স্মৃতি বিনষ্টিতে আক্রান্ত হন।
একজন লেখক হিসেবে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি গাবো নিয়েছেলেন যখন তাঁর বয়স ২২ বছর। তাঁর মা লুইসা সান্তিয়াগার সফরের সঙ্গী হয়ে স্টিমার আর নড়বড়ে ট্রেনে চেপে গিয়েছিলেন কলম্বিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকার কেন্দ্রভাগে অবস্থিত জলাভূসি ও কদলী বাগিচায় ঘিরে থাকা গ্রাম আরাকাতাকায়। বাহ্যত উদ্দেশ্য ছিলো তাঁর মাতামহের বাড়িটা বিক্রি করা, যে বাড়িতে লেখকের জন্ম এবং আট বছর বয়সের বেশির ভাগ সময়টাই কেটেছে। ২০০২ সালে প্রকাশিত বিবির পারা কোনতারলা (জীবনের গল্প বলার জন্যই বেঁচে থাকা) নামে আত্নজীবনীর প্রথম খন্ডের শুরুতে এক জায়গায় এই সফরের উল্লেখ করে গাবো বলেন, ‘ট্রেনটা জনমানুষ্যবিহীন একটা গ্রামের স্টেশনে একটু থামে এবং খানিকক্ষণ পর পথের একটা কদলী বাগিচার সামনে দিয়ে পার হয় আর ওখানকার দরজায় লেখা : মাকোন্দো।
’গাবোর সেই সফর, শৈশবের স্মৃতি এতটাই আক্রান্ত করল তাঁকে যে সেই থেকে একটা কাল্পনিক জগতের ছবি ভর করল তাঁর ওপর, যে জগতের প্রেমে পড়লাম আমরা একে একে সবাই। আরাকাতা থেকে জন্ম নিল মাকোন্দো, আর তার মাতামহকে ঘিরে তৈরি হলো ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত মহাকাব্যিক সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ (নিঃসঙ্গতার এক শ বছর) উপন্যাসের কিংবদন্তিতুল্য চরিত্র কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। এক ক্রান্তীয় জগৎ সৃষ্টি করলেন গাবো-যেখানে উদ্ভট ও অসম্ভব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, এর রং চড়ানো অতিকথন, এর আন্দদায়ক তালগোল পাকানো হাস্যরস, ট্রাজেডি এবং সাধারণ মানুষের অতিসাধারণ জীবনের জয়গান নিয়ে উপন্যাসটি লাতিন আমেরিকার সদাবাস্তবতা মূর্ত রূপ দেয়। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ছয় প্রজন্মকে নিয়ে রচিত মাকোন্দো উপন্যাসটি যেন স্বর্গোদ্যান থেকে রহস্যেদঘাটন পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস। লাতিন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে মাকোন্দো এক অনুবিশ্ব আর বুয়েন্দিয়া পরিবারের ছয় প্রজন্মের কাহিনি একই সঙ্গে বাস্তবতার ধরন-ধারণ, বিশ্বজননী সানবজাতির নিয়তি ও সমস্যাসংকুল লাতিন আমেরিকার কথা বলে।
এই কথার জাদুকর তার নোবেল ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে নেই কোনো সীমারেখা। সমগ্র লাতিন আমেরিকার বাস্তবতা থেকেই জন্ম নিয়েছে সদবাস্তবতা। ইউরোপীয়রা আমার বই পছন্দ করেন আমার আমার রচনায় ম্যাজিক ও ফ্যান্টসি দেখতে পান বলেই। কিন্তু আমার রচনা আসলে নিত্যদিনের বাস্তবতা। সরল আর নিষ্পাপ চোখে বাস্তবতার দিখে সোজাসুজি দেখা। ম্যাজিক রিয়ালিজম মানে আমাদের বাস্তবতার ভেতরেকার অলৌকিকতা। ইউরোপীয়রা যতটা যক্তিবাদী সে অর্থে আমাদের মন-মানসিকতা ঠিক ততট যুক্তিবাদী নয়, হওয়া সম্ভবও নয়। আমরা যেভাবে আমাদের বাস্তবতাকে প্রকাশ করি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করি, যুক্তিবাদীদের পক্ষে সেটাকে ঠিক সেভাবে বোঝা বা উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। লাতিন আমেরিকানদের দেখলে মনে হবে, তারা অর্ধেক স্বপ্ন আর অর্ধেক দুর্নীতিরে ভেতর জীবন কাটায়। সদবাস্তববাদ আমাদের সহজাত স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য।
’বাস্তবিক কণ্ঠে অলৌকিকের গল্প ফেঁদে রীতিমতো বিষ্ময়কর বর্ণনারীতিতে এক নতুন গদ্যশৈলীর উপন্যাস সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ (নিঃসঙ্গতার এক শ বছর) বেরোনোর পরপরই গাবো পেয়েছিলেন খ্যতি আর সাফল্য। ১৯৬৭ সালে বেরিয়েছিল স্প্যানিশে, আর ১০৭০ সালে গ্রেগরি রাবাসার তাক লাগানো অনুবাদে বেরোল এক ইংরেজি সংস্করণ। ব্যস! সেই শুরু গাবোর বিশ্বজয়ের। অসাধারণ কয়েকজন লাতিন আমেরিকার লেখকের প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে সফলই শুধু হলেন না, উপরন্তু বলা চলে, তাঁদের গুরুও তিনি।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ‘গাবো’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। বিশেষ করে স্প্যানিশভাষীদের কাছে তিনি এই নামে সমাধিক পরিচিতি পেয়েছেন। ‘গাবো’ ছিলেন সমকালিন শক্তিমান কথা সাহিত্যিকদের অন্যতম।
সাহিত্যের ভুবনে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ছিলেন এক জাদুকরের মতই। সদা সংগ্রামী মানুষটি ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি শুধু যে নোবেল বিজয়ী বলেই যে খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন তা কিন্তু নয়। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে গার্সিয়া মার্কেজ একটি ব্যতিক্রমী নাম। গত চার দশক জুড়ে পৃথিবীব্যাপী তাঁর খ্যাতি গগনচুম্বী। নোবেলজয়ী পেরুর মারিও বার্গাস য়োসা ছাড়া এতটা নামডাক বোধ করি আর কোনও লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিত নেই এই পর্যায়ে। সমালোচক ও পাঠক উভয়েরই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান নেওয়া কলম্বীয় এই লেখকের পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব পাঠকের সংখ্যা একত্র করলে সেটা হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির সমান। ঈর্ষণীয় রকম জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মেমোরিয়া দে মিস পুতাস ত্রিস্তেস শিরোনামের উপন্যাসটি প্রথম সংস্করণ বাজারে ছাড়া হয় ১০ লাখ কপি। যার তিন লাখ কপি শুধু স্পেনের বাজারের জন্য, আর বাকিটা স্প্যানিশ আমেরিকার জন্য। বলা বাহুল্য, প্রথম সপ্তাহেই শুধু স্প্যানিশ আমেরিকাতেই বইটির বিক্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল চার লাখ। সিরিয়াস সাহিত্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বই বেস্ট সেলার তালিকায় অনায়াসে দাবড়ে বেড়ায় মাসের পর মাস। খুব কম ভাষাই আছে পৃথিবীতে, যে ভাষায় তাঁর রচনা এখনো অনুবাদ হয়নি। তাঁর এই বিশ্বজোড়া খ্যাতির পেছনে মূলত তাঁর রচনার সাবলীল ও সৌন্দর্য এবং তার ঐন্দ্রজালিক আবেশ।
তাঁর গল্প-উপন্যাসে লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের রূঢ় বাস্তবতার উপকথা, কিংবদন্তি, পুরাণ, স্মৃতিচারণ ও কুসংস্কার একই সুতায় গাঁথা। পালাক্রমে, কৌতুকপ্রদ ও ভয়াবহ কাহিনিন মিশেণে তাঁর রচনা যেন এক সমগ্র মানবগোষ্ঠির কল্পনাকে আশ্রয় করে লেখা।
এই অলৌকিকের গল্পওয়ালার গল্প ফুরিয়েছে কয়েক বছর হয়। তবে ফুরিয়ে যাবেন না তিনি। তিনি বেঁচে থাকবেন সাহিত্যরসিকদের হৃদয়ে। তার গল্পগুলো শুধু লাতিন আমেরিকাতেই নয়, সারা দুনিয়ায় ঘুরে ফিরে গাবোর কথাই বলে যাবে ভবিষ্যতের কাছেও।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” -এর মতো আর কোনো উপন্যাস প্রকাশের পরপরই এতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কিনা সন্দেহ । জনপ্রিয়তার বিচারে যেমন, তেমনি শিল্পকুশলতা আর শিল্পমুক্তির ক্ষেত্রেও এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত । কেবল স্প্যানিশ সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসেই একটি মাত্র উপন্যাসে ইতিহাস, আখ্যান, সংস্কার, কুসংস্কার, জনশ্রুতি, বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা, ফ্যান্টাসি, যৌন-অযাচার ও স্বপ্ন– সবকিছুর এমন স্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য সহাবস্থান আগে কখনও দেখা যায়নি।
ঠিক এই কারণে মারিও বার্গাস যোসা এটিকে বলেছিলেন এক সামগ্রিক উপন্যাস (Novela Total), আর পাবলো নেরুদা একে বলেছিলেন, “সের্বান্তেসের ডন কিহোতের পর স্প্যানিশ ভাষায় সম্ভবত মহত্তম উন্মোচন “perhaps the greatest revelation in the Spanish language since Don Quixote of Cervantes.”
শুভ জন্মদিন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ