মাসকাওয়াথ আহসান
মাসকাওয়াথ আহসান: সিংড়াপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেব ইদানিং জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। আর অসংখ্য কালো বেড়াল পুষেছেন। কালো বেড়ালদের কাজ হচ্ছে এলাকার শান্তি-শৃংখলার দিকে নজর রাখা। আর জাদুকর নিবিষ্টমনে সারাক্ষণ একটা বড় আয়না হাতে নিয়ে তাতে সত্যের অনুসন্ধান করেন। জাদুকরের বড্ড মায়াময় মন। কেউ কাছে গিয়ে ভক্তি নিবেদন করলে জাদুকর হাত ওপরে তুলে হাওয়া ঘূর্ণির মতো ঘুরিয়ে একটা স্বর্ণমোহর হাতে দিয়ে বলেন, যাও তোমাকে এক টুকরো সত্য উপহার দিলাম। সত্যের টুকরা নিয়ে ভক্ত সারাগ্রাম দৌড়ে বেড়ায়। আর আর্তনাদ করে, সত্যরে যদি পাইতে চাও, চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাও।
সিংড়াপুরের মানুষজন অবশ্য যে যার সত্য নিয়ে বসে আছে। ফলে সেখানে আনন্দ ও দুঃখের উপলক্ষগুলো আলাদা। জাদুকরের কালো বেড়ালদের কামড়ে নিহতদের নিয়ে জাদুকরের আয়নাভক্তরা অত্যন্ত খুশি। আবার অনেক মানুষ এমনিও খুশি, যাদের শরীরে আমিষের অভাব। অনেকদিন মাংস না খেয়ে নরমাংস ঝলসে খাওয়ার আকাংক্ষা তৈরি হয়েছে তাদের মনে। কিন্তু আরেকদল মানুষ কালো বেড়ালগুলোকে অভিসম্পাত দেয় এভাবে মানুষ মেরে ফেলার জন্য। পথে পথে প্রতিবাদ বাড়তে থাকে।
সিংড়াপুরের সিনেমাহলে “ওয়ার অন ড্রাগস” ছবিতে দর্শক কমতে থাকে। কিছু দর্শক সিনেমার রূপালী পর্দায় জুতা-স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারতে থাকে। কালো বেড়ালেরা সিনেমাহলের মালিককে “ওয়ার অন ড্রাগস” দেখিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু জাদুকর তার আয়নায় সিনেমা হলের অবিরাম জুতা-স্যান্ডেল ছোঁড়ার দৃশ্যে দেখে কিছুটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কালোবেড়ালেরা তখনো ক্ষুধার্ত। মাথাপিছু লাশের সংখ্যা যথেষ্ট না হওয়ায় তারা পাগল হয়ে ঘুরতে থাকে। সিনেমা হলের মালিক কালো বেড়ালদের বলে, আমার মনে হয়, “ওয়ার অন টেরর” ফিল্মটা দর্শক খুব পছন্দ করে।
কালোবেড়ালেরা তখন নতুন লাশের গন্ধ খোঁজে। কালো বেড়ালদের উপদেষ্টা বলে, সিংড়াপুরের মানুষ মাদকের নেশাটাকে অপরাধ মনে করছেনা। বরং কালোবেড়ালদের নরমাংসের নেশাটাকে অপরাধ বলে মনে করছে। তাই “ওয়ার অন ড্রাগস” মুভিটা পছন্দ করেনি। কিন্তু এদের অধিকাংশই যেহেতু ধর্মান্ধ এদের অপছন্দ নাস্তিকদের। অবিশ্বাসীর লাশ দেখে সংখ্যাগরিষ্ঠই খুশী হয়। আবার অবিশ্বাসীদের খুনীদের অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা আছে। তাই “ওয়ার অন টেরর” মুভিটা হতে হবে রক্তপাতহীন। আমাদের কালোবেড়ালগুলোকে তাই অবিশ্বাসী খেয়ে বেঁচে থাকার পথ খুঁজতে হবে। সিনেমাহলে “ওয়ার অন টেরর” মুভি রিলিজের সঙ্গে সঙ্গে “ওয়ার অন ড্রাগস” ছবির একনিষ্ঠ ভক্তদের একাংশ অবিশ্বাসী হত্যার সমালোচনার ছলে সবাইকে “ওয়ার অন টেরর” ছবি দেখার আমন্ত্রণ জানায়।
জাদুকর দক্ষ ইলিউশনিস্টের মতো দর্শকদের এই নানারকম নরভোজের আকাংক্ষাকে উপভোগ করে। জাদুকরদের সম্মেলনে গিয়ে বলেন, আমি গ্রামের জাদুকর; কিন্তু শহরের জাদুকরেরাও আমার কাছে জাদুর গোপন সূত্র শিখতে চায়। এদিকে অতিবৃষ্টিতে সিংড়াপুরের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ধর্মান্ধ ও দলান্ধরা একযোগে বলে, এ নিশ্চয়ই রহমতের বৃষ্টি। গ্রামের এক প্রায় অবসরে যাওয়া জাদুকর মনে মনে ভাবে, এইরকম বৃষ্টিকে আমিও রহমতের বৃষ্টি বলেছিলাম; কিন্তু ডুবন্ত মানুষেরা আমার জাদুর দর্শক হতে রাজী হয়নি।
সিংড়াপুর ইউনিয়নের একজন মেম্বর চেয়ারম্যান জাদুকরকে আশ্বস্ত করে, পথঘাটের অবস্থা ফার্স্টক্লাস। আপনার কাছে যেসব জলমগ্ন এলাকার ছবি আসে, ঐগুলো মিথ্যা ছবি; সিঙ্গাপুরের ছবিকে এরা সিংড়াপুরের ছবি বলে দাবী করছে। জাদুকরের সত্যের স্বর্ণমোহর পাওয়া দলান্ধ ও ধর্মান্ধ লোকেরা যারা উঁচু দালান তুলেছে; এই অতিবৃষ্টি তাদের স্পর্শ করে না। বরং একটু কাব্য ও ভুনাখিঁচুড়ি চর্চার সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু যারা জাদুকরের সত্যের স্বর্ণমোহর পায়নি তারা ডুবে যেতে থাকে অতিবৃষ্টিতে।
একজন মেম্বর সবাইকে বলে, অতিবৃষ্টিতে অসুবিধা হবে না; আমাদের যথেষ্ট খাদ্য মজুদ আছে। জাদুকরের সত্যের স্বর্ণ মোহর পেয়েছে যারা; তারা বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর চালু করে। বিদ্যুতের দায়িত্বে থাকা মেম্বর বলে, সিংড়াপুর বিদ্যুৎ-এ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আরেক মেম্বর বলে স্বপ্নের কথা, চেয়ারম্যান সাহেবই পারেন, উনিই পারবেন; কয়েকবছর পর সিঙ্গাপুরের লোকেরা সিংড়াপুরে আসবে চাকরি খুঁজতে।
কিন্তু বাজার করতে গিয়ে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মাংসের বাজারে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়ক গাছ। সবচেয়ে সস্তা মানুষের মাংস। আবার মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি ঢোল বিক্রি হচ্ছে। বাজারময় সে ঢোল নিয়ে জাদুকরের গুণগান করে বেড়াচ্ছে জাদুকরের কোলাবরেটরেরা। তাদের আহবান, ইতিহাস পড়ুন; পড়ুন প্রভু জাদুকরের নামে, রাজাকারদের নৃশংসতার কথা; পড়ুন হাওয়া জাদুকরের গ্রেনেডের গল্প।
এক লোক ঘুরে দাঁড়িয়ে এক দলান্ধকে বলে, সেসব পড়েছি; হাওয়া জাদুকরদের অনেক চেষ্টায়ও আমরা অতীতের কথা ভুলিনি; কিন্তু এটা মনে রাখবেন, আপনাদের শত চেষ্টাতেও আমরা বর্তমানকে ভুলবো না। ঘুরে দাঁড়ানো লোকটাকে কালো বেড়ালেরা টেনে হিঁচড়ে ঝোঁপে নিয়ে গিয়ে কামড়ে তার জিভ খেয়ে নেয়। দলান্ধ ঢুলিরা তাতে খুশি হয়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, সত্যের মালিক চেয়ারম্যান জাদুকর; সেখান থেকে একচুল নড়া মানেই সেটা মিথ্যা এবং মৃত্যু।
ম্লানমুখে কিছু লোক ফিস ফিস করে আলোচনা করে, যেদিন সিংড়াপুরের মানুষ প্রতিটি বিনাবিচারে হত্যার একসঙ্গে প্রতিবাদ জানাতে শিখবে; তা অতীতের হোক-বর্তমানের হোক বা ভবিষ্যতের হোক সেদিন আর কাউকে সত্য খুঁজতে জাদুকরের সত্যের আয়না দেখতে হবে না।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া