মাসকাওয়াথ আহসান
সিভিল সার্ভিসকে আগে সুপিরিয়র সার্ভিস বলা হতো। প্রজাতন্ত্রের সেবকের এই সুপিরিয়রিটি মেধা-যোগ্যতা-শিষ্টাচারের হবার কথা। সুপিরিয়র সার্ভিসে পদায়নের ক্ষেত্রে মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে খোঁজ নেয়া হতো, প্রার্থীটির পরিবারে দীর্ঘদিনের মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড (মৌলিক চাহিদা) পূরণ, শিক্ষা-দীক্ষা ও শিষ্টাচারের অনুশীলন আছে কীনা!
এই মাসলোর হায়ারার্কি পূরণে বা শিক্ষিত-শিষ্টাচারসম্পন্ন হতে প্রার্থীকে রায় বাহাদুর বা খান বাহাদুরের নাতি হতে হবে; এমন কোন কথা নেই।
সম্পন্ন কৃষক পরিবার, সৎ ও পরিশ্রমী শ্রমিক পরিবার, স্বশিক্ষিত ও শিষ্টাচারসম্পন্ন গ্রামীণ পরিবার, একটি পরিবারের মানুষের শিষ্টাচারের জন্য দশগ্রামে সুনাম আছে; এরকম পরিবারের ছেলেও সুপিরিয়র সার্ভিসে এসে সুনামের সঙ্গে কাজ করতে পারার কথা।
প্রার্থীর জিন দ্বায়িত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদের জন্য প্রস্তুত, নাকি চেয়ারে বসে, গাড়িতে বসে অহংকারে ধরাকে সরাজ্ঞান করবে সে, এটা দেখে নেবার নিয়ম সব দেশেই ছিলো; এখনো অনেক দেশে তা মেনে চলা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর মনস্তাত্বিক দিকটি খুবই অবহেলিত। প্রথমদিকে কেবল মেধা তথা মুখস্তবিদ্যাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এরপর একেবারে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এডিসি হারুন তার নিষ্ঠুর ডেন্টাল ক্লিনিকে ছাত্রলীগের দুটি ছেলের দাঁত তুলে নেবার পর এই আলোচনাটি খুবই জরুরি মনে করছি। এডিসি হারুনের ঘটনাটিতে আরেকজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা ও তার স্বামী প্রশাসন সার্ভিসের লোক আলোচনায় এসেছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে মনের আভিজাত্যকে গুরুত্ব না দেয়ায় এরকম কলতলা ও বাঁশতলার সিনক্রিয়েট হলো।
সুপিরিয়র সার্ভিসের লোক জীবনে যে কোন মুহূর্তে স্থিতধী থাকার কথা, ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর চেয়ে দায়িত্ববোধকে বেশি গুরুত্ব দেবার কথা।
আইসিএস ও সিএসপিদের জীবনেও এরকম ব্যক্তিগত সংকট এসেছে; প্রবাদপ্রতিম গায়ক সচিবের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করে এলোপ করার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ব্যাপারটাকে সফিস্টিকেটেড ওয়েতে হ্যান্ডল করেছেন তারা। গায়কের দাঁত ভেঙ্গে দেননি সচিব। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিচ্ছেদকে গ্রহণ করে সচিব স্থিতধী থেকেছেন। মানুষের মন, তা যে কোন সময় যে কোন কারো প্রেমে পড়তে পারে। কিন্তু তা নিয়ে লংকা কাণ্ড ঘটানো ও বিনোদনহীন সমাজের জীবনে গসিপের উপাদান তুলে দেয়া বুদ্ধিহীনতা। “যে যায় সে যায়”; তাকে চলে যেতে দিতে হয়। জীবন হচ্ছে গলফ খেলার মতো; এভরি টাইম ইউ সুইং; ইটস আ নিউ লাইফ।
সিভিল সার্ভিসে কেবল দলীয় আনুগত্য বিবেচনা করে নিয়োগ দিয়ে একে হযবরল পার্টি অফিসে পরিণত করা হয়েছে। এই হারুন যখন বিএনপি-বাম দল-ছাত্র পরিষদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে; তখন ছাত্রলীগের ছেলেরা তাদের ছাত্রলীগের হারুন ভাইকে সোহাগ করেছে।
সেই হারুনই যখন ছাত্রলীগের দাঁত তুলে নিয়েছে, তখন ছাত্রলীগের সেই হিলারিয়াস মোস্ট প্রেডিক্টেবল ক্লাউনস এসে বলছে, হারুন ছাত্রদল করতো।
ছাত্রলীগের সাবেক পরিবেশ উপ-সম্পাদক বলে সোহাগ করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো থ্রি স্টুজেস এখন এসে হারুনকে জিয়া হলের ছাত্রদল বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
ছাত্রদলের দাঁত তুলে নিলে ডেন্টিস্ট ছাত্রলীগের গর্ব; আবার ছাত্রলীগের দাঁত তুলে নিলে একই লোক ছাত্রদল।
এইসব লোকজন কিংবা তাদের পক্ষে পট করে পত্রিকায় পেটবানানো রিপোর্টারের মাথা ফাটিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে কয় ছটাক ঘিলু আছে সেখানে; নাকি মাথা ভর্তি গোবর।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা পুষ্টিহীন শিশুদের শেষ আশ্রয় লীগ-বিজেপি বা বিএনপি-জামায়াতের লঙ্গরখানা। পুষ্টির অভাবে মস্তিষ্ক বর্ধিত না হলে, মাথার খুলিটা ছোট রয়ে যায়। ফলে সেই মাথাগুলো এরকম, ছাত্রদল পেটালে পুলিশ ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ পেটালে পুলিশ ছাত্রদল টাইপের পিং পং সিদ্ধান্তহীনতায় দুলে।
১৯৭৩ সালের তোফায়েল ক্যাডার, ১৯৯৮-৯৯ সাল থেকে শুরু হওয়া নাসিম ক্যাডার, ২০০২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিএনপি ক্যাডার, এরপর ২০০৯ থেকে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগ ক্যাডার, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কফিনে অসংখ্য পেরেক ঠুকে একে কলতলা ক্যাডারে রুপান্তর করা হয়েছে।
দুজন কিচেন মেইড রাজনীতির মাজারে গদিনশীন হয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করে; পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একটা অগোছালো রসুইঘর আর তারপাশে চব্বিশ ঘন্টা ক্যাচক্যাচনির কলতলায় রুপান্তর করেছে।
সিভিল সার্ভিসের হারুনেরা এখন ভাতের হোটেলে খাওয়ায় পুলিশী নির্যাতনে মাথা ফাটিয়ে দেয়া রোগীকে, হারুনেরা তাদের ডেন্টাল ক্লিনিকে দাঁত তুলে নেয়, জীবনের ব্যথা উপশম প্রকল্পে ক্রসফায়ার করে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় আদম সন্তানদের।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে দারিদ্র্যে বিশীর্ণ জীবনে শুকনো বনরুটি খেয়ে এরপর পুলিশের বড় কর্তা হয়ে আঙ্গুর খেতে খেতে ক্ষমতাসীন সরকারের ভোটের প্রচারণা করে। এইভাবে জন্ম হয় বিএনপির কোহিনূর, লীগের বেনজির এমনকী বিজেপির বিপ্লব, যে বিএনপির দশ ডিসেম্বরের সভা পণ্ড করতে এসে শিবির ধরে নাশতা করার গল্পের ছলে ইসলামোফোবিয়ার মনোজগতের এক্সরে রিপোর্ট দিয়ে গেছে। রাজশাহীতে পুলিশের আরেক তরফদার নাগরিকদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার হুংকার দিয়েছিলো।
এতো হবেই; পট করে দলীয় বিবেচনাতে যে লোক জেনেটিক্যালি যে পদের যোগ্য নয়, সেই পদে তাকে দিলে, সে এসে ইসলামোফোবিয়া, হিন্দুফোবিয়া, বিএনপি ফোবিয়ার গল্প বলতে বলতে খুনে প্রদীপ হয়ে উঠবে।
এইসব দলীয় আনুগত্যের ভৃত্যদের আবার রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার শুদ্ধ ও আচার শব্দদুটিতে গোবর লেপন করেছে।
আনপ্রফেশনাল ভিলেজ পলিটিক্স আর মাজারের খাদেমভিত্তিক পশ্চাদপদ অন্ধকার রাষ্ট্রের শাসন সংস্কৃতি এরকমই হয়। দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ নিতে নিতে একসময় লোম ওঠা অন্ধ অক্ষম নেকড়ের চারণভূমিতে পরিণত হয় গোটা দেশ।
“It’s frightful that people who are so ignorant should have so much influence.”
–George Orwell
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া