মাসকাওয়াথ আহসান
পাকিস্তানের নির্বাচনে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পাকিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাসে সেনাপ্রাধান্য ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি দেশটির জনমানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এসেছে। তাদের একটি বড় অংশের মাঝে সেনাতোষণের প্রবণতা রয়েছে এমন অভিযোগও ছিলো। কিন্তু রাজনীতির ইমরান যুগে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত ছিলো।
জনপরিসরে সেনাপ্রশাসন ও এর গোয়েন্দা সংস্থার প্রকাশ্য সমালোচনা দেখে ঠাহর করা যাচ্ছিলো; দীর্ঘ জনঅসন্তোষের প্রকাশ ঘটতে চলেছে। তেহেরিক ইনসাফ পাকিস্তান (পিটি আই) নেতা ইমরান খান ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে সেনা আশীর্বাদ পেয়েছেন; এমন রসালো আলাপের মাঝেই তিনি রাজনৈতিক প্রশাসনে সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর কালোছায়ার বিরুদ্ধে ইমরানের এই দ্রোহ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রে ইমরান ক্ষমতা হারান। ক্ষমতায় থাকা ইমরানের চেয়ে ক্ষমতা হারানো ইমরান যেন অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাকে গ্রেফতার করলে সাধারণ মানুষ সেনা সদর দপ্তর ও লাহোর সেনানিবাসে হামলা চালায়।
৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণ দলবেঁধে ভোট দিয়ে দলীয় প্রতীকের অধিকার হারানো পিটি আই-এর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ী করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ইমরানকে বিতর্কিত সব মামলায় মনগড়া শুনানি করে মোট ৩০ বছরের কারাদণ্ড শুনিয়ে; তার দলটিকে বিনাশের অপচেষ্টা করে সেনা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভকে স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছিলো। যেটা হয়; রাজনীতির বাইরের লোকেরা সবসময় জনগণের রাজনৈতিক শক্তিকে খাটো করে দেখে। সেনা প্রশাসন যেন ধারণা করতেও পারেনি ভীতির রাজত্ব কায়েমের পরেও সাধারণ মানুষ এইভাবে সাহস করে ক্ষমতার বুলেটের জবাব গণতন্ত্রের ব্যালটে দেবে।
নির্বাচনের দিন শেষে ভোটের ফলাফল ঘোষণা শুরু হলে ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে জনগণের ব্যালট বিপ্লব কী ঘটনা ঘটাতে চলেছে। যাদের প্রতীক কেড়ে নেয়া হয়েছে, প্রচারণা চালাতে দেয়া হয়নি, কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে; সেই পিটি আই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে অধিকাংশ ফলাফল এসে পড়লেও ইসলামাবাদ, লাহোর, করাচির মতো বড় শহরের ভোটের ফলাফল আটকে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে ইউনিফর্ম পরা লোকেরা রিটার্নিং অফিসারের দপ্তরে গিয়ে ফলাফল পরিবর্তনের চাপ দিতে থাকে। নওয়াজ শরিফকে নিশ্চিত ভরাডুবি থেকে বাঁচাতে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে মাঠে নেমে পড়ে অশুভ শক্তিটি; অসংখ্য প্রামাণিক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গণধিক্কার ছড়িয়ে পড়ে জনপরিসরে।
নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করলেও; ফলাফল প্রকাশ সুষ্ঠু হয়নি; এই অভিযোগ নিয়ে পিটি আই নেতারা নির্বাচন কমিশনে গিয়েছে। কিছু আসনে ফলাফল পরিবর্তনের অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়টি যে আদালত পর্যন্ত গড়াবে; এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
পিটি আই সমর্থিত প্রার্থীদের স্পষ্ট ম্যান্ডেট কেড়ে নেয়া হলেও চূড়ান্ত ফলাফলে তারা এমন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে যে, হয় তাদের নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে; অথবা তারা রয়ে যাবে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে। সেনা প্রশাসন সাংসদদের বেচাকেনার যে হর্স ট্রেডিং করে আসছে দশকের পর দশক; পুরোনো অভ্যাসে সেরকম অপচেষ্টা তারা চালাবে বলাইবাহুল্য। কিন্তু এতো দমন নিপীড়ন করেও যে পি টি আই দলটিকে তারা কার্যকরভাবে ভাঙ্গতে পারেনি; জনগণের ভোটে সমর্থনের এই নবায়ন দেখার পর তাদেরকে আগের চেয়েও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। মনে রাখতে হবে সাধারণ মানুষের চোখে সেনাবাহিনী এখন “গণশত্রু”। তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর কারণে নওয়াজ শরিফ তার পায়ের নীচের মাটি হারিয়েছেন। সেনা গোয়েন্দা সংস্থার মদতপুষ্ট ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকেও জনগণ একেবারেই সমর্থন দেয়নি। পাকিস্তানের জনগণ ধর্মীয় মৌলবাদি; এই যে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে প্রচলিত মিথ; তাকে জনগণ ভোটের ভাষায় একেবারেই ভুল প্রমাণ করেছে সাম্প্রতিক ও এর আগের তিনটি নির্বাচনে।
আফঘানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের স্পনসর করা যুদ্ধের পরে যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে; তাদের সন্ত্রাসবাদি হামলার ভিক্টিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যে কোনভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদকে কোন রাজনৈতিক পরিসর দেবে না; এটা ভোটের ফলাফলে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে বেশ ভালো ফল করেছে এই নির্বাচনে। তাদের সঙ্গে কোয়ালিশন ছাড়া পিএমএলএন বা পিটি আই সমর্থিত স্বতন্ত্র জোট কারো পক্ষেই নতুন সরকার গঠন সম্ভব নয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ তরুণ যে পিটি আই সমর্থক; এই নির্বাচনী ফলাফলেও তার স্পষ্ট আভাস রয়েছে। এরকম বদলে যাওয়া রাজনৈতিক মানচিত্রে সেনা প্রশাসন ও নওয়াজের তামাদি ক্ষমতা চিন্তার অসাড়তা সুস্পষ্ট। জনবিমুখ পরিবারতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের শেষ দিনগুলোই যে পাকিস্তান প্রত্যক্ষ করছে; আর ইমরান খানই যে জনমুখী গণতন্ত্রের প্রবক্তা; এই জনচিন্তার অস্থিধারণ করেই পাকিস্তানের ভবিষ্যত রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হবে; সে আলোচনাই চারপাশে শোনা যাচ্ছে দিনভর।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।