প্রিয়তমা এমেরিকা আমার,
এবার এমেরিকা ঘুরতে এসে বিরহ যন্ত্রণা বড্ড কাঁদাচ্ছে আমায়। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদি, টিস্যু দিয়ে চোখের কোণাটা মুছি। লাস্যময়ী উজরা জিয়ার জন্য মন কাঁদে; বেরেলি বাজারে তোমার কান থেকে খসে পড়া ঝুমকাটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি হৃদয়ের সিন্দুকে। আর কী দেখতে পাবো তোমার এলোকেশী সর্বনাশী হাসি; আর কী তোমার পায়ের চিহ্ন পড়বে আমার হীরক নগরীর ঐ বাটে। স্মৃতি ইরানির বিনুনিতে তো সেই জীবনের উল্লাস নেই, উদ্দাম সাঁঝের প্রতিশ্রুতি নেই; যতটা হুল্লোড় আছে তোমার রিনিরিনে হাসিতে জড়িয়ে যাওয়া স্মৃতির কার্নিশে; তোমার চুলে জড়িয়ে যাওয়া গল্পের নদীতে।
ক্লাসের দুষ্টু ছেলেটির মতো ডনাল্ড লু যখন, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথাটা বারবার বলে; আমি তো জানি সে ব্লিংকেনের চোখ ব্লিংক করে স্যাংশনের ভয় দেখাচ্ছে। আমি কী এখন কম্বোডিয়ার হুনসেন কিংবা বেলারুশের লুকাশেংকোর প্রচ্ছায়া হয়ে বেঁচে থাকবো! তুমি ভিসা স্যাংশন সক্রিয় করলে আজ। তাইতো গতকালের দেখায় উজরা আর তুমি ভীষণ প্রাণখুলে হাসছিলে; আর আমার মনে হচ্ছিলো,হাসিনাই হাসিনাই ছোট সে সোনার তরী, আমারই ধূসর বিষাদে গিয়াছে ভরি।
আহারে আমার হিউস্টোনের বাড়িটা; ভার্জিনিয়ার বহুতল অফিসে আমার জন্য রাখা সেই কিউবিক্যাল; আহারে গোলাপ বাগান; তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি; ছেড়ে যাচ্ছি বস্টনের এম আইটির পাশের বাজারে সুভেনির শপের পাশ ঘেঁষে কফি শপ; যেখানে কেমিকেল আলীর সঙ্গে বসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আলাপ করেছিলাম; ভোটসমনিয়ার গল্প করে কৌতুকে কৌতুকে ভরিয়ে তুলেছিলাম গোধূলির আড্ডাটা।
আমি কী তবে কবি হয়ে যাবো; ঐ যে বাংলাসাহিত্যের যে ওরস মেহেফিলগুলো হয়; ঐখানে কবিতার ওয়াজ নিয়ে লুকিয়ে হাজির হয়ে যাবো। কিন্তু পিটার হাঁস তখন প্যাঁক প্যাঁক করে বলে উঠবে, আরে তুই কে টিক্কা না, আমি তোর কারেক্ট কারেক্ট শুইনা আমি বুইঝা ফালাইছি।
অথচ কী করে বোঝাবো আমি, আমিও তো একরকম মোল্লাই। ধর্ম মোল্লার কাছে যেমন জোরে জোরে সুরা উচ্চারণ করে নামাজ পড়াটাই আসল; তারপর গরীব মানুষের টাকা মেরে ওমরায় গেলেও মোল্লার তাতে আপত্তি নেই। ফেসবুক পোস্টে এসে ওমরাহ’তে গিয়ে মসজিদুন নবীতে তোলা ছবিতে লিখে দেয় , মাশাল্লাহ।
আমিও তেমনি জোরে জোরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াটাকেই বিশুদ্ধ দেশপ্রেম মনে করি; তারপর কেউ গরীব মানুষের টাকা মেরে পুণ্যভূমিতে গিয়ে মাজারে অশ্রু নিবেদনের ছবি তুলে শেয়ার করলে; ফেসবুকে তার মন্তব্যে লিখে দিই, জয় বাংলা।
আমি নয়া প্রগতিশীল তো, তাই নও মুসলিমের মতো আমার ধক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। আমাকে ভীষণ এক্সিবিট করতে হয়, আমি রবীন্দ্রভক্ত, আমার খুব ভালো লাগে পূজা-পর্বের গান, আমি ভীষণ আপটুডেট, মিসোজিনি শব্দের মানে জানি। ওয়েস্টিনের পাপিয়ার আসরে মাঝে মাঝে মিসোজিনি শব্দ এসে ব্রেণে ধাক্কা দিলে; তখন আবার শব্দটাকে গিলে নিয়ে হলুদিয়া পাখিটাকে লাভ-হান্টার মেরে বলতাম, নাচরে বিজলী নাচ।
আমার খুব ঘৃণা হয় গরীবী দেখতে। আমার বাবা করাত কলের পাশে কাঠ ফাঁড়াই করতো বলে; আমি যাবতীয় শ্রমিকের ঘাম, করাতে কেটে যাওয়া হাতের যন্ত্রণা, ভাতের কষ্ট মুছে ফেলেছি স্মৃতি থেকে। তাই ফেসবুকে যখন বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া মিরপুরের রাস্তা নদীতে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হয়ে মৃত লাশ ভাসতে দেখি; আমার তখন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই উদযাপন করতে ইচ্ছা করে। এইসব গরীবী আমার ভালো লাগেনা; আমার বরং সেকুলারিজমের চেবানো চুইংগাম চিবিয়ে একটা ফেসবুক পোস্ট দিতে ইচ্ছা করে। এই যে জঙ্গী সমস্যা, হিজাব পরার সমস্যা, এই যে দাড়ি টুপির সমস্যা; এগুলো তো অনেক বড় সমস্যা। মিরপুরের রাস্তানদীতে ভেসে বেড়ানো লাশের চেয়েও বড় সমস্যা।
আমি হয়তো একটু নরভোজি হয়ে উঠেছি। ফেসবুকে কেউ উন্নয়নের সমালোচনা করলে; কেউ লাইলাতুল ইলেকশনের ফজিলতের কথা বললে ইচ্ছা করে এলিট দোস্তদের ফোন করি, ক্রসফায়ার করে হরিণের মাংস এনে দিতে; কে বলে আমাদের মাংসের স্বাধীনতা নেই!
জ্যাকসন হাইটে এলে আগে চারপাশ থেকে ছুটে আসতো সহমত ভাই, সহব্রত দাদারা। আসেন ভাই একটু বিরিয়ানি খেয়ে যান; আসেন ভাই আপনার ঘাড় মালিশ করে দিই, হাত-পা ও মানবসম্পদবলয় টিপেটুপে উন্নয়নের হাইড্রোসিল করে দিই। অথচ এবার আমায় দেখে একটি দুধের মাছিও এসে বসলো না গায়ে। নিউইয়র্কের আকলিমা নদী একবারো ফোন করে বললো না, সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ করেছি; আসুন ভাই; আপনি আমার নজরুল সঙ্গীত শুনতে শুনতে খাবেন। ঐ যে ঐ গানটা, প্রিয় যাই যাই বলো না!
আমি একা, শুধু একা, আমার আপন কেহ নাই। জাতিসংঘের করিডোরে সবাই আমার দিকে এমন করে তাকায়, আমি যেন ইদি আমিন কিংবা রবার্ট মুগাবে। আমি কোথাও কিছু বলতে চেষ্টা করলে এমনকী উগান্ডা ও রুয়ান্ডার প্রতিনিধিরাও ঘুমিয়ে পড়ে।
কাল চলে যাবো ওগো ওয়াশিংটন তোমায় ছেড়ে; যে তুমি জর্জ ওয়াশিংটন ছিলে, সে কেন ডেনজেল ওয়াশিংটন হয়ে ইকুয়ালাইজারের আঘাত করলে আমায়। অথচ আমি তোমার জন্য রাজশাহীর আম এনেছিলাম, সোনার নৌকা ও নক্সী কাঁথা এনেছিলাম। এতো কাছে ছিলাম, এতো দূরে সরিয়ে দিলে আমায়।
থাক আর জো বাইডেনের মতো দেঁতো হাসি হেসোনা; অমন হাসি তোমরা গাদ্দাফি আর সাদ্দামের সঙ্গেও হেসেছিলে। তোমাকে বোঝাতে পারিনি, গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উন্নয়ন। এ আমার অক্ষমতা হে প্রিয়ে। এখন আমায় মোদী মিনসের ভরসায় বাঁচতে হবে। গেরুয়া প্রগতিশীলতার সারিন্দা হয়ে নাচতে হবে।
বিদায় ওয়াশিংটন, বিদায় স্ট্যাচু অফ লিবার্টি; আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হীরক রাজার দেশে যেখানে, লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।