সিজোফ্রেনিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দমূল Skhizein (to Split বা বিভক্ত করা) এবং phrenos (mind বা মন) থেকে।সিজোফ্রেনিয়া মানে বিভক্ত ব্যক্তিত্ব বা বহু-ব্যক্তিত্ব নয়। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ জনসংখ্যার মানুষের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক বা হিংস্র নয়।
১৮৮৭ সালে জার্মান মনোবিদ এমিল ক্রেপলিন প্রথম এই রোগের সন্ধান পান। এই রোগ মূলত চেতনাকে আক্রান্ত করে বলে ধারণা করা হয়। এটি একই সাথে আচরণ এবং আবেগগত দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে। ১৯১১ সালে ইউগেন ব্লুলেয়ার প্রথম সিজোফ্রেনিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি সিজোফ্রেনিয়া। স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট সিজোফ্রেনিয়া ডটকমের তথ্য মতে, চীনে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ থেকে এক কোটি ২০ লাখ। ভারতে এই রোগীর সংখ্যা ৪০ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৮০ লাখ ৭০ হাজার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার জানান,বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। এতে আক্রান্তরা সম্মানহীন, বন্ধুহীন, আত্মীয়হীন অবস্থায় জীবনযাপন করে। শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।
সিজোফ্রেনিয়া কী?
সিজোফ্রেনিয়া রোগটি একক কোনো রোগ নয়। বরং আটটি ভিন্ন ধরনের সমস্যার সমন্বিত রূপ। জিনগুলো আসলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। বরং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে মস্তিষ্কে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে সিজোফ্রেনিয়া হয়।
স্কিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের সূচনার সাধারণ বয়স হল প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্ক, যদিও এটি বয়ঃসন্ধিকাল থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত যে কোনও জায়গায় শুরু হতে পারে। একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে অন্য একটি মানসিক অসুস্থতায় নির্ণয় করে পরে যখন মানসিক অস্বাভাবিকতা ধরণটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন সিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, সিজোফ্রেনিয়া পুরুষ এবং মহিলাদের মোটামুটি সমানভাবে প্রভাবিত করে তবে পুরুষদের মধ্যে এটি আগে শুরু হতে পারে। বিশ্বজুড়ে হার একই রকম। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় কম বয়সে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, মূলত হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো সহ-ঘটমান চিকিৎসা অবস্থার উচ্চ হারের কারণে।
সিজোফ্রেনিফর্ম ডিসঅর্ডারের প্রাথমিক নির্ণয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি ছয় মাসের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ করে এবং সিজোফ্রেনিফর্ম ডিসঅর্ডার তাদের চূড়ান্ত রোগ নির্ণয়। বাকি দুই-তৃতীয়াংশের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত সিজোফ্রেনিয়া বা সিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের নির্ণয় করা হয়। সিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলির মতো একই সময়ে বিষণ্নতা বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার (প্রধান বিষণ্নতা বা ম্যানিয়া) এর লক্ষণগুলি অনুভব করে (ভ্রম, হ্যালুসিনেশন, অসংগঠিত কথাবার্তা, স্থূলভাবে অগোছালো আচরণ, বা নেতিবাচক লক্ষণ)। স্কিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সিজোফ্রেনিয়ার মতো সাধারণ, যা প্রায় ০.০৩% লোককে তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে প্রভাবিত করে।
কী কারণে হয়?
গবেষণায় দেখা যায়, মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণে ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদান ভারসাম্যহীন হলে এ রোগ একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক কারণ বেশি কাজ করতে পারে। আবার কতগুলো কারণ একসাথেও কাজ করতে
যেসব পরিবার তীব্র আবেগ প্রকাশ করে, তাদের সদস্যদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। বঞ্চিত পরিবারে সিজোফ্রেনিয়া বেশি দেখা যায়। গর্ভকালীন মা ইনফ্লুয়েঞ্জা বা রুবেলা আক্রান্ত হলে শিশুর পরবর্তী জীবনে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। পারে। বংশে কারো থাকলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। জন্মকালীন কোনো জটিলতা থাকলেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাবা মা দুজনের মধ্যে একজনের থাকলে সন্তানের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা ১৭%। যদি উভয়েরই থাকে তবে সন্তানের হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৪৬%।
লক্ষণ
সিজোফ্রেনিফর্ম ডিসঅর্ডারে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলির মধ্যে দুটি বা তার বেশি জড়িত থাকে –
- বিভ্রম
- হ্যালুসিনেশন
- এলোমেলো বক্তব্য
- ক্যাটাটোনিক আচরণ
- নেতিবাচক লক্ষণ
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এমন ধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যার কোনো ভিত্তি নেই। যেমন, অনেকে বিশ্বাস করেন তিনি মহাপুরুষ। তাঁর অনেক ক্ষমতা আছে যা দিয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। কোনো কারণ ছাড়াই কেউ বিশ্বাস করে তাঁর নিজের বাবা-মা, স্বামী স্ত্রী বা কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁর ক্ষতির চেষ্টা করছে। তাঁকে পাগল বানাতে চেষ্টা করছে বা হত্যা করতে চাইছে। রোগী নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারেন। রোগীর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসসংক্রান্ত কতগুলো ভুল ধারণার জন্ম নেয়। তিনি নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। কেউ স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি তীব্র সন্দেহে ভুগতে পারেন।
রোগী কতগুলো অবাস্তব দৃশ্য দেখে, এগুলোকে বাস্তব মনে করেন। কোনো বাস্তব স্পর্শ ছাড়াই অনুভব করতে পারেন, কেউ তাকে স্পর্শ করছে। শরীরে খোঁচা লাগার অনুভূতিও হতে পারে। তাঁরা অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলেন বা কথা ঠিকমতো বোঝা যায় না। এই রোগীদের আচরণ স্বাভাবিক থাকে না। কখনো একেবারে চুপচাপ, আবার কখনো অতিরিক্ত নড়াচড়া করেন বা কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। পোশাক-আশাক এবং নিজেরাও অপরিষ্কার থাকেন। কোনো কাজেই উৎসাহ পান না। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। অন্যকে শারীরিকভাবে আঘাত করার প্রবণতা তৈরি হয়। অনেকে অন্য কারো সাথে, বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গ এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পারেন না। একা একা থাকতে চান।
চিকিৎসা
সিজোফ্রেনিয়া সাধারণত টকিং থেরাপি এবং ওষুধের একটি পৃথকভাবে তৈরি করা সমন্বয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বেশিরভাগ লোককে কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ টিম (CMHTs) দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। CMHT-এর লক্ষ্য হল আপনার যতটা সম্ভব স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সাথে সাথে প্রতিদিনের সহায়তা এবং চিকিসা প্রদান করা। একটি CMHT গঠিত হতে পারে এবং এতে অ্যাক্সেস প্রদান করতে পারে:
- সামাজিক কর্মী
- মানসিক স্বাস্থ্য নার্স (Psychiatric Nurse)- যাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ রয়েছে
- পেশাগত থেরাপিস্ট
- ফার্মাসিস্ট
- সাইকোথেরাপিস্ট, মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ।
রোগীকে মানসিক চাপ না দেওয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা ও চিন্তামুক্ত রাখা খুব জরুরি। যদি তিনি ওষুধ সেবনের মধ্যে থাকেন তবে ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন কি না, চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিকভাবে রোগীর ক্ষেত্রে সহেযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাকে পাগল বিবেচনা করা ঠিক নয়।
সিজোফ্রেনিয়ার প্রতিকার নেই। তাই এটির চিকিৎসা করার জন্য ,আন্টিসাইকোটিক ড্রাগ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয় তা উপসর্গগুলিকে সহজ করতে পারে এবং ফিরে আসা থেকে প্রতিরোধ করতে পারে।
সাদিয়া সুলতানা চৈতী, তরুণ স্বাস্থ্য বক্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
Reference
- https://www.nhs.uk/mental-health/conditions/schizophrenia/treatment/#:~:text=Schizophrenia%20is%20usually%20treated%20with,as%20much%20independence%20as%20possible.
- https://www.nimh.nih.gov/health/publications/schizophrenia
- https://www-ntvbd-com.cdn.ampproject.org/v/s/www.ntvbd.com/health/1183/%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8B%E0%A6%AB%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%80%E0%A7%9F?amp=&_js_v=a9&_gsa=1&usqp=mq331AQIUAKwASCAAgM=#amp_tf=From%20%251%24s&aoh=16925188563418&csi=1&referrer=https%3A%2F%2Fwww.google.com&share=https%3A%2F%2Fntvbd.com%2Fhealth%2F1183%2F%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%259C%25E0%25A7%258B%25E0%25A6%25AB%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25A3-%25E0%25A6%2593-%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25A3%25E0%25A7%2580%25E0%25A7%259F