মাসকাওয়াথ আহসান
নির্বাচন প্রকৌশল শাস্ত্রের ক্লাস চলছে। ব্লাকবোর্ডে অনেকগুলো বৃত্ত এঁকে “এরিয়া অফ কমোননেসে”র অংক বোঝাচ্ছেন অধ্যাপক বাড়াভাত ছাইষ্ণু (বাছা)। যে বড় বৃত্তের মাঝে “এ” লেখা আছে; কী করে ছোট ছোট বৃত্তগুলো এসে সেই বৃত্তের পেটের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে; তা দেখানো হয়। আরেকটি বড় বৃত্ত “বি”-কে দেখানো হয় সব্বোনেশে বৃত্ত হিসেবে। কী করে সে “বি” বৃত্তটিকে হারুনের ভাতের হোটেল, সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স, আয়নাঘর আর হেলমেট বৃত্ত দিয়ে ঘিরে রেখে জুডিশিয়ারির ধূসর বৃত্তে ঢুকাতে হয়; আর তাতে কী করে “এ” বৃত্তটিকে একমাত্র বৃত্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়; সেটা ব্যাখ্যা করছেন অধ্যাপক বাছা।
এ বৃত্তটির চারপাশে দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমের ঢালাই দিয়ে স্তম্ভ নির্মাণ করে; উলম্বভাবে প্রতিবেশীর ছাদের বিম এনে কী করে প্যালা দেয়া যায়; তা এঁকে দেখানো হয়।
দেলোয়ারের পিএসসি কলেজ থেকে পাশ করা এক কালা চশমা পরা ছাত্র বলে, স্যার কঠিন লাগতেছে; একটু ভাইঙ্গা বলেন। আমার কাজ এইখানে কোথায়!
বাছা বিরক্ত হন, তোমার এতো বোঝার দরকার নাই। তুমি শুধু খেয়াল রাখবা জোসেফ স্টালিনের “ইলেকশন রেজাল্টস ম্যানিপুলেশন” অংকের দিকে। ছাত্র বলে, স্যার, আমি তো গওহরডাঙ্গা বহুমুখী বিদ্যালয়ের ছাত্র। এলাকা কোটায় আসছি। এতো ইংরেজি কইলে বুঝি ক্যামনে!
–তুমি এর আগের মতো ৮০-৯০ টা ফল সহ পুরা ফলের গাছ উপড়াইয়া আনবা না। তোমারে যে ডালি দেয়া হইছে তাতে ৪৫-৫০-৫৫ টা ফল পাইড়া আনবা।
–স্যার গাছে তো কোন ফলই ধরে না। দেখলেন না, ২ টা ফল হইছিলো; তা পাইড়া আইনা ৮-৯টা ফল বইলা খাওইলাম।
অধ্যাপক বাছা বলেন, এইখানে হেলমেট বৃত্তের দায়িত্ব। এই গাছে আর ফল হবে না। এই গাছ বন্ধ্যা। তাই হেলমেট বৃত্তের কাজ হচ্ছে; অন্য লোকের ফল গাছ থেকে ৪৫-৫০টা ফল পেড়ে এনে বন্ধ্যা গাছে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা। উগান্ডার পর্যবেক্ষকেরা ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করার সময় যেন মনে হয়, এই গাছে অনেক ফল। মানে খুবই ফলবতী বৃক্ষ। তারপর তুমি সুতা খুলে খুলে ফলগুলো টুকরিতে ভরবে।
হেলমেট পরা ছাত্র বলে, স্যার আমাদের দেখলেই তো লোকজন গাছের ফল আগে পাইড়া নেয়; অথবা ফলের চারপাশে জাল দিয়ে দেয়; গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে। ফল চুরির কাজটা সংস্কৃতিবৃত্তের লোকদের দেয়া যায় না!
–সংস্কৃতি বৃত্তের লোকেদের দায়িত্ব নিজেরাই ফল সেজে ভোট কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা। ওরা শুধু ফলের অভিনয় করবে; ফলের উপস্থিতি বাড়াবে।
ভাতের হোটেলের কালো চশমা পরা ছাত্র বলে, অসুবিধা নাই, ফলমূল পাইড়া আনার কাজটা নাহয় আমিই নিলাম। যেভাবেই হোক ভোটার উপস্থিতি দেখাতে হবে এই তো। দরকার হয় একই ভোটার ট্রাকে করে বিভিন্ন লোকেশনে ঢেলে দিয়ে ভীড় সৃষ্টি করে দেবো। উগান্ডার পর্যবেক্ষকেরা বিস্মিত হবে। ইদি আমিনের ভোটে তো কাকপক্ষীও বসতো না; এইখানে তো ভাত ছড়াইলে কাকের অভাব নাই।
সংস্কৃতি মামা গম্ভীর হয়ে বলে, আমরা না হয় ফল সেজে গ্ল্যামার এনে দেবো ভোট কেন্দ্রগুলোতে। সঙ্গে কিছু ভাইরাল যদি এনে দেন। আজকাল ভাইরালদের পিছে ভিড় ভাট্টা বেশি।
ভাতের হোটেল বলে, আমার হোটেলে ভাইরালেরা নিয়মিত খায়। অসুবিধা নাই; পাইয়া যাবেন।
বুদ্ধিজীবী মামা গোঁফ কামড়ে বলে, মূল্যবোধের অবক্ষয় এমন হয়েছে; আজকাল আমাদের নির্বাচনী সভায় বক্তার চেয়ে দর্শক কম হয়। কী যে করি!
ধর্ম মামা পান চিবাতে চিবাতে বলে, এই জন্যই তো বলি ইংকু ও মিংকু ভাইয়ের মত হজ্জ্ব-ওমরাহ করে আসেন। দেখবেন তখন দর্শক টুপি পইরা দাড়ি চুলকাইতে চুলকাইতে দৌড়াইয়া আসবে!
সেকুলার মামা ধমক দেয়, এই আপনি কী দেশটাকে মৌলবাদীদের খপ্পরে ফেলতে চান!
ধর্ম মামা ফিরতি ধমক দিয়ে বলে, আমরাও আজকাল ক্যালিগ্রাফিতে বিসমিল্লাহ লিখি নৌকার মতো কইরা। হেইদিন আর নাইরে নাতি!
অধ্যাপক বাছা বলেন, তোমাদের এইসব খুচরা কোন্দলগুলো আপাতত সিন্দুকে ঢোকাও। ইলেকশনের আগে পর্যন্ত মোল্লা-পুরোহিত একসঙ্গে থাকো। আরে বাবা জামায়াত আর বিজেপি তো একই ব্যাপার। পার্থক্য কেবল পোশাকে।
সেকুলার মামা বলে, না স্যার আমাদের কালচারটা বেশি।
অধ্যাপক বলেন, আরে বাবা একই কলতলার চোর তোমরা; কালচার আলাদা হয় কীভাবে!
চোর শব্দ শুনে পুরো ক্লাস স্তব্ধ হয়ে যায়। অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার সবাই এমন চুপ মেরে গেলে কেন!
উন্নয়ন মামা বলে, বিংশ শতকে যারা চোর ছিলো; একবিংশে তারা ডাকাত হয়েছে। তাই চোরের খনিকে এখন থেকে ডাকাতের খনি বলে ডাকবেন স্যার!
সংস্কৃতি মামা আক্ষেপ করে, সবই ঠিক আছে স্যার, কিন্তু আজকাল লোকে ভারতের পেয়াজ খেয়ে পেয়াজ হারামি করে।
আয়নাঘর মামা দুঃখ করে বলে, চিনি আর কফি হারামি করে লোকেরা ব্রাজিলের সঙ্গে। কী যে দিনকাল এলো!
অধ্যাপক বলেন, এখন ইলেকশনের আগে ছোট খাটো বিবাদ বন্ধ রাখো বললাম না!
বুদ্ধিজীবী মামা জিজ্ঞেস করে, এবারের ইলেকশনে পাকিস্তানকে গালি দিলে ঠিক জমছে না। লোকে শুধু হাহা দেয়। করি কী স্যার!
অধ্যাপক উত্তর দেন, এমেরিকা আর পাকিস্তানের একটা প্যাকেজ গালি বানাও। কই সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স তুমি তো গালি বিশারদ, তোমার অভিমত কী!
–স্যার আমরা এমেরিকাকে ইংরেজিতে গালি দেয়ার জন্য দুটি লোককে নিয়োগ দিয়েছি; আপনি চাইলে উর্দু জানা দুটি ওলামা নিয়োগ দিই; আচ্ছামত গালি দেবে। সেকুলারের চেয়ে ওলামা দিয়া গালি দিলে ইমপ্যাক্ট বেশি আসবে।
সেকুলার মামা গোঁ ধরে বলে, এই দায়িত্বটা আমরা নিতে চাই। সামান্য বাজেট দিলেই হবে।
অধ্যাপক বলেন, এই সেকুলার, আমি জানি ইজরাইলের জন্য তোমাদের প্রাণ কাঁদে। তবু যদি একটু কষ্ট করে গাযার ফিলিস্তিনিদের জন্য কাঁদাকাটি করতে পারো; তাহলে এন্টিএমেরিকান গালিগুলো দিয়ে দিতে পারবে সেই সুযোগে।
দেলোয়ার পিএসসি কলেজ থেকে পাশ করা একজন ছাত্র বলে, স্যার আমাদের সাত দিনের একটা বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করুন। আমরা কম্বোডিয়া, বেলারুশ আর উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে শিখে আসতে চাই; কী করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করতে হয়।
অধ্যাপক উত্তর দেন, তোমরা শুধু বিদেশ সফরের তালে থাকো। ঠিক আছে ব্যবস্থা করছি। ওখানকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটগুলো ঘুরে এলে মন্দ হয় না!
এমন সময় ফুলবাবু সেজে এক লোক এসে ক্লাসরুমে প্রবেশ করেন, ব্লাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলে্ন, অধ্যাপক “এ” বৃত্তটিকে একটি ফুলের নক্সায় আঁকুন। আর ছোট ছোট বৃত্তের ফুলগুলোকে এনে “এ” বৃত্তের বৃন্তে গেথে দিন। তাহলেই গণতন্ত্রের শতফুল ফুটবে। আর ঐ “বি” বৃত্তের মধ্যে মাকড়সা এঁকে দিন। সাজাপ্রাপ্ত মাকড়সা। ফুল থেকে “বি” বৃত্তের মাকড়সারা নেয় বিষ; আর আমরা “এ” বৃত্তের মৌমাছিরা নিই মধু।
ক্লাসের রেড স্প্যারো ছাত্রী খলবল করে ওঠে।
ফুলবাবু পেলব হাসি হেসে তাকে চোখ টিপে বলেন, ভালো হয়ে যাও মাসুদা!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।