মাসকাওয়াথ আহসান
বাইগার নদীর পাড়ে বসে বালি খায় ভ্যাকসিন চৌধুরী। একজন চৌধুরী সেনা তার মাথার ওপর ছাতা ধরে রাখে আর সে বালি খায়। সে যাতে ইচ্ছামতো বালি খেতে পারে সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী পেতে সে নতুন দিল্লিতে লর্ড কর্নওয়ালিশের কাছে চিঠি লিখেছিলো বেশ কিছুকাল আগে, প্রিয় বালিস্বামী, আমি আর কিছু নাহ, কেবল বালি খেতে চাই। আপনি আমাকে বালি খাইবার বন্দোবস্তী দিয়া বাধিত করিবেন।
লর্ড কর্নওয়ালিশ একবার পরিদর্শনে এলে বাইগার নদীতে বালিঝড় হয়। হাওয়ার তোড়ে তার ছাতাটা ভেঙ্গে যায়। তখন ভাঙ্গা ছাতা মেরামত করে দেয় ভ্যাকসিন। এতে খুশি হয়ে কর্নওয়ালিশ তাকে চৌধুরী টাইটেল দিয়ে যায়। আর পাশ্ববর্তী এলাকা পয়সার হাটে লোকমুখে রটে যায় সে খবর, আমগের আমব্রেলা ইঞ্জিনিয়ার এখন চৌধুরী হইছেগো; অহন থিকা তুমরা তারে ভ্যাকসিন চৌধুরী নামে ডাকবা।
গোপালপুর মন্দিরের পুরোহিত রাহুল রাহা খবর পেয়ে পুজোর থালা নিয়ে আসে, ভ্যাকসিন চৌধুরীর কপালে তিলক এঁকে দিয়ে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে। গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা সুপার মওলানা সুবহান উল্লাহ আসে, চৌধুরীর শান সৌকত বৃদ্ধির জন্য মুনাজাত ধরে। অত্র এলাকায় একটি মডেল মসজিদ নির্মাণের আবদার করে নতুন চৌধুরীর কাছে।
ভ্যাকসিন চৌধুরী আশ্বাস দেয়, সব হবে সব হবে; আগে এলাকা থিকা পুরান চৌধুরী তাড়াও; শিক্ষক তাড়াও; বেশি বিদ্যা ভালো কথা নয়। অত্র এলাকার নতুন নাম হইলো তাড়াইল। আমরা বালি খাইবাম আর শত্রু তাড়াইয়াম। ওসি সাবরে খবর দাও।
ওসি হারুন এসে হাত জোড় করে দাঁড়ায় দিল্লি থেকে বন্দোবস্তী পাওয়া ভ্যাকসিন চৌধুরীর সামনে। ভ্যাকসিন হুংকার দেয়, যাও ওসি যাও ঐ পুরান চৌধুরীরে গান্ধা কইরা দেও; তার বড্ড বিদ্যার অহংকার।
ওসি এরপর গরম পিঠা ফুঁ দিয়ে দিয়ে খাওয়ার মতো ঠোঁট করে পুরান চৌধুরীর’র নামে পেট বানিয়ে কলতলার গল্প বলে। খুশি হয়ে ভাকসিন চৌধুরী বলে, এইরাম সব গল্প দিবা ওসি; তুমারে বাঁশখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানাই দিমু। ওসি লেগে যায় তার গরম পিঠায় ফুঁ দেবার মতো ঠোঁট করে গান্ধা করার খেলায়। আর কনস্টেবল কুমারকে দায়িত্ব দেয়, পুরান চৌধুরীর সমর্থকদের জেলে ভরার। কুমার এইকাজে পাকা। আগে সে যাত্রাপালার সিপাহসালার ছিলো। সুতরাং নেমে পড়ে কাজে।
ভ্যাকসিন চৌধুরী খালি বালি খায় আর জমি দখল করে। হাজার বিঘা জমি না হলে কী করে আর আমব্রেলা লর্ড হবে সে। ভ্যাকসিন চৌধুরী তার নিজস্ব সেনাদল তৈরির জন্য; শহরগামী ভিক্ষুকদের আর ভিক্ষা বৃত্তিতে না যাওয়ার অনুরোধ জানায়, হাজার বছর ধইরা ভিক্ষা করছো; পয়সার হাট বানাইছো ঠিক আছে; এইবার ঐসব ছাড়ো, এইবার বালি খাও, জমি খাও।
ভ্যাকসিন চৌধুরীর আজব এক অভ্যাস। সে কাউকে কামড় দিলে সেই লোক ক্ষ্যাপাটে হয়ে যায়; অমনি তাকে দলভুক্ত করে চৌধুরী। এই কামড়কেই ভ্যাকসিন বলা হয়।
ভ্যাকসিন দূরবর্তী টাকা শহরে প্রাসাদ কেনে। সেইখানে সে নিয়মিত প্রমোদে যায়। লালপরী আর নীলপরীদের হুকুম দেয় তার মুখে আঙ্গুর দিতে; ঠিক সিনেমার মতো। এখন যে তাকে আসল চৌধুরী হতে হবে। সিনেমা চৌধুরীর মতো সিল্কের গাউন পরলে গা চুলকায়, চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞকে ডেকে খস খস ভুঁড়ি চুলকে জিজ্ঞেস করে, চৌধুরী হইতে কী বিশেষ জাতীয় চামড়া লাগে নাকি গো ডাক্তার। যাও কোন আসল চৌধুরীর গায়ের চামড়া তুইলা নিয়া আমার বডিতে ফিট করো।
টাকা শহরের সাংবাদিক ফখর আলী আসে চৌধুরীর জীবনীকার হবার প্রস্তাব নিয়ে। চৌধুরী সানন্দে তার জীবনীকার নিয়ে হেলিকপ্টারে করে তাড়াইলে এলে তার বেগার রেজিমেন্ট গার্ড অফ অনার দেয়।
ভ্যাকসিন চৌধুরী ঐ সাংবাদিককে নিয়ে বাইগার নদীর ধারে যায়। যেইখানে কর্নওয়ালিশের ছাতা ভেঙ্গে গিয়েছিলো; ঐখানে ছাতার ভাস্কর্য বানানো হয়েছে। ছাতা মেরামতের গৌরবের কাহিনী সেখানে উতকীর্ণ রয়েছে শ্বেতপাথরে।
চৌধুরী যখন তার পাজেরো হাঁকিয়ে জীবনীকারকে সঙ্গে নিয়ে চৌধুরী বাড়ির দিকে যাক; তখন গাড়ির শব্দ শুনে মায়েরা তাদের ঘুমে অনিচ্ছুক শিশুদের ভয় দেখায়, “ঐ চৌধুরী আইলো।” শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রাসাদে পৌঁছে জীবনীকার অরেঞ্জ জুস খেতে খেতে দেয়ালে সব বিরাট সাইজের ছবি ঘুরে ফিরে দেখে; চৌধুরীর পূর্বপুরুষের ছবি। এরকম পোট্রেটে কোমরে তলোয়ার থাকে যেখানে; সেইখানে একটা করে বন্ধ ছাতা।
আত্মজীবনীকার জিজ্ঞেস করে, অটোবায়োগ্রাফির নাম কী দিবো জাঁহাপনা?
–দেখোনা সবাই আমার ছাতার তলে আইসা খাড়াইছে; এইটা আমার ছাতা প্রজাতন্ত্র!
আত্মজীবনীকার ফখর পরামর্শ রাখে, ইংরেজিতে নাম হইলে আভিজাত্য আসবে স্যার, নাম রাখেন, আমব্রেলা রিপাবলিক।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।