মাসকাওয়াথ আহসান
শেষ কবে ঘুমিয়েছি মনে নাই; খুব সম্ভব এমেরিকা আমার এলিট দোস্তদের নিষেধাজ্ঞা দেবার আগের রাতটিতে ঘন গভীর জামবাটিতে ফেনাওঠা দুধের ঘ্রাণে মন আকুল করা সে ঘুম ঘুমিয়েছিলাম। এলিটদোস্তদের ক্রসফায়ারের শব্দ শুনলেই আশ্বস্ত হতাম; কোথাও শত্রু নিধন হলো; আমরা নিরাপদ হলাম। ফেসবুকে আমার সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদার শত্রু খতমের উল্লাসে লাভ লাইক কেয়ার ও হাহা দিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম নিরাপদ তন্দ্রায়।
এমনকী যেদিন মার্কিন দূত উজরা জিয়া এলেন; সেদিনও তার ঘুম ঘুম চোখের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম। তার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। হিউস্টনের বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেবে “বাজেয়াপ্ত” সম্পত্তি, ভার্জিনিয়ায় আমার বহুতল ক্যাশিয়ার অফিসটি সিলগালা করে দেবে; ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়ে বলবে, যা ভাগ! তবু মায়াবন বিহারিনী উজরার লাস্যে দারাশিকোর মতো ভাবালুতায় বলেছিলাম, দুবাই কিংবা দিল্লীতে যতটুকু খুশিজল ও পদ্য জমিয়ে রেখেছি; তাতে বেশ কেটে যাবে বাকি জীবন। তবু এই যে মুহূর্তটুকু যখন মিথ্যে করেও উজরা বলছে, আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিই।
আহারে মির্জা গালিব তুমি বলেছিলে, বন্ধুত্ব না হোক শত্রুতায় তুমি ছিলে; তবু তো একটা সম্পর্কে ছিলে।
এরপর ডোনাল্ড লু আর পিটার হাস সব সুখ তছনছ করে ছুঁড়ে দিলো ভিসা নিষেধাজ্ঞা। জো বাইডেনের সেলফির মর্যাদা তারা দিলো না। যেমন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্রিকেটার তামিমের ছবির মর্যাদা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড দেয়নি।
আমার ভিসা কেড়ে নাও; তাই বলে আমার ছেলেমেয়েরও ভিসা কেড়ে নেবে! আমরা যুদ্ধাপরাধীর অপরাধের দায়ে তাদের একটি দুটি ছেলেকে শাস্তি দিয়েছি এটা ঠিক; কিন্তু অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থকের ছেলে মেয়েকে উচ্চপদে বসিয়েছি। তারা দেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চারুপাঠ দেয়। আমার ছেলে-মেয়ে দুটিকে তোমরা উচ্চপদে নাও; হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র করো; দেখবে হেসে হেসে আমাকেই ওরা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ছবক দিচ্ছে।
ইদি আমিন রেগে গিয়ে বললো, পিটার হাসকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে। রবার্ট মুগাবে বললো, পিটার হাসকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিতে হবে। সামহোয়ার ইন আফ্রিকার এই গর্জন শুনে আমার বড্ড ঘুম পেলো।
কিন্তু হঠাতই দেখলাম অষ্ট্রেলিয়ার লাস্যময়ী সাংসদ আমাদের অপরাধের তালিকা করেছে। কিছুই বাদ দেয়নি সে। ওর সঙ্গে কী আমাদের দেশের কোন সুশীলের দেখা হয়েছিলো! সে অমন রেগে রেগে আমায় ম্যাগনিটস্কি স্যাংশন দিতে বললো কেন! অমন লক্ষ্মীপানা মুখে কী সব অলুক্ষণে কথা! ঘুম কেড়ে নিলো এই অমরাবতী এবিগালি বয়ড, চশমা পরা ভালো ছাত্রী। ভালো ছাত্রীদের আমি বড্ড ভয় পাই। ছাত্রী খারাপ হলে সংরক্ষিত আসনের ছলিম বুঝ দিয়ে বসিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু ভালো ছাত্রীর অনেক প্রশ্ন! কেন দিনের ভোট রাতে হলো, কেন ক্রসফায়ারে মেরে দেয়া হলো আব্বু তুমি কান্না করতেছোর মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডিতে, কেন গুম করে দেয়া হলো বাবা-ভাই ও স্বজনদের; কেন প্রেস ক্লাবের সামনে গুম হয়ে যাওয়া বাবার অপেক্ষায় কন্যা! কেন ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে লেখক মুশতাকের মৃত্যু হলো পুলিশ হেফাজতে; কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক কুবরার অপরাধটাকে বড় করে তুলে সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্সের ছোট চুল সুঠাম দেহীরা তাকে অন্ধকার কারাগারে ছুঁড়ে দিলো!
চুপ করো এবিগালি বয়ড; তোমার এতো কেন কেন শুনতে শুনতে নিজেকে নাতসি মনে হয়; মনে হয় পাকিস্তানের খুনে সেনা; মনে হয় রক্তপিপাসু নরভোজি আমি!
অথচ এই আমি নেত্রীকে নিয়ে গান বাঁধি, দেশের গান গাই, জাতির জনকের মাজারে গিয়ে শিশুর মতো কাঁদি, এই আমি ওমরাহ করতে গিয়ে মসজিদুল নবীতে করুণ চোখে তাকাই পবিত্র রওজার দিকে। মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে কত লোককে দেশপ্রেম শেখাই। আবার ঈদে মিলাদুননবী এলে মাথায় টুপি পরে কত লোককে ধর্ম প্রেম শেখাই। এতো বড় তালেবর আমি; আজকাল প্রাডোতেও পাছা আঁটেনা; হেলিকপ্টার চাই; চাটার দলের সঙ্গে চাটার্ড বিমানে আড্ডা দিই; নৌবাহিনীর রাজকীয় প্রমোদ তরীতে সংরক্ষিত আসনের গুনাই বিবিদের সঙ্গে কোরাসে গাই, ইশকুল খুইলাছে মওলা ইশকুল খুইলাছে!
এই তো কদিন আগেও নিজেকে মনে হতো বাহুবলী, সরকার সমালোচকদের বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করতো! ধমক দিয়ে ঢাকার ভিসা ক্যানসেল করে দিতাম এর-ওর; অথচ এখন আমাকে তোমরা ভিসা শহীদ করে দিলে উজরা জিয়া! আমায় এতো তুচ্ছ করলে যে এখন ফেসবুকে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ভুয়া তালিকা দেখলেও থরোকম্প হয়। মনে হয়, দুবাই থেকে নিউইয়র্কগামী প্লেনে ওরা আমাকে উঠতে দেবে না, বলবে সামহোয়ার ইন আফ্রিকা চলে যাও; ওখানে ইদি আমিন ও রবার্ট মুগাবে তোমার জন্য ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করছে। ঘুমের মধ্যে মনে হয় ইদি আমিনের দেয়া ফুলগুলো সরিয়ে নাও; বড্ড লাগছে।
আজকাল যে কী হয়েছে, সেই শোলে ছবির গব্বর সিং কখনো পিটার হাস হয়ে কখনো ব্লিংকেন হয়ে কখনো বা ডোনাল্ড লু হয়ে আমার কানের কাছে এসে অট্টহাসি দেয়, আব তেরা কীয়া হোগা কালিয়া!
আমাদের একজন যুধিষ্ঠির পরিকল্পনা মন্ত্রী আছেন, যার পরিকল্পনার পরী উড়ে গিয়ে কল্পনা পড়ে আছে হাওরে পদ্মের পাশে। তিনি ঐ ইউরোপীয় ইউনিয়ন আসন্ন নির্বাচন বয়কট করে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে চিঠি পাঠানোতে, ইইউ বৈঠকে আমাদের অপরাধনামা নিয়ে আলোচনা করে গার্মেন্টসের কোটা সুবিধা বাতিলের আলাপটা তোলার কারণে কীনা জানিনা; কোন একটা স্যাংশনের কথা বলেছেন!
সর্বাঙ্গে স্যাংশন, ওষুধ কী করবে ফাংশান। আমরা কী পারবো কম্বোডিয়ার হুনসেনের মতো বেলারুশের লুকাশেংকোর মতো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে। লুকাশেংকোর আছে রাশিয়ার নটরাজ পুতিন, আমাদের আছে ভারতের গেরুয়ারাজ মোদী! শিবব্রত দাদার গালে সুপোরী পুরে দেয়া আশ্বাসে “ক্ষমতার দাদির কবরটা”কে দুইনয়নের জলে ভিজিয়ে রাখতে আমি পারবো কী!
মোদীর ভরসায় চোখে একটু ঘুম লেগে আসতেই অষ্ট্রেলিয়ার পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় “ম্যাগনিটস্কি” স্যাংশনের বলে। এবিগালি বয়ড হান্টার হাতে দাঁড়িয়ে; ক্রোধে বিস্ফারিত চোখ তার। জিজ্ঞেস করে, এই তোর অমন ভোটসমনিয়া রোগ কেন! উত্তর দিতে দেরি হলে চাবুকের শপাং। জিজ্ঞেস করে, এই তুই এতো লুটপাট করে সুইস ব্যাংকে কেন টাকা রেখেছিস! উত্তর দিতে না পারায় শপাং! এই তুই ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট নিয়ে বাতাবি টিভিতে কেন জাস্টিফিকেশন দিয়েছিস! ক্রসফায়ার গুমের প্রসঙ্গ এলেই কেন টাইম মেশিন মেথডে অতীতে চলে যাস! তুই তো বলেছিলি, ক্রসফায়ার হচ্ছে সভ্যতার বাগানে আগাছা পরিষ্কার! অই তোর বাপে কোনদিন সভ্যতা দেখেছে! ইঁদুর কোথাকার; খুব একটা হোয়াইট টাইগার সেজেছিস। যা এখন থেকে তোর সশ্রম কারাদণ্ড। আমার সভ্যতার বাগানের আগাছা পরিষ্কার করবি। দেখিস আবার ফুল গাছ কেটে ফেলিস নারে হাওরে পদ্ম।
নিজেকে তখন বাতাবি টিভির প্লট কৃষক তলস্তয় মনে হয়। মনে মনে বলি, আমার পেছনে দেখছেন, পরমা সুন্দরী এবিগালির পুষ্পবাগান। হঠাতই যেন দেখি ক্যামেরায় দাঁড়িয়ে পিটার হাস, লাইট তাক করেছে ডোনাল্ড লু’ আর কোলে একটা বাচ্চা কুকুরকে আদর করতে করতে ব্লিংকেন আমায় বলছে, আব তেরা কীয়া হোগা কালিয়া!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।