মাসকাওয়াথ আহসান
ইন্টারনেট মিডিয়া আসার পর জীবনে প্রথম আমি “অসাম্প্রদায়িক” শব্দটির এতো বহুল ব্যবহার দেখলাম। এটা যে একটা গুন; এটা আলাদা করে শিখতে হয়; সে আমার জানা ছিলো না।
ফেসবুকে আসার পর প্রথম শিখলাম, আমার শৈশবের বন্ধু দেবাশীষ-অর্জুন, স্কুল জীবনের বন্ধু সত্যজিত, কলেজ জীবনের বন্ধু মিতালী, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু তাপস-জয়দীপ-পার্থ এরা হিন্দু; কিংবা প্রশান্ত বৌদ্ধ। সিভিল সার্ভিসকালের অঞ্জন চাকমা দাদা বৌদ্ধ; সেটা মাথায় এলো এই ফেসবুকে প্রথম!
এর আগে একবারের জন্যও ধর্ম পরিচয়ের কথা মাথায় আসেনি। মাঝবয়সের বন্ধু অশেষ রায় যে হিন্দু; আমি মুসলমান; ফেসবুকের এঁকে দেয়া এই ধর্ম-বিভাজন রেখা নিয়ে আমরা প্রত্যেক শুক্রবার সাঁঝে নিয়ম করে হাসি। আমি তাকে ফোন না করলে বৌদি জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার তোমার বন্ধুর সঙ্গে ম্যারাথন আড্ডা দেখছিনা যে। কিংবা অশেষ রায় ফোন না করলে, আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, কী তোমার বন্ধুর ফোন আসেনি!
এই যে আমরা যারা ইন্টারনেট আসার আগে একবারও ভাবিনি নিজেদের ধর্ম পরিচয় আছে! এর একটা জেনেসিস আছে। আমি বন্ধুদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখেছি, আমাদের নানা-দাদারা সেইকালে বখে যাওয়া যুবক; উত্তম-সুচিত্রা, দিলীপ কুমার-মধুবালার ছবি দেখতো মুক্তি পেলেই। সিনে ম্যাগাজিনের সাবস্ক্রাইবার ছিলেন। রেডিওতে নাটক শুনতো। লং প্লে রেকর্ডে গান শুনতো। বৃটিশেরা সঙ্গে করে পশ্চিমা বই পুস্তক আনায়; এরা মুসলিম দর্শন ও ভারতীয় দর্শন পেরিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনের বারান্দায় আড্ডা দিতে শুরু করে।
একবার আমার নানা খুব সহজ করে এক সরল গ্রামীণ মানুষকে বোঝাচ্ছিলেন, আমি মারেফাতের লোক বাপু। দেশবিভাগে নানার বেস্ট ফ্রেন্ড দুবে দেশান্তরী হলে নানা একা হয়ে যান। এখনকার মতো হোয়াটস এপ তো নেই যে শুক্রবার সাঁঝে ঘটা করে আড্ডা হবে হাহা হাসির।
রিটায়ারমেন্টের পর আব্বা নিয়ম করে নামাজ পড়তেন। তার আগে আম্মার একটা মৃদু অনুযোগ ছিলো, লোকটা নিজেও নামাজ পড়েনা, ছেলেগুলোকেও শিখালো না। আব্বা তখন আমাদের দু’ভাইকে মেথডিক্যালি নামাজ পড়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আম্মার নিজের বাবাকেই উনি দেখেছেন, সূফি ভাবনা চর্চা করতে; কাজেই স্বামীকে কী করে আর এসব বলবেন তিনি। আম্মা সাহিত্যের ছাত্রী, বাবার কাছ থেকে চলচ্চিত্রের নেশা পেয়েছিলেন, বইপড়ার নেশাটাও; কিন্তু দাদীর কাছ থেকে নিয়মিত নামাজ পড়ার গুনটি পেয়েছেন।
আমার দাদার আগে দুই-তিনটি প্রজন্ম কষ্ট করে জাহাজে করে হজ্জ্ব করে এসেছিলেন। কিন্তু হাজির ছেলে পাজি তো হবেই; দাদার মাথা খেয়েছিলেন কলকাতার ডিরোজিও স্যার। “ইয়াং বেঙ্গলে”র বখে যাওয়া ছেলে আমার দাদা। তাই ছেলেকে দর্শন পড়িয়েছেন। পাশ্চাত্য দর্শনটা পড়তে বলেছিলেন বিশেষ করে। আব্বাও আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবসিডিয়ারিতে পাশ্চাত্য দর্শন ও ইতিহাস নিতে বলেছিলেন।
আমার নানা-দাদা দুজনেই ধর্ম-কর্মের ধারে কাছে না থাকলেও সততার সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। নানা নিজের এলাকার মন্দিরের জন্য সাধ্যমত জমিজমা উপহার দিয়েছেন। এই জায়গায় আমার অন্য ধর্মের বন্ধুদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা মিলে যায়। তাদের কারো কারো দাদা মসজিদের জন্য জমিজমা উপহার দিয়েছেন। প্রার্থনার ঘর তো প্রার্থনার ঘর; যেখানে সত্য সুন্দর আর কল্যাণ বিরাজ করে।
জার্মানীতে আমার এক বস ছিলেন, ড ফ্রিডেমান শ্লেন্ডার। মজা করে বলতেন, আমি একই সঙ্গে ফরিদ ও শৈলেন্দ্র। ড শ্লেন্ডার সংশয়বাদী ছিলেন, আমার বাবার মতোই এক লোক। তিনি রবিবারে চার্চে প্রার্থনার জন্য যেতেন না। কিন্তু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, বিভিন্ন চার্চে পিয়ানো বাজানোর আসরে।
আমার ভারতীয় ও পাকিস্তানী বন্ধুদের নানা-দাদাদের হিস্ট্রি একই। সব বখে যাওয়া তরুণ। তাদের অন্তঃমিল চলচ্চিত্র দেখার নেশায়। ভারতের বন্ধু সুনন্দার মা, কিংবা করাচীর বন্ধু তানিয়ার মায়ের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে দেখি দিল্লি কিংবা লাহোর শহরে বসে তা্দের ঠিক আমার আম্মার মতো শৈশব; যেখানে তাদের বাবা সঙ্গে করে সিনেমায় নিয়ে যেতেন; এমন কী পরীক্ষার আগেও।
আমি কাকতালীয়ভাবে আসলে ফিল্মি দাদা-নানাদের নাতি-নাতনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি ভূমি বাস্তবতায়। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে এসে “অসাম্প্রদায়িকতা” শিখলাম ইতিহাসান মোকসেদ কিংবা হালদা রায়ের কাছে। এর বিপরীতে “ইমান” শিক্ষা পেলাম শরিয়ত ভাইয়ের কাছে; শিবব্রত দাদা গালে সুপোরী পুরে “পোগোতিচিলতা” শেখালেন। এখন চিন্তা করি, এতোদিন কোথায় ছিলে ভায়ারা! মাঝ বয়সে এসে দেখা দিলে; আর এ জীবন পূর্ণ করলে!
এই যে মঙ্গলশোভাযাত্রা শুরুর দিনগুলোতে চিত্রকর বন্ধু তারেক-অঞ্জনের সঙ্গে চারুকলায় আনন্দময় সময় কাটাতাম শোভাযাত্রার আগে। এই কামালপাশা ভাই এসে মোয়া-চা খাওয়াতেন স্নেহভরে। কক্ষণো সেখানে কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তি ছিলো না। “অসাম্প্রদায়িকতা” নিয়ে গাল ফুলিয়ে কোন আলাপ ছিলো না।
শাহবাগ বনাম শাপলা; রাজনীতির এই তরুণদের জীবন নিয়ে খেলার আসরে; বাংলাদেশকে বিভাজিত করা হয়েছে চিরতরে। অথচ আমরা বইমেলার স্পন্দন স্টলে জাহানারা ইমামের স্নেহের সান্নিধ্যে কত বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়েছি। উনি একটিবারও “অসাম্প্রদায়িকতা” কথাটা উচ্চারণ করেননি। উনি ৭১ একাত্তরের মানবতাবিরোধী বিচার চেয়েছেন। বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত চেয়েছেন, যাতে সমসাময়িক বাংলাদেশে কেউ মানবতা বিরোধী অপরাধ না করে। সবাই জানতে পারে, মানুষ খুন করলে শাস্তি পেতে হবে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই বিচার দিতে বারগেইন করেছে, সে ক্রসফায়ারে মানুষ মারলে তাকে সমর্থন করতে হবে, সে ৫৭ ধারা-ডিজিটাল সিকিউরিটি কালাকানুন দিয়ে গুম-খুন করলেও তাকে জাস্টিফিকেশন দিতে হবে, নাসিরনগরে লীগের সন্ত্রাসীরা হিন্দু পল্লীতে হামলা করলে, সেই অপরাধের মাছ ঢাকতে হবে পূর্ণিমার ট্র্যাজেডির শাক দিয়ে। দেশ থেকে টাকা লুটপাট হয়ে গেলে, এস আলম ইসলামী ব্যাংক খেয়ে দিলে; তখন ফেসবুকে ৭১-এর অপরাধী কুমির ছানাগুলো দেখাতে হবে পুতুল নাচের কুমিরের মতো। মানুষের ভোট লুট হয়ে গেলে বলতে হবে, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাবার সম্পত্তি” করে নেয়াদের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিতে হবে; হ্যা ঐ বন্দোবস্তের বিকল্প নাই।
আহারে বিজন গ্রাম; এখানে গুজরাটের খুনি মানবতার চারা লাগায়, এখানে “নাস্তিক কতল করা ওয়াজিব” ঘোষণা দেয়া শাফি হুজুরকে নিয়ে শোকরানা মেহেফিলে সাদা খাম হাতে তুলে দেন মানবতার মা; যেমন করে সম্পন্ন গৃহের মা মিলাদ পড়ানো হুজুরকে হাদিয়া দেন। “তম একহাতে ওড়ে গেরুয়া পতাকা; আর হাতে চাঁদ তারা”, তিনিই পারেন, তিনিই পারবেন।
আর যার দাদা সাম্প্রদায়িক লোক ছিলো, তার নাতি নও সেকুলার বেশ ফেসবুক পোস্টে বিজেপির আপিস বসিয়ে পোগোতিচিলতার জ্ঞান দেয়। আপনি ফেসবুকে ঘটা করে দুর্গা পূজা করবেন, সেটা অত্যন্ত সেকুলার, নমস্কার বললেও সেটা বড্ড উত্তরাধুনিক। কিন্তু ঈদে-রোজায় ফেসবুক পোস্ট দিলে, কিংবা সালাম দিলে, ইসলামি ছাত্রী সংস্থার স্ত্রীর আঁচলে বসে নও সেকুলার বলবে, “ছাগু কুনহানকার”। আর হালদা রায় তো আছেন, উনি রামায়ণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেকুলার বয়ানে জানাবেন, ষড়যন্ত্র চলছে, দেশটাকে হনুমানজী গন্ধমাদন পর্বতের মতো তুলে “পাকিস্তানে” তুলে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্র। তোমরা সবাই লেন্দুপ দর্জির মতো সেকুলার ঝান্ডা বানাও!
যার দাদা সাম্প্রদায়িক ছিলো, সে তো একচক্ষু, সে নওমুসলিম, ধর্মের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার, জিজ্ঞেস করে, অই তোমার দাড়ি-টুপি কই; অই মেয়েরা তোমরা পর্দা-পুসিদা করনো কেন! নাস্তিকগো কল্লা ফালায়ে দেবোহানে! যার মা স্বাভাবিক শাড়ি পরতেন, তিনি সৌদি হিজাব পরে পোষাক পুলিশি করে বেড়ায়, অই আন্নের ঘোমটা নাই কেন! শাড়ি পড়ছেন ক্যান, হিজাব পরতে পারেন না কেন। স্বামী কিংবা প্রেমিককে ধমক দেয়, বুইড়া হইছো তাও দাড়ি রাখো নাই ক্যান! নামাজ-রোজা নাই কেন! পোলা-মাইয়াগুলি কী নাস্তিক বাপ দেইখা বড় হইবো! আহারে নও মুসলিমের ধর্মের প্রকোপ; আহারে শরিয়া আইনের স্বপ্নে বিভোর গণ্ডগ্রাম।
বিজেপির নও সেকুলার আর জামায়েতের নও মুসলমান নিয়ে “হাঁসুনি বাঁকের উপকথা”-র এই গল্পে হুতু ও তুতসিরা যত বেশি দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ করবে; তত বেশি ঘন হয়ে আসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নৌকা বাইচ। কারণ এই নরভোজি সমাজে দেশ লুট করে সেকেন্ড হোম বানাতে সুবিধা; কৃষক-শ্রমিকের রক্ত পানি করা টাকায় বড় বড় গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঘুরতে আরাম; শুধু গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার হারাম।
খেলা হবে মামা সুবিধামত “জয় শ্রীরাম” বলে; আবার “নারায়ের তাকবির” বলে; সব নৌকা ভেড়ায় ক্ষমতার ঘাটে; এইখানে গেরুয়া ও চাঁদতারা একসঙ্গে রক্ততৃষ্ণা মেটায়।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া