লুৎফুল কবির রনি:
নারীকে ছুঁতে পারা সাধনার বিষয়।
শরীর ছুঁয়েই যে-পুরুষ বলে নারীকে ছুঁয়েছি, সে নির্বোধ;
নারীর হৃদয় ছুঁয়েই তবে দেহ ছুঁতে হয়…
…..শরীর তো ধর্ষকও ছোঁয়।
পুরুষের ভালোবাসা পাওয়াও সাধনার বিষয়।
দেহদানের পরেই যে-নারী ব’লে পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছি, সে নির্বোধ;
পুরুষের বিশ্বাস ছুঁয়েই দেহ ছুঁতে হয়…
…….শরীর তো বেশ্যাও দেয়।
-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
‘তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি, কবিতা’
‘আমি তো কবিতা লিখছি সেই ছেলেবেলা থেকেই। যখন বছর চারেক বয়স, এক দিন খুব হুটোপাটি করে বাড়ি ফিরে কাকিমাকে বলেছিলাম, ‘রাত হল ভাত দাও।’ কাকিমা শুনে বলেছিলেন, ‘তুই তো বেশ কবিদের মতো কথা বলিস’। আমার কথাটা ছিল খুব সাধারণ। একটামাত্র পংক্তি। অথচ এর মধ্যেই বেশ একটা অন্ত্যমিলের ব্যাপার ছিল। সেটা শুনেই হয়তো কাকিমার ও-কথা মনে হবে।
তার পর বয়সটা যখন আরও খানিক বাড়ল, রোজই চার-পাঁচটা করে কবিতা লিখে ফেলতাম। কবিতা হত না সেগুলো কিছুই। মনে হত যেন কবিতা। আর সেই সমস্ত কবিতা খামে আটকে সব কাগজে পাঠিয়ে দিতাম। তখন কাগজ বলতে ছিল ‘খেয়ালি’, ‘দুন্দুভি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতী’, তার পর বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা তো ছিলই, আর ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘নিরুত্তর’। পটনা থেকে বেরোত ‘প্রভাতী’। আমার পাঠানো কবিতাগুলো অবশ্য কেউ ছাপত না। কবিতার সঙ্গে লিখে দিতাম, ‘মনে না ধরিলে ফেরত পাঠাইবেন।’ সঙ্গে গুঁজে দিতাম একখানা ডাকটিকিট। বেশির ভাগ লেখাই ফেরত আসত না। ডাকটিকিটগুলোও।’
আদ্যোপান্ত কবি-মানুষটিকে প্রথম চিনেছিলেন তাঁর বন্ধু, আরেক কবি অরুণকুমার সরকার, দিলীপ গুপ্তের সিগনেট থেকে নিজের নেপথ্য উদ্যোগে নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই নীলনির্জন (১৯৫৪) বের করে তাঁকে বলেছিলেন ‘কবিতা না লিখলে তুই তো মারাই যাবি।’
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভুত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’— এই লাইনটা অনেকেরই মুখে মুখে ফেরে। তাঁর ‘নীলনির্জন’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘উলঙ্গ রাজা’ ও ‘কলকাতার যিশু’ তো এর মধ্যেই প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
‘কবিতা কি ও কেন’ এবং ‘কবিতার ক্লাস’-এর মতো প্রাথমিক কবিতা শিক্ষার বই দিয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন কাব্যপিপাসুদের কাছে। ‘পিতৃপুরুষ’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আত্মজীবনী।
তাঁর শৈশবের পুরোটাই কেটেছে বাংলাদেশে, ঠাকুরদা আর ঠাকুমার কাছে। কবির ঠাকুরদা কর্মজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়। কর্মজীবন শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুর বাড়ি চান্দ্রা গ্রামে চলে আসেন। তার বাবা কলকাতার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করতেন। দুই বছর বয়সে কবির মা, বাবার কর্মস্থল কলকাতায় চলে যান। কবি থেকে যান ঠাকুরদাদা লোকনাথ চক্রবর্তীর কাছে।
সেই সময়েই মুখস্থ করেছিলেন কবিগান, রামায়ণ গান। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে যান কবি।
ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতে ভালোবাসতেন কবি নীরেন্দ্রনাথ। কবিগানের কথা একনাগাড়ে মুখস্থ আওড়ে যেতেন। চার বছর বয়সে কবির কাকিমা বলছিলেন, ’তুই তো দেখছি কবিদের মতো কথা বলছিস!’ শিশুদের জন্য তাঁর জনপ্রিয় রচনা ‘শাদা বাঘ’, ‘বিবির ছড়া।’ ‘কবিতার ক্লাস’ ও ‘পিতৃপুরুষ’ নামে কবিতা বিষয়ক তাঁর দু’টি প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে। কবির লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘অমলকান্তি।’ কবির সম্বন্ধে নাট্যকার, সাহিত্যিক ও অনুবাদক শিশিরকুমার দাস তাঁর ‘সাহিত্য সঙ্গী’তে লিখেছেন, ‘‘তাঁর ছন্দনৈপুণ্য প্রতিমা নির্মাণ কুশলতা, শব্দব্যবহারে নিজস্বতা তাঁর কবিতার জনপ্রিয়তার মূলে। প্রকৃতি ও প্রেম, সমকালীন জীবনের ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে নাটকীয় সম্ভাবনা এবং গভীর জীবনচেতনার উপলব্ধি তাঁর কবিতার জগত।’’
অকস্মাৎ কে চেঁচিয়ে উঠল রক্তে ঝাঁকি দিয়ে/ “নিলাম নিলাম নিলাম”।
আমি তোমার বুকের মধ্যে উঁকি মারতে গিয়ে/ চমকে উঠেছিলাম।
অথচ কেউ কোথাও নেই তো, খাঁ খাঁ করছে বাড়ি,/ পিছন দিকে ঘুরে
দেখেছিলাম, রেলিং থেকে ঝাঁপ দিয়েছে শাড়ি/ একগলা রোদ্দুরে।
বারান্দাটা পিছন দিকে, ডাইনে-বাঁয়ে ঘর,/ সামনে গাছের সারি।
দৃশ্যটা খুব পরিচিত, এখনও পর পর/ সাজিয়ে নিতে পারি।
(দুপুরবেলায় নিলাম, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
বাংলা কবিতার চল্লিশ এমন রোমান্টিকতা দেখেনি। ঝাঁঝালো দুপুরের টগবগে ঘোষণা শুনেছে বড়ো জোর। আর খুব রোমান্টিকতা শ্লেষে চাঁদের ফালি কাস্তে হয়ে এসেছে কখনো। এই প্রথম দৃশ্য ও ভাবনায় নবীন লাউ-লতাটি চনমন করে নিজের প্রকাশ দেখতে চাইল। ওই জেগে ওঠার খুব বড়ো আয়োজন নেই। দর্শনের অহং হাতছানি নেই। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলার মতো করে চোখের সীমা তার ধ্বনিময় উদ্ভাসে ফুরফুরে বাতাস কবিতা পাঠকের বারান্দায় উঠে এল। বুদ্ধদেবকৃত সম্ভ্রান্ত উৎকর্ষ কোথায় নড়ে আছে এইখানে, যেন সামান্য বধূটিকে জল নিজে ছুঁয়ে দেখবে এই বার। এবং এই বার আকাশকুসুম না হয়েও বাস্তব রূপরেখা হয়ে উঠবে।
তেমন জটিলতা নেই, নাটকীয়তা আছে, দুর্বোধ্যতা নেই, শহুরে পালিশ করা, ঝকঝকে ভাষা আছে, জনতার চিত্তহরণ আঙ্গিক আছে, অক্ষরে অক্ষরে আত্মপ্রকাশ ও সমাজের আশ্লেষে জড়িয়ে কবি অমলকান্তির রোদ্দুর হয়ে ওঠা যেন লক্ষ্য করল বাংলা কবিতা। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ফতোয়া থাকল না।
মানুষকে, মানুষের মর্যাদাকে কোনো অবস্থাতেই হীনমান হওয়ার বিপরীতে মাথা উঁচু সে এক অবস্থান আমরা ক্রমে লক্ষ করে গিয়েছি। ৭০ দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলন ও তদ্জনিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস – সব মূল্যবোধ নিশ্চিহ্ন হয়ে আছে। কবিকে তখনও বলতে হয়েছে, “যে আমার শত্রু, যেন সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতার/ যোগ্য হয়।/ শত্রু মিত্র নির্বিশেষে যেন স্বভাবের/ সমস্ত ক্ষুদ্রতা আমি বর্জন করি”।
আমাদের মনে পড়ছে চল্লিশে দেশজোড়া গণঅভ্যুত্থান, যুদ্ধ, আকাল, দাঙ্গা, দেশভাগ আর স্বাধীনতা। মাত্র ১০টা বছরের মধ্যে যুগান্তকারী সব ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ঢেউয়ের মাথায় ঢেউয়ের মতো একের পর এক আলোড়ন, জনজীবনের ভিত্তিমূলে কাঁপন। অভ্যস্ত জীবনের ঘেরাটোপ থেকে মানুষ নিক্ষিপ্ত হয়েছে এক অচেনা জগতে পরিবেশে। দুঃখ আর মৃত্যু দেখতে দেখতে স্বাধীনতা রোমাঞ্চিত জগতে দু-দণ্ড বসে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে চেয়েছে মানুষ। আর একজন কবি বৈপরীত্যের চড়াই-উৎরাই থেকে মনন তৈরি করে নিচ্ছিলেন তখন।
চল্লিশের বিক্ষুব্ধ সময়কে সঙ্গে নিয়ে যে মানবতার আকরটি মুক্তোর মতো হয়ে বসেছিল, মনে হয় সারা জীবন ধরেই ছিল, তাই স্বদেশ হারানো অন্য জীবনে এসে ব্যথায় প্রকট কবি নিজের জীবনের ব্যথা উঠে এসেছিল উপরিতলে।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯২৪ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
আপনি কবিতার প্রবাদ পুরুষ । আপনি আমাদের কবিতাকে বিদ্রোহ করতে শিখিয়েছেন। স্বাধীন করেন নি শুধু তার স্বাদ দিয়েছেন। বাংলা কবিতাকে ‘লিরিকের জেলখানা’ থেকে বের করে সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নতুন ছন্দ দিয়েছেন, চাবুকের মতো গদ্য দিয়েছেন। ছন্দ নতুন হয় না,ছন্দকে নতুন করে নিতে হয়। সেটাই ম্যাজিক।৯৪ বছর বয়েসে এখনও লিখে চলেছেন, তরুণের চেয়েও
তরুণ আপনার শব্দেরা।
ভাষা আপনাকে ছেড়ে যায়নি, ভাষা যেন এখনো আপনার ভৃত্য এবং ভগবান, দুজনেই কবির নির্দেশ পালন করে চলেছে।
নীরক্ত করবী। উলঙ্গ রাজা। কলকাতার যিশু। অমলকান্তি। চতুর্থ সন্তান। জঙ্গলে এক উন্মাদিনী।এরকম অন্তত ৩১ টা কবিতা বাংলার জনপদে এক সময় ঘুরে বেরিয়েছে। এখনো মুখে মুখে ঘোরে।এখন তারা ‘কুন্দবনে’ কিংবদন্তী।
আমিও চিরকাল অমলকান্তিকে ভালবেসে বুকে পুষে যাচ্ছি। শুভেচ্ছা আপনার জন্মদিনে।
অমলকান্তি
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
আজকের বাংলার দিকপাল সাহিত্যিকদের অনেকেই ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য। একবার তো যুবক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে চা এবং সিগারেট দিয়ে একটা ঘরে বন্ধ করে বলে গেছিলেন, “লেখা না পেলে ছাড়া পাবি না।” স্নেহের শাসন এবং প্রশ্রয়ে তিনি ছিলেন কারোর পিতৃপ্রতিম আবার কারোর বড় দাদা।
এমনকি ৯৪-বছর বয়েসে, এই কিছুদিন আগেও তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার পুজোসংখ্যার জন্য লিখেছেন একটি অপূর্ব লেখা, একটি একলা ঘুড়ির আখ্যান।
জীবনের সায়াহ্নে বসেও সূর্যোদয় দেখলে মন ভালো হয়ে যেত বিরাট মাপের এই মানুষটার। প্রিয়জনের মৃত্যুতেও ভেঙে পড়েননি, কাজ করে গেছেন এক নতুন সকাল দেখার আশায়।
অবাক ব্যাপার, সেই বড়দিনের দিনটাতেই “কলকাতার যীশু” কবিতার কবির প্রয়াণ হলো!
তাঁর স্মৃতিচারণায় কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, “জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়।”
সত্যিই তো, নীরেন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়ে গেছেন ভাষাকে ভালোবাসতে, ভাষা ও তার ব্যবহার নিয়ে তলিয়ে ভাবতে, সৃষ্টির ঋজুতা ধরে রাখতে এবং জীবনকে ভালোবাসতে। জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা, বঞ্চনাকে ঠেলে সরিয়ে তাঁর “যাবতীয় ভালোবাসাবাসি” সেই জীবনের সঙ্গেই, তাই তিনিই কবিতার ছন্দে, আগামীকে বুঝিয়ে বলতে পারেন,
“এক-একবার মনে হয় যে
এই জীবনের যাবতীয় ভ্রমণ বোধহয়
ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু
ঠিক তখনই
আমার চোখের সামনে হঠাৎ খুলে যায়
সেই রাস্তা,
যার ধুলো উড়িয়ে আমি কখনও হাঁটিনি।”
স্মরণে ঋদ্ধ হন কবি, বেঁচে থাকুন বাঙালি মননে।
লুৎফুল কবির রনি: লেখক ও আর্ট ক্রিটিক