মাসকাওয়াথ আহসান
সারারাত বিছানায় ছটফট করি। ঘুম আসে না। চোখের পাতা ভারি হয়ে এলেই; সেই স্বপ্নটা হানা দেয়। বস্তির লোকেরা আমার সুইমিংপুলে সাঁতার কাটছে। সোফায় কাদাওয়ালা পা তুলে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে হাসছে।
আমি মেরিল্যান্ডে ফোন করি ফৌজিয়ার কাছে; ও ফোন ধরে না কিছুতেই। ছেলেটাকে ফোন করি; বার বার ফোন কেটে দেয়। উঠে এক গ্লাস পানি খাই। বারান্দায় পায়চারি করি। নীচে লনে তাকিয়ে দেখি বস্তির লোকেরা ফুটবল খেলছে। সুইমিং পুলের দিকে তাকিয়ে দেখি ছোট ছোট নৌকা ভাসিয়ে খেলছে উশকো খুশকো কতগুলো বাচ্চা।
দৌড়ে ভেতরে যাই। শোকেসের মধ্যে সোনার নৌকাগুলো তেমনি রয়েছে। কাজের ছেলে কদমকে ডাকি, নীচে গিয়ে দেখে আয় তো কেউ বাগানে ফুটবল খেলছে কীনা!
কদম ঘুম ভাঙ্গা চোখ ডলতে ডলতে বলে, কী যে কন গোলাপ মামা! এতো রাইতে ফুটবল খেলবো কেডা! আর আন্নের বড় ভাই সালাউদ্দিন তো ফুটবলরে জাদুঘরে পাঠাইছেন!
–তুই জাদুঘর চিনিস!
–হ যেইখানে মানুষ থাকে না; তাগো ব্যবহৃত জিনিস থাকে। অ গোলাপ মামা; এইডা কী জাদুঘর না বাড়ি; কেউ থাহে না! আমার মনডা বসেনা এইখানে; গেরামে চইলা যামু গিয়া। রাস্তায় রাইরালেই লোকে কয়, এইডা নাকি ডাকাতের বাড়ি! আপনে নাকি ভোট ডাকাতি কইরা এই বাড়ি বানাইছেন। গোলাপ মামা গেরামে তো আপনের বাড়ি আমগো বাড়ির লাহানই আছিলো; কী চেরাগ পাইলেন যে এই রকম রাজা হইলেন।
–কী ঘুমের ঘোরে ভুল বকছিস কদম। যা ঘুমিয়ে পড়।
–ভুল তো বকতেছেন আপনে মামা; এতো রাইতে ফুটবল খেলবো কেডা! দিনের বেলাই খেলতে পারেনা; ভুটানের কাছে গোল খায়।
কদম ঘুমাতে গেলে; ফেসবুকে চোখ রাখতেই দেখি, লোকে মাত্র ৮.৮৬ শতাংশ ভোট নিয়ে হাসাহাসি করছে। না ঐ কুমড়ো পটাশটা শুধু কথার বাঘ; ভোট আনতে পারলো না! সন্দেহ হয়, এই ভোটটাও কী ও পেয়েছে নাকি সাবসিডি দিয়েছে আমাদের সঙ্গী কমিশন!
হোয়াটস-এপে আলমগীর ভাইকে বার্তা পাঠাই, ভাই আসলেও কী এই ভোট আসছে; নাকি সংখ্যার কবিতা লিখলেন; দুপুর দুইটা পর্যন্ত মাত্র দুই শতাংশ ভোট পড়ে; বাকি সময়ে নয় শতাংশ; নাহ বিশ্বাস হয়না।
আলমগীর ভাই জেগেই ছিলো, আপনা লোক হয়ে যদি বিব্রত করেন ভাই! ঐ ব্যাটা হিরো আলমের সামান্য আঘাত লেগেছে; আরে বাবা মরে তো নি। দেখুন তাই নিয়ে তদন্তের আহবান জানিয়েছে এমেরিকা! খুব ঝামেলায় আছি ভাই! শুনেছেন, উপাচার্য মহোদয় উন্নত দেশের ভিসা পাচ্ছেন না! তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে দূতাবাসগুলো!
ভিসা কথা শুনেই বুক ধড় ফড় করে। ফোজিয়াকে ফোন করি আরেকবার।
–হ্যা বলো; এতো বিরক্ত করো ক্যান; একটু জিম করতে আইছি; খালি তোমার ফোন; কেডা মরছে; এতো আর্জেন্ট কী কথা!
–ভোট মইরা গেছে গো ফৌজিয়া! আচ্ছা ভালো কথা; তোমগো বাড়িতে এফবি আই আসে নাই তো জিগাইতে; এতো বড় বাড়ি কেনার টাকা কই পাইলেন।
–কী কও তুমি এফ বি আই আইবো! ও আল্লা এইডা কী কও তুমি!
–আইবো না আইবো না; এমনি কইলাম; ডর লাগে গো ফৌজিয়া ডর। আমি কী করুম অহন। সারারাত ঘুমাইতে পারিনা। আমৃকা তো আসার উপায় নাই; কই যামু কোন বিপদে পড়লে!
–ক্যান সোয়ামীর কাছে যাইবা! ভারত যাইবা!
–ওরে আল্লা; পিকের টেকাটুকাগুলি কাইড়া নিয়া অরে জেলে ঢুকাইছে! মনে নাই সেই রেডক্রসের তালেবর; টেকাটুকা তো পায়ই নাই; রোড এক্সিডেন্টে মরছে!
–আমি গেলাম; তুমি মরো গিয়া!
ফৌজিয়া ফোন রেখে দিলে; আমি সব হারানো এক নদী ভাঙ্গনের মানুষের মতো বসে থাকি। চারিদিকে পানি আর পানি; কুল নাই কিনার নাই; কলার ভেলায় ভাসতে থাকি ভাসতে থাকি লক্ষিন্দরের মতো; আমার বেহুলা নাই; বেহুলা এখন আম্রিকায় জিম করতেছে।
শেষ রাতের দিকে চোখ জুড়ে এলে একটা স্বপ্ন দেখি; শ্মশানের স্বপ্ন। “অন্তর্জলী যাত্রা”-র বুড়াটাকে রাখা হয়েছে চিতার ওপরে; সে কী মরে গেছে; নাকি এখনো কিছুটা বেঁচে আছে!
হঠাত দেখি নরেন্দ্র মোদী বলছেন, মরেনি মরেনি; ওকে একটা বিয়ে দেয়া হবে এখন; যাও ষোড়শী সাজিয়ে নিয়ে এসো!
জয়শংকর বসে মন্ত্র পাঠ করছে; যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার মন্ত্র।
দূরে চেয়ারে বসে বাইডেন বাঁধানো দাঁত বের করে হাসছে, যতই মাথা চুলকাও মোদী তোমার রাজা বাঁচাতে পারবে না।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া