আরিফ রহমানঃ
বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে যেটা হচ্ছে সেটাকে আমরা বলতে পারি সরকারী ব্লাসফেমি আইন। সাধারণত ব্লাসফেমি আইন করা হয় ধর্মকে প্রটেক্ট করতে। আজ থেকে এক হাজার ৪৫০ বছর আগে রোমের সামন্ত রাজারা প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী খ্রিষ্টান ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের সহায়তায় জনগণের ওপর ধর্মের নামে রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধতাকে রুখে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ‘ব্লাসফেমি’র ব্যবহার শুরু করেছিল। সে সময় রাজা বাদশাদের বলা হত ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলা, এইভাবে রাজার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগনের আন্দোলন যাতে গড়ে না উঠতে পারে সেই জন্য ব্লাসফেমি নামের এই কালো আইন তৈরী হয়েছিল। আধুনিক যুগে এসে যখন চার্চ ও রাষ্ট্রকে আলাদা করা হয়, তখন থেকে এ আইনের বিবর্তন ঘটে।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ধর্মের বোরখার আড়ালে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মধ্যযুগের এই বর্বর কালো আইনটিকে ধার করেছিলো, পাকিস্তানের দণ্ডবিধিতে ১৯৮২ সালে ২৯৫(খ) এবং ১৯৮৬ সালে ২৯৫(গ) ধারা সংযুক্ত করা হয়েছিলো। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের কিছু প্রয়োগ দেখলে এই আইনের স্বরূপটি মানুষের কাছে উন্মোচিত হবে। সাথে সাথে আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল আইনে আটকদের মামলাগুলোর ধরণের সাথে মিলের জায়গা গুলোও বোঝা যাবে।
১.
১৯৯১ সালের ১০ ডিসেম্বার পাঞ্জাবে পানির কল মেরামত সংক্রান্ত বিষয়ে দুই প্রতিবেশী সাজ্জাদ হোসেন ও গুল মাশীহের ঝগড়া হয়। তাদের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন মুসলান এবং গুল মাশীহ খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী। প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানায় ঝগড়া একসময় মিটমাট হয়ে যেতে দেখেন তারা। এমনকি দুজন শেষ পর্যন্ত করমর্দন করে স্থান ত্যাগ করেন। কিন্তু পরে স্থানীয় ইমামের প্ররোচনায় সাজ্জাদ হোসেন খৃষ্টান গুল মাশীহের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে মামলা করে। তিনি দাবী করেন গুল মাশীহ ঝগড়ার সময় মহানবীকে কটূক্তি করে মন্তব্য করেছে। এই মামলায় তিনজন সাক্ষী ছিলো, একজন ফরিয়াদি সাজ্জাদ হোসেন নিজে অপর দুইজন তাঁর প্রতিবেশী। এই দুই প্রতিবেশীর একজন আদালতকে বলেন, ‘আমার উপস্থিতিতে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি’। আরেকজন বলেন,’গুল মাশীহ নবী সম্পর্কে কোন কটূক্তি করেনি।’
এই অবস্থায় শুধু অভিযোগকারীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আদালত বলে, ‘সাজ্জাদ হোসেন ২১ বছরের একজন যুবক, তার মুখে দাঁড়ি আছে এবং তাকে প্রকৃত মুসলমানের মত দেখায়। ফলে তাকে বিশ্বাস না করার কোন কারণ দেখা যাচ্ছে না।’
১৯৯২ সালের ২ নভেম্বর পাঞ্জাবের সারগোদা সেশন কোর্টে মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষে (যে কিনা ফরিয়াদি নিজে) ৪২ বছর বয়স্ক গুল মাশীহকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত।
২.
১৯৯৩ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি লন্ড্রি কর্মচারী খৃষ্টান ধর্মানুসারি আনোয়ারের সাথে তার মুসলিম বন্ধু মোহাম্মদ আলমের ঝগড়া হয়। দুজনই ধর্ম নিয়ে কটূক্তি ও বাদানুবাদে লিপ্ত হয়। ঘটনা শুনে মৌলবাদী সংগঠন ‘আঞ্জুমান সিপাহি সাহাবা’র নেতা হাজী মোহাম্মদ তৈয়ব ব্লাসফেমি আইনে মামলা করেন। আদালতে আনোয়ার তার অপরাধ স্বীকার করে নেয়, কিন্তু সাথে সাথে এও জানায় মোহাম্মদ আলমও তার ধর্মের যীশু ও মেরীকে উদ্দেশ্য করে অনেক অশ্লীল কথা বলেছে। মুলত আগে তার ধর্মকে গালিগালাজ করার পরেই আনোয়ার ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করে। তাই আনোয়ার মোহাম্মদ আলমেরও বিচার দাবী করে।
আদালত আনোয়ারকে জানায়, ‘ব্লাসফেমি আইনে শুধু মহানবীকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তিকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়। অন্য ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা অন্য ধর্মের ঈশ্বর সম্পর্কে কটূক্তি অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয় না।’
৩.
১৯৯৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের এক কোর্টে ব্লাসফেমি আইনে বিকৃত মস্তিষ্কের আরশাদ জাভেদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে আদালত। রায় শুনে সে আদালত জুড়ে নাচতে শুরু করে। ঘটনা হচ্ছে কয়েক মাস আগে সালমান রুশদি লিখিত স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের বিরোধী ছাত্ররা মিছিল বের করেছিল, সেই মিছিলের সামনে এসে জাভেদ দাবী করে সালমান যা লিখেছে ঠিক লিখেছে। ছাত্ররা তাকে উত্তম মধ্যম করেথানায় সোপর্দ করে। দীর্ঘদিন আটক অবস্থায় তার চিকিৎসা হয় মানসিক হাসপাতালে। সরকার পক্ষের ডাক্তারও তাকে পরীক্ষা করে পাগল ঘোষণা করে।
কিন্তু আদালত বলে, ‘ব্লাসফেমি আইনের কোথাও লেখা নেই যে একজন লোক পাগল হলে সে ধর্ম অবমাননা করতে পারবে।’
আরিফ রহমানঃ লেখক ও ইতিহাস গবেষক