লুৎফুল কবির রনি:
“জীবিতদের চেয়ে মৃতেরা বেশী ফুল পায় কারণ অনুতাপের শক্তি কৃতজ্ঞতার চেয়ে অনেক বেশী।”
— অ্যানা ফ্রাঙ্ক
বাবা অটো ফ্রাঙ্ক অ্যানার ১৩ তম জন্মদিনে একটি লাল-সাদা চেক প্রিন্টের কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট লক লাগানো অটোগ্রাফ খাতা উপহার দেন। বাবার সেই উপহারটি নিশ্চয়ই অ্যানা হাসিমুখে গ্রহণ করে। কিন্তু কে জানে হাসিমাখা এই খাতাতেই লেখা হবে ইতিহাসের ভয়াবহ দিনগুলির কথা? অ্যানার একাকীত্বের কথা, কারো সাথে কথা না বলতে পারার কথা, ইতিহাসের ভয়ংকর দানবীয় রূপ হলোকস্টের কথা। হ্যা অ্যানার বাবার সেই ছোট্ট অটোগ্রাফের খাতা কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে, সারা বিশ্বের সাড়া জাগানো ইতিহাস হয়ে আছে, আছে সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের তালিকায়।
ঘটনা ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত_
হলোকস্টের ভয়াবহতার নির্মম পরিহাস অ্যানা ফ্র্যাংক।
অ্যানালিস মারি ‘অ্যানা’ ফ্র্যাংক জন্ম নেন ১৯২৯ সালের ১২ই জুন। তাঁর জন্ম জার্মানীতে, কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে নেদারল্যান্ডস এর আমস্টারডামে। ১৯৩৩ সালে ফ্র্যাংকের পরিবার আমস্টারডামে চলে যায়। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অ্যানা ছিলেন একজন জার্মান। কিন্তু জার্মানির নাৎসি বাহিনীর সেমিটিক বিদ্বেষী নীতির কারনে ১২ বছরের অ্যানা জার্মানির নাগরিকত্ব হারান। ১৯৩৩ সালে যখন ফ্র্যাংকের পরিবার নেদারল্যান্ডে চলে যায় সেই বছরেই নাৎসিরা ক্ষমতায় চলে আসে এবং ১৯৪০ সালে তারা আমস্টারডাম দখল করে ফলত ইহুদী ফ্র্যাংক পরিবার সেখানে অন্তরীন হয়ে পরেন। ১৯৪২ সালের দিকে নাৎসি বাহিনীর ইহুদী নিধন বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় অ্যানা ফ্রংকের বাবা অটো ফ্র্যাংকের লুকানো কক্ষে অ্যানিকে লুকিয়ে রাখেন। শুরু হয় তাঁর জীবনের কালো অধ্যায়।
আনা ফ্রাংকের পরিবার আমস্টারডামের মৃত্যুকুপে ২৫ মাস লুকিয়ে থেকেও নাৎসীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। ১৯৪৫ সালের মার্চে গ্রেফতারের পর অমানুষিক নিপীড়ন ও নির্যাতনে পরিবারের সদস্যরা একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সেই দিনগুলোর কথা ১৫ বছরের কিশোরী অ্যানা ফ্রাঙ্ক তাঁর ডাইরীতে লিখে যান। মৃত্যুর পর ডাইরী প্রকাশ পেলে নাৎসীদের ভয়াবহ নিপীড়নের চিত্র আবারো বিশ্ববাসীর সামনে ফুঁটে উঠে।
যে জীবনে পাপ পূণ্যের হিসাবের সময় আসেনি, যেই জীবনের সময়টুকু আদর আর মমতায় রাখার মত, সেই জীবনে ইতিহাসের মানুষের সবচেয়ে নির্মম দিনগুলি তার কাঁচা, শুভ্র মনে দেহে আচঁড় কাটতে থাকে। প্রতিদিনকার যন্ত্রণার কথা, রক্তিম অনুভুতির কথা বাবার দেয়া সেই ছোট্ট অটোগ্রাফের খাতায় লিখতে থাকেন পাপমুক্ত ইহুদী এই মেয়েটি। অবশেষে ইশ্বর তাকে জঘন্যভাবে মুক্ত করেন এই নারকীয় জীবন থেকে ১৯৪৪ সালের অ্যানার বয়সের মতই এক সকালে।
অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী আমার কৈশোর মন ছোট্ট অ্যানার চোখ দিয়ে বীভৎসতার যে রুপ দেখিয়েছিল তা আজও আমাকে বিবশ করে ।
প্রশ্ন করেছেন তিনি জগতের বড়দের কাছে- মানুষ কেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে? কচি মনের এত সরল সেই প্রশ্নের উত্তর কি আজো জানা আছে আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের!
১৩ বছরের এক কিশোরী ধর্ম সম্পর্কে কতটুকুই বা জ্ঞান রাখে? মসুলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদীর সে বোঝেই টা কি! শুধুমাত্র ইহুদী ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্মের কারণেই যে তাদের এই নিষ্ঠুর হেনস্তা এটাই তাকে করে তোলে আরও দুঃখী, সংকুচিত। বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের নানা ঘটনা, মাসের পর মাস একঘেয়ে ধুসর জীবনযাত্রা, বনের পশুর মত গুহার গভীরে লুকিয়ে কেবলই ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার চেষ্টার মাঝেও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত উঁকি দিয়ে যায় কৈশোর প্রেম। এভাবেই ছোট ছোট আবেগ মোড়া ঘটনায় ভরে উঠতে থাকে ডায়েরীর পাতা।
জন্মদিনে আমরা তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
অ্যানা আর বড় হয়নি, কখনো বড় হবেও না। সে থাকবে চির তরুণ, শুভ্র আর পবিত্রতার প্রতীক হয়ে।
শুভ জন্মদিন অ্যানা
লুৎফুল কবির রনি: লেখক ও আর্ট ক্রিটিক