বাংলাদেশটা ছোট দেশ। এখানে সবাই সবাইকে চেনে। আর মুশকিল হয়ে যায় সেখানে। লেখালেখি করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের সমালোচনা করতে হয়। এতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্ষতির মুখে পড়ে। তবু সে ঝুঁকি বার বার নিতে হয়। লেখালেখি যখন করি, তখন অপছন্দনীয় হবার ঝুঁকি হাসিমুখেই নিতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপুমণি ছাত্রজীবনে বিতার্কিক ছিলেন। বিতর্ক বিষয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র বানাতে গিয়ে কৃতি বিতার্কিক হিসেবে ডা দীপুমণির ইন্টারভিউ নিতে উনার বশিরুদ্দীন রোডের বাসায় গিয়েছিলাম একবার। রবীন্দ্র ছোট গল্পের স্নিগ্ধ নারীর মতো লেগেছিলো তাকে। বিতর্কের সিনিয়র আপা হিসেবে স্নেহ করেছিলেন অনেক। বিতার্কিক বন্ধু মাছুদ চৌধুরী ইন্টারভিউ করেছিলো দীপু আপাকে। ক্যামেরার কাজ করছিলো বিতার্কিক সুদীপ। দীপু আপা সুতির একটা মেজেন্টা রঙ-এর শাড়ি পরে ছিলেন। নিজের হাতে সুজি-চা বানিয়ে এনে আমাদের আপ্যায়িত করলেন। আগে কোন পরিচয় ছিলো না। কিন্তু বিতার্কিক পরিবার এমনই। পরে প্রামাণ্য চিত্র “দ্য ডি এম্পায়ার”-এর প্রিমিয়ার শো’তে ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারেও এসেছিলেন তিনি।
সেই দীপু আপা যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন, আমাদের বিতার্কিকদের আনন্দের সীমা ছিলো না। উনি বেশি বিদেশ ঘুরছেন, এমন সমালোচনা-কার্টুন প্রকাশিত হতেই আমরা আশাহত হয়েছিলাম। সমালোচনাটা একটু বেশি বেশিই হচ্ছে এমন আক্ষেপও জন্মেছিলো।এরপর উনি শিক্ষামন্ত্রী হলে এবার ‘বিতর্ক’কে স্কুল-কলেজের সিলেবাসে ঢুকানো যাবে; যুক্তিবাদী সমাজ গঠনে; এমন প্রত্যয় জন্মেছিলো। এ বিষয়ে আমার প্রস্তাব, দীপু আপার এলাকার কলেজের অধ্যক্ষ রতন মজুমদারের মাধ্যমে উনাকে জানাতে চেষ্টা করেছি।
রতনদা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই। গান্ধীজী সেই কালে নোয়াখালী সফরে এসে রতনদার দাদার বাড়িতে উঠেছিলেন। এ কারণে রতনদাকে আমি এ যুগের গান্ধীজী বলেই ভাবি। রতনদা দীপু আপার এলাকার একটি কলেজকে মডেল কলেজে রূপান্তর করেছেন। কলেজটি দেখলে আপনার একে শান্তি নিকেতন মনে হবে। রতনদা’র মাধ্যমে দীপু আপার ঔদার্যে বিতর্ককে সিলেবাসে আনার চেষ্টাটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।
সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট উপস্থিত হলে আমি ভেবেছিলাম দীপু আপা সিলেট যাবেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিং করবেন। সেটা সভ্য দেশে সচরাচর হয়। আর আমি যে দীপু আপাকে দেখেছিলাম। উনার পক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝিয়ে শান্ত করা কঠিন কোন কাজ হতো না। করোনাকালীন দুর্যোগে উনার বাসায় কোন গুরুতর সমস্যা থেকে থাকলে তরুণ উপমন্ত্রী নওফেল সিলেটে যেতে পারতেন। মাত্র ৪০ মিনিটেরই তো উড়াল পথ। আর এটা স্বাধীন বাংলাদেশ। ঢাকা তো রাওয়ালপিন্ডি নয়; যে অনশনে অসুস্থ ছাত্রছাত্রীদের ভাওয়ালপিন্ডিতে আসতে হবে ‘আইয়ুব খানের দপ্তর’-এ। তবু প্রযুক্তির সুযোগে জুম বৈঠক হয়েছে এরি মাঝে। কিন্তু সমাধান আসেনি। ইন্টার পারসোন্যাল কম্যুনিকেশানের উষ্ণতা তো আর জুম বৈঠকে থাকে না।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিরসনের এসাইনমেন্টে দীপু আপা ও নওফেল উভয়েই খারাপ ফল করেছেন। উনাদের বাবারা আওয়ামী লীগের সোনালী যুগের নেতা ছিলেন। যে কোন সংকটে তারা ছুটে যেতেন জনমানুষের কাছে। আর সেই সোনালী মানুষের উত্তর প্রজন্ম যদি, “লাঞ্চের পর অফিসে দেখা করো” টাইপের ক্লিশে আমলা-মনোভাব পোষণ করেন; তখন আশংকা জাগে, অমিতাভ বচ্চনের ছেলে অমিতাভ বচ্চন হয় না; হয় অভিষেক বচ্চন।
এখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় সংকটটি ফেলে রেখে রেখে জটিল করে ফেলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এর সমাধান কঠিন হবে। কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আর তারপর হ্যাশট্যাগ ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীর নহরের যে ট্রেন্ড আমরা দেখি; এটা আসলে প্রধানমন্ত্রীর ‘ব্যবস্থাপক’ বাছাইয়ের দুর্বলতাজনিত ভঙ্গুর ব্যবস্থা।ওদিকে অমানবিক ভিসি ফরিদের পক্ষে আওয়ামী লীগের ৩৪ ভিসি ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, মোটর মালিক বা মোটর শ্রমিকদের আদলে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর পুলিশি রক্তাক্ত হামলা, তাদের অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া; এই বিষাদ যমুনা যে ভিসি লীগের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে না; তারা শিক্ষার্থীদের ভালোবাসেন না; কেবল নিজেদের চেয়ার ভালোবাসেন; এটা ভাবতেই বিবমিষা হয়।