মাসকাওয়াথ আহসান
বাংলাদেশে ২ শতাংশ মুসলমান মনে করে অখণ্ড পাকিস্তান ভালো ছিলো; ২ শতাংশ হিন্দু মনে করে অখণ্ড ভারত ভালো ছিলো। এরা আদর্শিকভাবে ১৯৭১ সালের পরাজয় ও ১৯৪৭ সালের পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। যেহেতু এরা সংখ্যায় খুব কম, তাই ২ শতাংশ মুসলমান বিএনপির কোলে বসে হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষ প্রচার করে। ২ শতাংশ হিন্দু আওয়ামী লীগের কোলে বসে মুসলমান ও পাকিস্তান বিদ্বেষ প্রচার করে। সারাদিন এদের কাজ একটাই; তা হচ্ছে বিদ্বেষ প্রচার। ফলে এরা চোখে পড়ে বেশি।
বিএনপি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে ঐ ২ শতাংশ মুসলমান যারা জামায়াত নামে পরিচিত তারা প্রথম রুদ্ররোষের মুখে পড়ে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে ঐ ২ শতাংশ হিন্দু যারা বিজেপির সমর্থক তারা প্রথম রুদ্ররোষের মুখে পড়ে।
যেহেতু ঐ দুই শতাংশ মুসলমান ও হিন্দু ধর্মীয় চিহ্ন যুক্ত পোশাক পরে; ফলে ক্ষমতা পরিবর্তনের ঝড়-ঝাপটায় অন্যান্য ধর্মপ্রাণ -ধর্মীয় পোশাকযুক্ত নিরীহ মানুষও হামলার মুখে পড়ে। কারণ ২ শতাংশ কট্টর মুসলমানের বিদ্বেষ প্রচার ইসলাম ধর্মের প্রতি নেতি তৈরি করে জনসমাজে। একইভাবে ২ শতাংশ কট্টর হিন্দুর বিদ্বেষ প্রচার হিন্দু ধর্মের প্রতি নেতি তৈরি করে জনসমাজে।
ফেসবুকে খেয়াল করবেন, ২ শতাংশ কট্টর মুসলমান এমনভাবে কথা বলে, যেন ইসলাম ধর্ম তাদের বাপের সম্পত্তি; তাদেরকে কে যেন ইসলামি চেতনা শিক্ষা দেবার দায়িত্ব দিয়েছে। আর ২ শতাংশ কট্টর হিন্দু এমনভাবে কথা বলে যেন, বাঙালি সংস্কৃতি তাদের বাপের সম্পত্তি; তাদেরকে কে যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিক্ষা দেবার দায়িত্ব দিয়েছে।
এই ২ শতাংশ কট্টর মুসলমানের ডিএনএ-তে বৃটিশ আমলে হিন্দু জমিদারদের দ্বারা নিঃগৃহীত হবার স্মৃতি আছে। কট্টর ২ শতাংশ হিন্দুর স্মৃতিতে পাকিস্তান আমলে মুসলমান জমিদারদের দ্বারা নিঃগৃহীত হবার স্মৃতি আছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব মানুষের ডিএনএ-তে শাসকদের দ্বারা নিঃগৃহীত হবার স্মৃতি আছে। কিন্তু তারা ঐ তিক্ততার স্মৃতি লালন বা চর্চা করে না। কিন্তু কট্টর ইসলামপন্থী ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী তার ডিএনএ স্মৃতির যাবতীয় তিক্ত স্মৃতি চর্চা করে; ফলে তারা কখনোই ইতিহাসের ট্রমা থেকে বের হতে পারেনা।
ইতিহাসের ট্রমা থেকে বের হতে না পারায় জায়নিস্টদের উস্কানিতে ইজরায়েল রাষ্ট্রটি প্যালেস্টাইনে গণহত্যা শুরু করেছে। এই একই ব্যাপার ঘটেছে কট্টরপন্থী মুসলমান ও কট্টরপন্থী হিন্দুদের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশে বসে কট্টর ইসলামপন্থীরা ভারতের শাসকগোষ্ঠীর আচার-আচরণ দেখে, সমগ্র ভারতকে মূল্যায়ন করে। কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা সেখানকার শাসকদের আচার-আচরণ দেখে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সবচেয়ে খারাপ লোকগুলো ক্ষমতা-কাঠামোতে উঠে আসে; যাদের ডিএনএ-তে রক্তের নেশা।
অথচ ভারত ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পৃথিবীর অন্যান্যদেশের সাধারণ মানুষের মতো। সেখানকার জেন জি’রা হুবহু বাংলাদেশের জেন’জিদের মতো; এইসব ধর্ম বর্ণ গোত্রের পার্থক্য তাদের মনোজগতে নেই। ওদের পৃথিবী আনন্দময় এক পৃথিবী। এরা চিন্তার জগতে এতো এগিয়ে গেছে যে দেশগুলোর ক্ষমতা-কাঠামো তাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে অনেকখানি। এই জেনজি’রাই পাকিস্তানে তৃতীয় রাজনৈতিক দল তেহেরিক-ই-ইনসাফ, ভারতে আম-আদমি পার্টিকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায়িত করেছে। এইদল দুটি দেখবেন কোন রকমের ধর্মীয় বিদ্বেষ চর্চা করে না। এরা এক অর্থে বিশ্বনাগরিক; রাষ্ট্রীয় সীমান্তরেখাকে এরা ইন্টারনেটের ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে।
কেউ যদি একবিংশের পৃথিবীতে সমসাময়িক মানুষ হিসেবে বসবাস করতে চায়; তবে তাকে বিদ্বেষ চর্চার তিক্ত নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি ও বৈষম্য। এই দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই এখন অগ্রাধিকার।
কাজেই শতাব্দী পুরো হিন্দু-মুসলমান কুঁচকুঁচানি থেকে বেরিয়ে মানুষ আত্মপরিচয় উদযাপনই একবিংশের জীবন-চর্যা। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রংপুরে শহীদ সাঈদ আর সিলেটে শহীদ রুদ্রের রক্তের আহবান হচ্ছে ধর্মীয়-সম্প্রীতি।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।