মাসকাওয়াথ আহসান
বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচণ্ড গরম নিয়ে গরম আলোচনা হচ্ছে। উল্লেখ্য যে এশিয়ায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমারে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কট্টর হিন্দুত্ববাদ। গুজরাটের মোদির গরমেই গরম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ও মায়ানমার। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক নরেন্দ্র মোদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক থেকে দুর্বল মানুষ। সুতরাং তার কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা হচ্ছে; ইতিহাস নতুন করে লেখা, জায়গার নাম বদলে দেয়া, নাগরিক আইনে সংশোধনী এনে সংখ্যালঘু মুসলমানের জীবন রাষ্ট্রহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া আর বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা। প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোকে গদি মিডিয়া বানিয়ে সত্য লুকিয়ে রাখা; রাষ্ট্রীয় টিভি দূর দর্শনের লোগোর রঙ স্যাফরন করে “হিন্দু ভারত” উদয়ের ঝাণ্ডা ওড়ানো। গত দুটি টার্মে এইসব পরাবাস্তব কাজ নিয়ে ব্যস্ত যে শাসক; সে শাসকের নিজের ও তার ভক্তদের গরমে পুরো ভারত গরম হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। ভারতের পরিবেশ বিপর্যয়ের বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানের যোগ্য অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানী সেখানে রয়েছেন। তাই আমি তীব্র গরমের সমাজ-রাজনৈতিক কারণগুলো উল্লেখ করলাম। মোদির শাসনকালে পরিবেশবিনাশী প্রকল্প নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করায় অন্তত ১৩ জন পরিবেশ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
মোদির গরমে বাংলাদেশে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী করেছে যারা; তাদের নিরংকুশ ক্ষমতার গরম, দেশ ডাকাতির টাকার গরম,অশিক্ষিতের উন্নয়ন ভাবনার গরম, বিদূষক বুদ্ধিজীবীদের প্লট-পদক-পদবীর গরম, ঢাকা উত্তরের হিট অফিসারের বাবার গরম, দক্ষিণের সুযোগ্য ভাগ্নের গাছ কাটার গরম; হেলমেট বাহিনী থেকে পুলিশ ও প্রশাসক হবার গরম, মাত্র পনেরো বছরে বন ও নদী খেয়ে কুঁড়ে ঘর থেকে প্রাসাদে উঠে আসার গরম, গরুর গাড়ি থেকে মার্সিডিজে ওঠার গরম, পান্তা থেকে পাস্তা খাওয়ার গরম; তালপাখা থুয়ে এসি ব্যবহারের গরম, টাইম মেশিন মেথডে ইতিহাসের দোহাই দেবার গরম; সমস্ত অন্যায় ও অপশাসনের নির্লজ্জ জাস্টিফিকেশন দেবার গরম; কমনসেন্স না থাকার গরম, দেশপ্রেমের বদির ভাইয়ের কোটের গরম, ধর্মপ্রেমের খাসজমি-গাছকাটা ও দাড়ি টুপির গরম আর মোদির ভাইদের স্যাফরনের গরম; এখনো যে দেশটা গরমে গলে যায়নি সেই তো রক্ষা।
ইউরোপের কল্যাণরাষ্ট্রগুলো প্রতিটি শহরের ২৫ শতাংশ বনভূমি বা সবুজ থাকবে এটা নিশ্চিত করে। পরিবেশ বান্ধব সবুজ সুশাসন প্রচলিত সেখানে। আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে চলছে সবুজ বনায়ন, উন্নয়নের লীলাভূমি চীনের নজর আছে বনায়নে; আর কে যেন শ্রীখণ্ডের অর্ধশিক্ষিত উন্নয়ন বীরদের শিখিয়েছে, গ্রাম গুলোকে শহর করে তোলো, কংক্রিটে ছেয়ে দেয়াই উন্নয়ন। ফলে চোরের খনির চাটার দলের পাঁচ তলা দালানে ছেয়ে গেছে গ্রামগুলো। আর ইচ্ছামত বনভূমি ও নদী খাও, ফসলি জমির বুক কেটে রাস্তা বানাও, হাওরের বুক কেটে রাস্তা বানাও; বাপের দেশ-এটাকে নিয়ে যা খুশি করো ফেল করা বুদ্ধির দাম্ভিকতায়।
সভ্যতা এতো সহজ নয়। দেশ ডাকাতির টেকাটুকায় সবুজ লুঙ্গি খুলে কোট টাই পরে ঘুরলে; আর দাঁত পাড় শাড়ি খুলে জামদানি পরে ঘুরলেই সভ্যতার আলো এসে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। মাথার খুলি ঘরে থুয়ে এ ওর গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের তাবাররক বিতরণ করলেই রাতারাতি কেউ সভ্য হয়না; প্রাণ ও প্রকৃতির গুরুত্ব বুঝতে শেখে না।
এক বুড়ি ছিলো, বর্ষাকাল এলেই তার মনে পড়তো ঘরের চালে অনেক ছিদ্র; চাল মেরামত করতে হবে। আমাদের উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়া লাগিছেরও ঠিক তাই। কোথাও আগুন লাগলে কদিন আগুন নেভানোর থিয়েটার শেখো, সড়ক দুর্ঘটনা হলে, মুখে বাঁশি পুরে মানববন্ধন করো, আর গরম পড়লে সেটা ঋতু যাই হোক; ফেসবুকে গাছ লাগাও।
ইউরোপে যখন কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি; তখন চার্চে উপায়হীন মানুষের ঢল নামতো। আরব বিশ্ব যখন সমৃদ্ধ ছিলো না; তখন মসজিদে অসহায় মানুষের ঢল নামতো।
সুতরাং অকল্যাণ রাষ্ট্রের উপায়হীন মানুষ মন্দির ও মসজিদে থই থই করবে সেটাই স্বাভাবিক। যার কেউ নেই; তার আশ্রয় তো মন্দির ও মসজিদ হতে বাধ্য। প্রজাদরদী শাসক না থাকলে বর্তমানের নরক ও দোজখ যন্ত্রণায় বসে জনমানুষ স্বর্গের ও বেহেশতের স্বপ্ন দেখাটাই স্বাভাবিক।
যেদেশে সবুজ সুশাসন নেই; সেখানে মানুষ খোদার কাছে বৃষ্টির প্রার্থনা করবে সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু হ্যাভস নটের ছেলে জিনস-টিশার্ট পরলে আর মোদি প্রগতিশীলতার দীক্ষা পেলে; সে ক্ষমতা-কাঠামোর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো উন্নয়নের অভিশাপ নিয়ে একটি কথা না বলে লেগে যায় বৃষ্টির জন্য নামাজের সমালোচনায়। এসিতে বসে শিং ঘষতে থাকে, এইসব ধর্মীয় সংস্কারের কী করি; এদেরকে কে বিজ্ঞান শিক্ষা দেবে!
সাহস থাকলে ক্ষমতার বাপ-মায়েদের বিজ্ঞান শিক্ষা দাও গিয়ে হে তেলাঞ্জলির আসরের ভাঁড় সোশাল ক্লাইম্বারগণ। উপায়হীন ছোটখাট মানুষকে তার বিশ্বাসের হাত ধরে নরক যন্ত্রণা সহনীয় করতে দাও। ডিএনএ-এর স্মৃতি খুঁড়ে দেখো, তোমার হ্যাভস নট দাদাও “আল্লা মেঘ দে পানি দে” গেয়েছে; তোমার দাদিও ব্যাঙ্গের বিয়ে দিয়েছে বৃষ্টির প্রার্থনায়। তুমি দুইদিনের হ্যাভ এসেছো হ্যাভস নটদের উপহাস করে বড্ড সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।