মাসকাওয়াথ আহসান
আমার আব্বা দর্শনের শিক্ষক বলে শৈশব থেকে ধর্মকে দর্শন হিসেবে দেখতে শিখিয়েছেন। ইসলাম ধর্মকে প্রথম জেনেছি মুসলিম দর্শন পড়ে। ভারতীয় দর্শনের মাঝ দিয়ে চিনেছি হিন্দু ধর্মকে। আর আম্মা বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন বলে, বিষাদসিন্ধু, মেঘনাদ বধ কাব্য অনেকটা মুখে মুখে বলতেন আমাকে। এরপর আব্বা ডারউইনের বিবর্তনবাদ শিখিয়েছিলেন খাতায় ছবি এঁকে। দিয়েছেন পাশ্চাত্য দর্শনের পাঠ। ক্লাস সিক্স থেকে সেভেন; এই দুই বছরে আমাকে ধর্মকে দর্শনের আঙ্গিকে বোঝার সব রসদ সরবরাহ করেছেন আব্বা-আম্মা।
ওদিকে জীবন চর্যায় আম্মার শৈশবের বন্ধুরা অনেকেই হিন্দু ধর্মের হওয়ায়; আব্বার শৈশবের বন্ধুরা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্ট ধর্মের হওয়ায়; তাদের সামাজিক মেলামেশার আবহে ধর্ম-গোত্রের পার্থক্য বিলীন হয়ে যায় আমার জীবনে।
নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মন্দিরে ঢুকে গান শুনেছি; আশ্রমের ক্ষ্যাপা বাবা আম্মার স্কুলমেট ছিলেন বলে; আমার জন্য একটু বাড়তি গান, বাড়তি মিষ্টান্নের ব্যবস্থা হতো সেখানে।
নানা ছিলেন সুফি চিন্তার মানুষ। এক লোক তাকে তার জীবন দর্শন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাকে সহজ করে বোঝাচ্ছিলেন, আমি শরিয়তী লাইনের লোক নইরে বাবা আমি মারেফাতের লোক।
দাদা ছিলেন সংশয়বাদী। তিনি ছিলেন আমার নানার সিনেমা গোয়িং ফ্রেন্ড। কলকাতায় সিনেমা হান্টিং আর আড্ডা দেয়ার মাঝ দিয়েই তাদের ছেলে-মেয়ের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিলো। তারা তদের বন্ধুত্বটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়। বিয়ের সময় দাদা আমার আম্মাকে শর্ত দিয়েছিলেন দুটি, মাস্টার্স পর্যন্ত পড়তে হবে আর বোরখা পরা যাবে না। নানা হেসে বলেছিলেন, চিন্তা করবেন না, বোরখার ট্র্যাডিশন আমাদের পরিবারেও নেই।
আম্মার দাদি ছিলেন ফার্সি পণ্ডিতের মেয়ে। তিনি পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কিন্তু গ্রামাফোন শোনা কিংবা দার্জিলিং-এ চাবাগানে বোনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া; কিংবা বোন বেড়াতে এলে পদ্মা নদীতে সপরিবারে পিকনিক করতেও পিছিয়ে থাকেননি কখনো। আম্মার লাইফ স্টাইল হুবহু তার দাদির মতোই। আম্মা পাঁচওয়াক্ত নামাজের অনুশীলন কখনো ছাড়েননি। আবার কাব্য চর্চাতেও আনন্দ খুঁজেছেন তিনি।
আব্বা দর্শনের শিক্ষক বলে আর দাদার প্রভাবে সংশয়বাদী ছিলেন। কিন্তু অবসর নেয়ার পর জীবনের রুটিনটাকে আঁটোসাটো রাখতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন। নামাজের সময় সুরা প্রথমে আরবিতে পড়েছেন; এরপর সেটা অনুবাদ করে পড়তেন। আর ঈশ্বরদী কলেজের মসজিদের ঈমাম নিয়োগের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হওয়ায়;’ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে একজন উচ্চশিক্ষিত ইমাম সাহেবকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ফলে মসজিদের নামাজের ফাঁকে ফাঁকে মুসলিম দর্শন আলোচনার একজন বন্ধু ছিলো তার।
আব্বার মহাভারত ও রামায়ণ মুখস্থ ছিলো। গীতা, বাইবেল, তাওরাত পাঠ করেছিলেন ছাত্রজীবনে। বুদ্ধের দর্শনের কথা তার মুখে মুখে শুনেছি। মুহাম্মদের সাম্যভাবনা সম্পর্কে ছোট বেলাতেই তিনি পাঠ দিয়েছিলেন আমায়। তুলনামূলক ধর্ম-দর্শনে তার আগ্রহ ছিলো জীবন ব্যাপী।
আর ছিলো আমাদের সিনে লাইফ। আম্মা সঙ্গে করে ঈশ্বরদীর প্লাজা সিনেমায় নিয়ে গিয়ে সোনালী যুগের ঢাকার চলচ্চিত্র দেখাতেন। আব্বা প্রত্যেক সাঁঝে আনতেন একটা উত্তম-সুচিত্রা-সুপ্রিয়ার চলচ্চিত্র। ফলে কলকাতার সোনালী যুগের চলচ্চিত্র সবই দেখা হয়ে যায়।
এই শৈশব কৈশোরের পাটাতনে দাঁড়িয়ে এরপর জীবনকে এক্সপ্লোর করতে থাকি। ঢাকায় এসেই প্রথম ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে বুদ্ধদেব বসুর “রাবণ” কিংবা ” প্রথম পার্থ” থিয়েটার করতে গিয়ে এক ম্যাডামের রোষানলে পড়ে যাই। তিনি আমাকে ভারতীয় সংস্কৃতির আমদানিকারক হিসেবে তকমা দিয়ে পরীক্ষায় ভাইভা ও ইনকোর্সে আন্ডার মার্কিং করেন।
এটাকে পাত্তা না দিয়ে বিতর্ক আন্দোলন করতে থাকি। ছোট বেলায় পড়া তুলনামূলক ধর্ম-দর্শন জ্ঞানের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে কয়েক বছর গবেষণা করে লিখে ফেলি বিতর্কের ইতিহাস গ্রন্থ, বিতর্কের ধ্রুপদী উতস। এই গ্রন্থের গবেষণার প্রয়োজনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে রামকৃষ্ণ মিশন কোথায় যাইনি! এ ছিলো জীবনের বিরাট এক অভিজ্ঞতা।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির গুরু দুয়ারা নানকের মন্দিরে গিয়ে মাঝে মাঝে গল্প করতাম; মধ্যহ্ন ভোজ করতাম।
সরকারি চাকরিতে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের এসাইনমেন্ট পেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্যাগোডায় গিয়ে বনভান্তেদের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পেয়ে যাই।
সরকারি চাকরির শেষ দিকে লিয়েন আবেদন করলে, আমি রেডিওতে ধর্ম-দলের বাইরে কেবল গায়কীর দক্ষতার ভিত্তিতে সংগীত-শিল্পীদের অডিশন আয়োজন করায়; যেখানে প্রার্থীর কেবল একটি নম্বর ছিলো। তারা গান গেয়েছিলো তিনতলার স্টুডিওতে; আর বিচারকরা সেই গান শুনে শিল্পী বাছাই করেছিলেন একতলার স্টুডিওতে; এই কর্মযজ্ঞটির জন্য একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা (জাসাস নেতা) আমাকে হাফ হিন্দু তকমা দিয়েছিলেন। হাইব্রিড বিএনপির কেউ কেউ ভারতপন্থীর তকমা দিয়ে সেসময় পিছে লেগেছিলো। কিন্তু আমি সারাজীবন সবার সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশেছি; ফলে ক্ষমতাকাঠামোতে ও প্রশাসনের নানা জায়গায় আমার বন্ধুরা; তাই আমাকে শিকার করা কঠিনই নয়; অসম্ভব।
পশ্চিমে গিয়ে চার্চে যেতে শুরু করি পিয়ানোবাদক ডয়চেভেলে বস ড ফ্রিডেমান শ্লেণ্ডারের সঙ্গে। সিনাগগে যাই ইহুদি এক বান্ধবীর সঙ্গে; গল্প হয় রাবাই-এর সঙ্গে। ডয়চেভেলে ছিলো ৩১ টি ভাষার আর নানা ধর্ম-গোত্রের মানুষের মিলনমেলা।
ঈশ্বরদীর মসজিদের ইমাম, আড়ানির মন্দিরের পুরোহিত, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্যাগোডার বনভান্তে, ঢাকার গুরুদুয়ারার নানক অনুসারী, বন-কোলনের চার্চের ফাদার, সিনাগগের রাবাই; সবার মাঝে এক একজন আলোর মানুষের দেখা পাই।
ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের জগতের লিবেরেলরা অনেকেই সংশয়বাদী; কিন্তু কক্ষণো ধর্ম সম্পর্কে অশ্লীল কোন কথা তাদের বলতে শুনিনি। ইরাক যুদ্ধের সময় তারা মোমবাতি নিয়ে পথমিছিল করেছে; মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থেকেছে তারা।
এরপর ফেসবুক জগতে এসে দেখা পেলাম বাংলাদেশের কিছু নিওলিবেরেল, কট্টর ইসলামপন্থী ও কট্টর হিন্দুত্ববাদীর। পৃথিবীটা এতো কুতসিত হতে পারে তা আবিষ্কার করলাম ২০১০ সালে। এক কট্টর হিন্দুত্ববাদি লেখক সাইবার বুলি করলো, কর্মোপলক্ষ্যে করাচিতে থাকি বলে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির তকমা পেতে হলো বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের হাইব্রিড একজন কথিত কপি পেস্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষকের কাছে। এরমধ্যে কট্টর ইসলামপন্থীরা শাহবাগী বলে তকমা দিয়ে যেতে থাকে অবিরাম।
২০১৬ সালে ঢাকা একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত উপন্যাস “প্যাসেজ টু হেভেন” উপন্যাসে এদের নিখুঁত চরিত্র চিত্রণের চেষ্টা করেছি। রম্যের ছলে ওদের অমর করে রেখে দিলাম।
করাচিতে উচ্চশিক্ষিত লিবেরেলদের মাঝে দেখলাম বাংলাদেশের সংগীতের অন্ধ ভক্ত, রবীন্দ্র চর্চা, ধর্ম নিরপেক্ষতার অনুশীলন, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যার জন্য গভীর অনুতাপ। শাহরিয়ার কবির ভাই করাচিতে এলে উনার অনুরোধে “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” গঠনের জন্য প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। লিবেরেল বন্ধুরা সবাই সেখানে এসেছিলো; গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়াগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে কাভার করেছিলো সে অনুষ্ঠান। একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও পাইনি করাচির জনপ্রিয় রেডিও চ্যানেলে বাংলা বৈঠকে “মানবতা বিরোধীদের বিচার নিয়ে” বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত নানাজনের ইন্টারভিউ প্রচার করি। শ্রোতারা ফোন ইন প্রতিক্রিয়ায় বলতো, বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানেও যদি কট্টর সন্ত্রাসবাদি অপরাধীগুলোকে শাস্তি দেয়া যেতো। এরপর বাংলাদেশকে অনুসরণ করে পাকিস্তানে স্পেশাল ট্রাইবুনালে কট্টর অপরাধীদের দ্রুতবিচারে শাস্তি দিতে দেখেছি। এতে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
এরপরেই কলকাতার প্রথম ভার্চুয়াল সাহিত্য আসর” উপস্থাপনা করলাম আয়োজক বন্ধুদের আমন্ত্রণে। কলকাতায় রম্যগ্রন্থ “খাজাঞ্চির খাতা” প্রকাশ হলো; বেশ বিক্রি হলো; অনেক বন্ধু জুটলো; যাদের আগ্রহ পাকিস্তানের সংস্কৃতি-সঙ্গীত-কবিতা-থিয়েটার-চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানার। তাদের আগ্রহেই কিছু গ্রন্থ লিখতে হবে সামনে।
আমার পুরোজীবনে ভূমিবাস্তবতায় ঈশ্বরদী-রাজশাহী-ঢাকা-কোলন-বন-কলকাতা-করাচিতে; বিভিন্ন দেশ ও শহর পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ফেসবুকের মতো এরকম কুঁচকুচানি প্রগতিশীল, কট্টর ইসলামপন্থী ও কট্টর হিন্দুত্ববাদীর মুখোমুখি হইনি। পশ্চিমের জীবন যাপনের অভিজ্ঞতায় কক্ষণো রেসিজমের স্বীকার হইনি।
আমার ধারণা অত্যন্ত দুর্বল আর তিক্ত শৈশবের কিছু লোক; প্রস্তুতিহীন লিবেরেল, ইসলামপন্থী বা হিন্দুত্ববাদী হয়ে সভ্য জগতের পাতে পড়ে বিস্বাদ ছাইয়ের মতো বিরাজ করছে। এদের প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। দুঃখ হয় এদের আপ্রাণ কিছু একটা হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা দেখে। অথচ হঠাত করে কিছু হয়না। শৈশব থেকে ফুটবল-ক্রিকেট-ডিবেট অনুশীলন না করলে যেমন ভালো করা যায়না; জীবনটাও ঠিক তাই। এখানে হঠাত করে প্রগতিশীল হওয়া অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে; এইসব সুডো প্রগতিশীল ও স্বঘোষিত ধর্মের ম্যানেজারেরা “চোখের বদলে চোখ” করতে করতে দলান্ধ ও জন্মান্ধ হয়ে গেছে। অন্ধ দৈত্যের মতো শিং ঘষে এরা ফেসবুকের দেয়ালে। লেট দেয়ার বি লাইট।
আর আমরা বরং জগতময় আনন্দভ্রমণ করতে থাকি সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের খোঁজে।
( তুরস্কের কনিয়ে শহরে কবি জালালুদ্দীন রুমীর সমাধি সংলগ্ন জাদুঘরে তাঁর কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।