অলাত এহসান
১.
“যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
নিরাশার পাখি দু হাত বাড়ায়
খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোন
কি আর করে তখন
স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন দেখে মন॥”
নচিকেতা চক্রবর্তীর এই রোমান্টিক গানের একটা ভিন্ন অর্থ আমার মনে তৈরি হয় কখনো। মানে, যখন দেশে ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকে লেখকরা ‘কি আর করে তখন?’
উত্তর হতে পারে— লেখকরা তখন রূপকের আশ্রয়ে নিয়ে লেখেন। শওকত ওসমানের ‘কৃতদাশের হাসি’ উপন্যাসের কথা তো মনেই আছে সবার।
তারও আগে যেমনটি করেছিলেন সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কৃতদাশ স্বভাব গল্পকার ঈশব। একইভাবে বিংশ শতকের শুরুতে লাতিন দেশ উরুগুয়েতে স্বৈরশাসক যখন জেঁকে বসেছিল, তখন কথাসাহিত্যিক ওরাসিও কিরোগা (Horacio Quiroga) পশুপাখি, মাছ-ব্যাঙ নিয়ে গল্প লিখে দেখিয়েছেন নৃশংসতা।
দেশের রাজনীতিক-সাহিত্যিকরা যখন চিহ্নিত করেছেন— তারা স্বৈরশাসনের নিচে আছে, সরাসরি কথা-লেখা যাবে না, তখন খুবই সম্ভব ছিল রূপকাশ্রী গল্প-কথা উত্থান ঘটা। কিন্তু সেটা ঘটেনি তাদের দূরাজ্ঞেগ দুর্বলতা ও অনিহার আলস্যের কারণেই হয়তো। সেই শূন্যতার খানিকটা পূরণ করেছে আমাদের রম্য সাহিত্য। অথচ আক্ষেপের বিষয় হলো— সেই মহামহিম কথাসাহিত্যিকদের দরবারে এই রম্যের সম্মানজনক প্রবেশ অনেক সময়ই রোহিত থাকে! অবশ্য বিদ্বোৎসাহীরা বলেন, রূপকে গল্প লেখাটা শক্তিমান ও রসবোধ সম্পন্ন লেখকের পক্ষেই সম্ভব!
২.
নন্দনতত্ত্বিকরা বহু দিন আগেই মীমাংসা করে ফেলেছেন যে, সাহিত্যের আদি ও মহত্তম উৎসগুলোর মধ্যে ট্রাজেডি অন্যতম। ট্রাজেডি আর কমেডির মিল হলো— দুয়ের মূল সুর বেদনার, পার্থক্য শুধু মাত্রার তারতম্যের। সাহিত্যের ফর্ম (ধরন) হিসেবে কমেডির সূচনা ট্রাজেডির অনেক পরে হলেও সমাজের এটা এতটা জরুরি হয়ে উঠেছিল যে, পরে ‘ট্রাজেডিক কমেডি’ নামে পূর্ণাঙ্গ রূপই তৈরি হয়েছে। রোমান যুগে গ্রিক দেশে সেটা দেখা গেছে। সমাজের কদর্যতা ধরিয়ে দিতে, বিচারের অচল ঘোডা সচল করতে কমেডির গুরুত্ব। অনেকে এটাকে বাংলার যাত্রা শিল্পের বিবেকের ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করেন।
তবে রম্য বলতে বাংলাসাহিত্যে আমরা যা পাই, সেটা গ্রিক কমেডির ধাঁচ থেকে বেরিয়ে হাঁস্যরসে অনেক বেশি যাত্রার বিবেকের ভূমিকার সঙ্গেই মিলবে। বিশ্বে যেমন রাষ্ট্রসংঘে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি রাজনীতি ঘনীভূত হয়েছে, রম্যেও তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ সুস্পষ্ট হয়েছে।
ফলে ভাঁড় পোষা রাজদরবারের বিপরীতে এখন রাম্য লেখক, কার্টুনিস্টদের অনেক বেশি ভয় পায়, আর অন্তর্গত দূর্বলতা থেকেই নির্যাতন করে। সংগীতে র্যাপারদের এর আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।
সদ্য পতিত আওয়ামী আমলে কারাগারে লেখকের মৃত্যু, কার্টুনিস্ট ও র্যাপারদের নির্যাতনের কথা মনে পড়ছে নিশ্চয়ই?
৩.
কথাসাহিত্যের অপরাপর ধারার মতো রম্যও গল্প ও গদ্য ভাগ হয়ে গেছে। আবার সেই সাহিত্যেও ভাগ আছে দুটি। প্রখ্যাত রম্য লেখক আবদুশ শাকুরের ভাষায়— এক. যে লেখকেরা গভীর জীবনবোধকে উদ্ঘাটন করার পথে হাস্যকৌতুকের সজীব ছোঁয়ায় রচনাকে স্নিগ্ধ করেছেন; দুই. যারা কেবলমাত্র কৌতুক-রসেরই কারবার করেছেন।
আমার আলোচনার দুজনই কথাসাহিত্যের মানুষ, তবে রম্যে এসে — গল্প ও গদ্যে ভাগ হয়ে গেলেন। তারা হলেন মাসকাওয়াথ আহসান ও তাপস রায়। তাঁদের লেখায় মনোযোগী পাঠক মাত্রই লক্ষ্য করবেন— গল্প যেখানে হাস্যরসের অতলে বিরূপ শাসন-সমাজকে বিদ্রুপ করে, গদ্য সেখানে সরাসরি চাবুক পেটা করতে কসুর করে না। ফলে বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন স্বৈরশাসক কোনোভাবেই তা সাদরে নিতে পারবে!
মাসকাওয়াথ আহসানকে লোকে চিনেছিল তাঁর ‘বিষন্নতার শহরে’ গল্পগ্রন্থের কারণে। শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন জাহাঙ্গীর, হাসনাত আবদুল হাই ভেঙে পড়েছিলেন বইটির প্রশংসায়। (পরে ‘মৃত্যুর শহর’, ‘আকাঙ্ক্ষার শহর’ও লিখেছিলেন)। অ্যাকাডেমিক জীবনে মেধাবী মানুষটি যে সাহিত্যে এতটা নৈবেদ্য দিবেন, তা কে ভেবেছিল! বইমেলায় জ্ঞানকোষ প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক রম্যগদ্যের বই ‘স্যাটারিক ভার্সেস : ফ্যাসিবাদ বিরোধী রম্য’।
সাম্প্রতিক পুরো আন্দোলন জুড়ে বা তারও অনেক আগে থেকে তাঁর রম্যগুলো আমাদের মানবিক বিবেচনাবোধ জাগিয়ে তুলেছে, অবিবেকি আচরণের বিরুদ্ধে লেখা রম্য গদ্যে। বইটি তারই সংকলন।
রম্য বলতে যারা হালকা করে নিতে চাইবেন তাদের জন্য প্রনিধান যোগ হতে পারে তরুণ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন শফিক বক্তব্য। লেখাগুলোর তীব্রভাব বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন— ‘হয়তো তিনি দেশে থাকলে জেলেই থাকতেন, বা গুম করে রাখা হতো আয়নাঘরে।’ সে হিসেবে বইটা সময়ের রম্য দলিলও বলা যাবে হয়তো।
৪.
তাপস রায়ের খ্যাতি ছড়িয়েছে বিখ্যাতদের নিয়ে লেখা ‘রসিক’ সিরিজের কারণে। রম্য লেখার প্রতি উন্নাসিকতা না থাকলে, কৌতুহলী পাঠকের জানার কথা— তাঁর অনেক লেখাই নিপাট ছোটগল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন হতে পারে। তাঁর সর্বশেষ রম্যগল্প সংকলন ‘হই হই হাসির গল্প’ প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ বা এসব গল্পে যারা কিশোর রম্যের আমেজ খুঁজবে, তাদের মনে করিয়ে দেয়া যায় তাঁর ‘এই বেশ আতঙ্কে আছি’ বইটার কথা। যখন দেশের বহু লেখক বিগত সরকারের গুণকীর্তনে মগ্ন থেকে ভুলেই গিয়েছিলেন লেখকের জরুরি কাজ; হুঁশ ফেরেনি যে— সেই শাসন ব্যবস্থা রাজনৈতিক দেউলিয়া প্রদর্শনের সঙ্গে নিজ দলের মতো দেশের কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে যাচ্ছে। তখন ওই বই বের করা, লেখকি দায়িত্বের সঙ্গে নিজেকে ঝুঁকি নিয়ে আসার মতো সত্যের প্রকাশ যেন। ‘হই হই গল্প’ দেখায়, রাষ্ট্রের সমস্যার মতো জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভেতরও গলদ রয়ে গেছে নিটোল আমোদের অভাবের মধ্যে।
ফ্যাসিবাদের শেষ দিনগুলোতে সবখানেই রাজনীতিকদের মধ্যে ভাড়ামো বেড়ে যায়। এর রাজনৈতিক অর্থ হলো, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকে আড়াল করে নাগরিক বা জনগণকে আমুদে খোসগল্পে মত্ত রাখা। তবে রাষ্ট্র যখন নিজেই ‘জোকারি’ করে, তখন শাসন যে আরো নির্মম হয়, তা বলাই বাহুল্য। তখন রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতাকে নির্দেশ করে এমন কথাসাহিত্য তো বটেই, রম্য লেখকেরও ঢেঁকুর আটকে যায় বন্দুকের নলের ডগায়। সেই সময়েও মাসকাওয়াথ আহসান ও তাপস রায় যে আমাদের দারুণ, সাহিত্যিক রম্য শুনিয়েছেন, তার জন্য ধন্যবাদ দিতেই হয়।
অলাত এহসান, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।