লুৎফুল কবির রনি
দিল্লীর ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকা
“হোয়াই আই এম এ হিন্দু?” (কেন আমি হিন্দু) বিষয়ক সংখ্যার অংশ হিসেবে ব্রাহ্ম সন্তান সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নেয়।
সত্যজিৎ রায় উত্তর দিয়েছিলেন –
“ আমি জানিনা আমি হিন্দু কি না, আমি জানি আমি বাঙালী।”
“যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তাকে আমি মানি না! ধর্ম এটা করে আর অর্গানাইজড ধর্ম তো করেই।”
~ আগন্তুক
সত্যজিত রায়
১৯২১ সালের ২ রা মে বিখ্যাত রায় পরিবারে জন্ম নেন বাংলা তথা বিশ্ব চলচিত্রের কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়। মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতা সুকুমার রায়কে হারানো সত্যজিৎ কে তাঁর মাতা সুপ্রভা দেবী নিজের আদর্শে বড় করে তোলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে শিল্পকলার পাঠ নিতে যান। বিদেশী শিল্পকলায় মুগ্ধ সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে প্রথমবার ভারতীয় শিল্পকলার সান্নিধ্যে আসেন। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনের চারপাশের গ্রাম্য মানুষের জীবনের সংস্পর্শে আসেন ও ধীরে ধীরে ভারতীয় শিল্পের গুনগ্রাহী হয়ে পড়েন। শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখার্জী তাঁর জীবনে গভীর ছাপ ফেলেন। ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর শিক্ষকের জীবন নিয়ে “The Inner Eye” নামের একটি তথ্যচিত্রও বানান।
১৯৬৫ সালের দিকে বাংলা মদ খাওয়া ধরলেন ঋত্বিক ঘটক এমনকি গোসল ও অনিয়মিত । তাঁর এমন জীবনযাত্রায় ফলে তার স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে বাবার বাড়ি চলে যান ।
এক রাতে ঋত্বিক বাড়ি ফিরছেন , ঠিক হেঁটে ফেরার অবস্থায় নেই তখন । নেমে যাওয়ার সময় ড্রাইভার ভাড়া চাইল ।
আমার কাছে ভাড়া নেই। তুমি এক কাজ করো , এখান থেকে ১/১ বিসপ লেফ্রয় রোডে চলে যাও । সেখানে গিয়ে যে লোকটা দরজা খুলবে তার কাছে বলবে ঋত্বিক ঘটকের কাছে টাকা ছিল না , সে ট্যাক্সি করে ফিরেছে বাড়ি । ও টাকা দিয়ে দিবে ।
সেই দীর্ঘকায় লোকটি যা শোনা যায় , সেবার , বারবার তার ভাড়া মিটিয়েছেন । ঋত্বিক তাকে উত্যক্ত করতেন , কিন্তু সেই ভদ্রলোক মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন , ভারতবর্ষে ঠিকঠাক ক্যামেরা বসাতে জানে সেই মাতাল লোকটিই । অবশ্য যোগ করতেন , আমিও কিছুটা জানি। লোকটি আর কেউ নন! আমাদের সত্যজিৎ রায়।
যোগ্যকে সম্মান করার এমন নিদর্শন বড্ড বিরল!
প্লেনের ভেঙে পড়া ধ্বংসাবশেষ পেরিয়ে যে মেয়েটি হাঁটছিল; বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শ্মশানের থমথমে শান্তিতে সে রচনা করছিল এক অসহায়তার আখ্যান। যে অসহায়তা লড়াইতে পরিণত হয় না, শুধু বঁটির ধারালো আঘাতে খানিক রক্ত ছিটকে পড়ে সভ্যতার ওপর! সীতা, অর্থাৎ সেই মেয়েটিকে বীভৎস মজার শহর উপহার দেয় মর্মান্তিক আত্মহনন। আর আরতিকে সেই শহরই ফিরিয়ে দেয় কাঠিন্য, প্রত্যাখ্যান, পারিবারিক নিগড়।
সত্যজিৎ রায় নির্দেশিত ‘মহানগর’- এভাবেই বলেছেন জীবন আর নগরের কথা।
“আমি অনুভব করি যে নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁদের আধা অন্ধকার, অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।”
– সত্যজিৎ রায়
বালক বয়সে সত্যজিতের জীবনে এক মজার ঘটনা ঘটে। যখন তাঁর দশ বছর বয়স তখন পৌষমেলা দেখার জন্য মাকে সঙ্গে নিয়ে একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। তখন সবে অটোগ্রাফের খাতা কিনেছেন তিনি। তখনও পর্যন্ত কারও অটোগ্রাফ সংগ্রহ করা হয়নি। তাই সত্যজিতের অভিপ্রায় ছিল এই খাতার প্রথম অটোগ্রাফটি যেন হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
এ কারণে মাকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন কিশোর সত্যজিৎ। এক সকালে মায়ের সঙ্গে হাজির হলেন উত্তরায়ণে। পারিবারিকভাবে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক ছিল। সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন কবিগুরুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। এছাড়া তাঁর পিতা সুকুমার রায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। সুকুমার রায় সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকার একজন একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর কাছে মানিক নামেই পরিচিত ছিল সত্যজিৎ। কবির সামনে কিশোর মানিক তাঁর অটোগ্রাফ খাতা এগিয়ে দেন।
কবি তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকানোর পর স্নেহে বললেন, ‘এই খাতাটা আমার কাছে থাক; কাল সকালে এসে আমার কাছে এসে নিয়ে যেও’। কবির কথামতো মানিক পরের দিন হাজির হলেন। টেবিলের ওপর চিঠিপত্র, খাতা-বইয়ের স্তূপ। কিশোর মানিককে দেখে কবিগুরু বেগুনী রঙের খাতাটা খুঁজতে লাগলেন। খানিক বাদে বইয়ের স্তূপের নিচে পড়ে থাকা খাতাটা দিলেন মা সুপ্রভা রায়ের নিকট। কবি খাতাটি দিয়ে বললেন, এখানে লেখা কবিতা মানিক আরেকটু বড় হলে বুঝতে পারবে। বিশ্বকবির ঘর থেকে বের হয়ে উত্তরায়ণের সামনের আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে কিশোর মানিক আবৃত্তি করল সেই আটলাইনের কবিতা।
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছে সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুপা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।
সম্ভবত সত্যজিৎ রায় কিশোর বয়সেই বিশ্বকবির সেই আটটি লাইন মনের গভীরে ধারণ করেছিলেন। কারণ চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি আন্তর্জাতিক ফর্ম ব্যবহার করলেও বিষয়বস্তুতে তিনি ছিলেন পুরোপুরি দেশজ।
রেল লাইনের পাতা খুঁটিতে কান পেতে অপু – দূর্গা যেদিন পৃথিবীর বিস্ময় নিয়ে দূরাগত রেলের আওয়াজ শুনেছিল বাংলা ছবিও যেন সেদিনই কান পেতে শুনেছিল আধুনিকতার পদধ্বনি ।
স্বপ্নগ্রস্ত এক চলচ্চিত্রকার বাঙালি জাতি সত্ত্বার এক মহান প্রতিভূ সত্যজিৎ রায়। শুধু বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলের নয়, উপমহাদেশের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তিনি। চলচ্চিত্রের এক স্বপ্নগ্রস্ত কারিগর ছিলেন সত্যজিৎ। প্রথম জীবনে সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থাভাবে যাকে ঘুরতে হয়েছে প্রযোজকের দ্বারে দ্বারে; সেই তাঁর পেছনেই ঘুরেছেন বিশ্বের নামিদামি প্রযোজকরা।
বাঙালির সন্তান বড় হয় সত্যজিতের সোনার কেল্লা, গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখে। অন্যদিকে সে পড়ে শম্ভু এবং ফেলুদা। সত্যজিৎ রায় বাঙালির জীবনে এমনই সর্বব্যাপী উপস্থিতি যে চতুর্দিক থেকে বাঙালির অস্তিত্বকে ঘিরে রাখেন।
১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালীর পরিচালক হিসেবে যাত্রা করে সত্যজিৎ রায় ৩৪টি ছবি তৈরি করেন। পথের পাঁচালীর জন্য তিনি তার স্ত্রীর গয়না বন্ধক দেন এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার-কর্জ করেন। এসব ছবির সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলো বাংলার গভীরে প্রোথিত। বাংলার সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ এতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু এগুলোর বিশ্বজনীন অবদানের কারণ হচ্ছে এগুলো মানুষের জন্য তৈরি।
মানুষের জীবনের এপিঠ-ওপিঠ চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় সত্যজিৎ রায় একেঁছেন সহজ সরল বর্ণিল রঙে। সেলুলয়েডে গল্পের সঙ্গে জুড়েছেন আবেগ, কাব্যময়তা,বাস্তবানুগতা ও মানবিকতার সমাবেশ। জীবনকে দেখেছেন খুব গভীর দৃষ্টিতে। তাই তার ছবিগুলোতে দেখা যায় অজস্র গল্পের ভাঙা-গড়া। সহজ গল্প তিনি বলেছেন খুব সোজা করে। সৃষ্টিতে ছিল তার বিস্ময়। তুলির মতোই ব্যবহার করেছেন ক্যামেরা।
সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা।
—আকিরা কুরোসাওয়া
জাপানের চলচ্চিত্র নির্মাতা
যার স্পর্শে জীবন পেয়েছে উপমহাদেশের সিনেমা সিনেমা যে শিল্পের একটি শক্তিশালী মাধ্যম, এই কথা কখনো ভুলেননি নির্মাতা সত্যজিৎ। তাই বলে তিনি শুধু সিনেমার ভিতর দিয়ে প্রস্তর কঠিন শিল্প চর্চাই করেননি। প্রেম, বিরহ, যাতনা, সমকালীন রাজনীতি, সমাজের অবক্ষয়, অবদমন এই সবকিছুই তার চলচ্চিত্রে বিষয়বস্তু হয়েছে; তবে তা গতানুগতিক ধারাকে উপেক্ষা করে, পুরো সত্যজিৎ স্টাইলে। সত্যিকারের বাংলা সিনেমার যাত্রা তাঁর হাত ধরেই এগিয়েছে। প্রাণহীন বাংলা সিনেমা শিল্পকে দূর আকাশ হতে ধরে এনে তার ভিতর জীবন দিয়েছেন তিনি। তার সিনেমায় প্রতিটি চরিত্র সত্যিকার জীবনের কথা বলে, জীবন্ত গল্প আর অপরূপ দৃশ্যের সমাহার বাংলা সিনেমায় শুধু নয়, বিশ্ব সিনেমায়ও বিরল!
নার্সিং হোমের বাইরের প্রকৃতিতে যখন বৈশাখি হাওয়ার মাতামাতি, মেঘলা আকাশ থেকে যখন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দিনের নিস্তেজ আলো ঠিক তখনই, তাঁর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যু নামক যে অদৃশ্য নিয়তিকে এতদিন কাঁচের দরজার বাইরে আটকে রাখা গিয়েছিল এইবার সে ঢুকে পড়ল ঘরে, গ্রাস করল বাঙালির শেষ সম্বল সত্যজিৎ রায়কে— নিঃস্ব করে দিয়ে গেল আমাদের অহঙ্কারকে। আমরা রিক্ত হলাম।
২৯বছর আগে ২৮শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাঙালিকে ‘রত্নহীন’ হয়েছিল। এক দীর্ঘদেহী মানুষের মৃত্যু স্থায়ীভাবে নিঃস্ব করেছিল সেই বিকেল। যদিও দীর্ঘদিন হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষটির মৃত্যু খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না ওই গুমোট এপ্রিলের সন্ধ্যায়, তবুও ‘সত্যজিৎ রায় নেই’, এই সংবাদটুকু যেন চুরমার করে বাঙালিকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল ১৯৪১ সালের বৃষ্টি ভেজা এক অগাস্ট মাসের স্মৃতি, যেদিন উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক বাড়িতে নিভে গিয়েছিল এমনই এক প্রদীপ।
সিনে ঈশ্বর তোমার আমাদের হৃদয় ভেদ করে কোথাও যাওয়া হবে না ।
লুৎফুল কবির রনি, লেখক ও আর্ট ক্রিটিক