মাসকাওয়াথ আহসানঃ
সুলতানি, মুঘল, নবাবী আমলে ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জিডিপি অর্জন করেছিলো পূর্ববঙ্গ। এ কারণে সমৃদ্ধ কৃষক ও কারিগর সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিলো; মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড পূরণ হয়েছিলো। পলাশীর যুদ্ধে সুতানুটি বা আজকের কলকাতার দেশীয় কোলাবরেটরদের সহযোগিতায় বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপনিবেশ স্থাপন করলে; স্থানীয় কোলাবরেটরদের মাধ্যমে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে প্রায় এক কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়। কৃষকদের ভূমি কেড়ে নেয়া হয়; কারিগরদের আড়ং উচ্ছেদ করা হয়। ফলে পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালে বৃটিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে জমিদারি লাভ করে দেশীয় কোলাবরেটররা। এই কোলাবরেটর জমিদারেরা সাধারণ মানুষকে শোষণ ও নির্যাতন করে পূর্ববঙ্গ লুট করে কলকাতায় সেকেন্ড হোম তৈরি করে। পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষের সম্পদ খেয়ে জমিদারদের চর্বি হলে; তারা ছেলে-মেয়েকে কলকাতায় বৃটিশের বেঙ্গল রেনেসাঁর লেটুর দলে জুড়ে দেয়। বৃটিশেরা তাদের পূর্ববর্তী শাসক নবাব ও মুঘলদের চরিত্রহনন করে ইতিহাস রচনায় লাগিয়ে দেয় এই নতুন শিক্ষিত কোলাবরেটরদের। বেঙ্গল রেনেসাঁ মূলত কট্টর হিন্দুত্ববাদের শরীরে সেকুলারিজমের রেশমি বস্ত্র চাপিয়ে ছাপড়ি আধুনিকতা চর্চা। ফলে এই দলের লোকেরা পরে হিন্দুত্ববাদে ফিরে যায়। কেউ কেউ হিন্দুত্ববাদের শরীরে সোশালিজমের লিপসার্ভিস চড়িয়ে অবশেষে মোদির হিন্দু ভারতের গেরুয়া সহিস হয়েছে। বৃটিশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে এদের মধ্যে কৃত্রিম আর্য অহংকার তৈরি হয়। শরীরে কুলায় না; তবু সে গাল ফুলিয়ে নিজেকে আর্য দাবি করে।
কলকাতার এই হিন্দুত্ববাদী বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম বিদ্বেষকেন্দ্রিক ইতিহাস ও সাহিত্য রচনা করে। পূর্ববঙ্গের মুসলমানকে বাঙালি বলে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পূর্ব বঙ্গ থেকে বৃটিশ কোলাবরেটর অত্যাচারি হিন্দু জমিদার উচ্ছেদে কৃষক প্রজা আন্দোলন শুরু হয়। ফলে কলকাতার সেকেন্ড হোমে পূর্ববঙ্গের মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ ডিএনএ বৈশিষ্ট্যে রুপান্তর হয়। পূর্ব বঙ্গের নেতারা স্বতন্ত্র স্বাধীন বঙ্গ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। কিন্তু কলকাতার কট্টর হিন্দুবাদীরা পশ্চিম বঙ্গকে যে কোন মূল্যে ভারতের সঙ্গে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। পূর্ব বঙ্গকে তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৃটিশের কাছ থেকে স্বাধীন হতে হয়।
পূর্ববঙ্গের মানুষকে এবার বৃটিশ কোলাবরেটর কলকাতার জমিদারদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের বৃটিশ কোলাবরেটর মুসলিম জমিদারদের খপ্পরে পড়তে হয়। পাঞ্জাবের জমিদারেরা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ নিপীড়ন চালাতে থাকে। পূর্ব বঙ্গ সব সময়ই দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতিতে সক্ষম কৃষক, কারিগর, মেহনতী মানুষের দেশ। ফলে ১৯৪৭-৭১ পাকিস্তানের অর্থনীতির পাওয়ার হাউজ ছিলো পূর্ব বঙ্গ। কিন্তু পূর্ব বঙ্গের সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়ে লাহোর ও রাওয়াল পিন্ডিতে রাজপ্রাসাদ সাজাতে থাকে পাঞ্জাবের জমিদার ও তাদের সেনা কর্মকর্তা সন্তানেরা; যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে। ইতিহাসে সবসময় বহিঃশত্রুকে পাঞ্জাব দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে পাঞ্জাবের এই কোলাবরেটরেরা। সবশেষে বৃটিশের সান্নিধ্য পেয়ে তাদের মধ্যে ছদ্ম আর্য অহংকার তৈরি হয়। মেধায় কুলায় না; তবু তাদের ঠাট বাট আর্য। ফলে তারা পূর্ব বঙ্গের মুসলমানকে মুসলমান বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ হয়ে পড়ে। আসলে মানুষ যার খায় ও পরে; তাকে ছোট করে নিজের হীনমন্যতা লুকায়। এই একই ঘটনা ঘটেছিলো কলকাতার জমিদারদের ক্ষেত্রেও।
স্বাধীন বাংলাদেশে সাহাবাগ ও ঘাপলা কালচার হচ্ছে স্টকহোম সিনড্রোম। কলকাতার হিন্দু জমিদারদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে তাদের কালচারকে ভালোবেসে ফেলা হচ্ছে সাহাবাগ। আর লাহোরের মুসলিম জমিদাদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে তাদের কালচারকে ভালোবেসে ফেলা হচ্ছে ঘাপলা। সাহাবাগ কালচার হচ্ছে ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নামাজ পড়তে দেখে লজ্জায় মরে যাওয়া; ঘাপলা কালচার হচ্ছে রুনা লায়লাকে ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরতে দেখে লজ্জায় মরে যাওয়া।
বাংলাদেশে যেহেতু সুলতানি-মুঘল-নবাবী আমলের জীবনচর্যা, শিল্প-সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়গুলো উপেক্ষিত; ফলে কলকাতা ও লাহোরের জমিদারদের উতপীড়নে আত্মবিশ্বাস হারানো জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন মধ্যস্বত্বভোগী কলকাতা ও লাহোর কালচারকেই ধ্রুব ভেবে সাহাবাগ ও ঘাপলার কৌতুকপ্রদ বাইনারি তৈরি হয়েছে। পূর্ব বঙ্গের মানুষের সম্পদ লুট করে যারা নিও এফলুয়েন্ট বা ফিলিস্টাইন্স সেজে বসেছে; তাদের মতো মনের দিক থেকে দরিদ্র নব্য অভিজাতকে কেন অনুসরণ করবে সেই সুলতানী-মুঘল- নবাবী আমলে সর্বোচ্চ জিডিপি অর্জন করা জনপদের মানুষ। এখনো অর্থনীতিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
আর বর্তমানের কলকাতাকে চারুকলা ও ছায়ানটের চোখে দেখা; কিংবা বর্তমানের লাহোরকে ভারতীয় মিডিয়ার চোখে দেখায় সাহাবাগ ও ঘাপলা কালচার ঊনবিংশ শতকের কলকাতা ও লাহোরকে অনুকরণ করছে। আজকের কলকাতার ছেলে-মেয়েরা জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পোশাক-আষাক পরে না; সেখানে কট্টর হিন্দুত্ববাদ কৌতুকের বিষয়। আজকের লাহোরের ছেলে মেয়েরা চৌধুরী পরিবারের পোশাক-আষাক পরে না; সেখানে কট্টর ইসলামপন্থা কৌতুকের বিষয়। কলকাতার জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও লাহোরের লামস ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববীক্ষা অনুসরণ করে।
জোর করে সাহাবাগি ও ঘাপলা বাইনারি ধরে রেখে লাভ নাই। সাহাবাগের হিন্দুত্ববাদঘন সেকুলারিজমকে মধুর ক্যান্টিনে ডেকে হাসিনা পূজা শেখানো হয়েছিলো। ঘাপলার হুজুরকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনেছিলেন লীগের দরবেশ। সাহাবাগিরা যেভাবে হাসিনার বাকশাল টু পয়েন্ট ও’র খুঁটি হয়েছিলো; ঘাপলারা ঠিক সেইভাবে হাসিনাকে কওমি মাতা ডেকেছিলো। মোদি ও হাসিনার কট্টর হিন্দুত্ববাদ প্রয়োজন ছিলো ভারতের ছায়া উপনিবেশ ধরে রাখতে; আর কট্টর ইসলামপন্থা দরকার ছিলো ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদকে সেটা দেখিয়ে বিজেপির ভোট টানার জন্য। সাহাবাগ ও ঘাপলা উভয়েই ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরিয়ানি খেয়েছে। ফলে এদের কাউকেই আর গ্লোরিফাই করার সুযোগ নাই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।