রেজাউর রহমান লেনিন
বন্ধুরা, বেশ কিছুদিন যাবৎ খুব বেশি বড় লিখা লিখতে পারছি না, বা লিখছি না বলতে পারেন, একটি সংগঠনের কাজে ব্যস্ত আছি। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, জনাব গোবিন্দ বরের আমার/ আমাদের বিরুদ্ধে মামলার কি খবর কোন সাহায্য লাগবে কিনা, আপনাদের কয়েকজনকে উত্তর দিয়েছি, কয়েকজনের সাথে যোগাযোগও করেছি, বেশির ভাগ উত্তর দেওয়া হয় নাই; ইচ্ছা করেই বা অনিচ্ছাকৃত, সময়ের অভাব।
এর মাঝে বড় ঘটনা ঘটেছে; তবে সেটি বলার আগে বলে রাখা ভাল, সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এর ২৫, ২৬ ২৯, এবং ৩১ ধারাসমূহের অধীনে আমার, সাংবাদিক ইসমাইল আহসান, মানবাধিকার আইনজীবী রওশন আরা লিনা এবং অজ্ঞাত মাহমুদ কাদেরী (আমরা এখনো ওনাকে চিনি না, যোগাযোগ করবার অনুরোধ রইল) বিরুদ্ধে জনাব গোবিন্দ বরের অভিযোগ ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এএম জুলফিকার হায়াত গ্রহণ করেন নাই, তবে গোবিন্দ বরের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং প্রতিবাদী ভুক্তভোগী ও অধিকারকর্মী সাধনা মহলের বিরুদ্ধে (কুলসুম আসাদী মহল সাধনা) অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কি? যদি হয়ে থাকে তবে তা উদ্বেগের কেননা আমরা যারা দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রথম থেকে বিরোধিতা করেছিলাম, তারা জানি এবং বলেছি, এই আইনের ব্যবহারই অপব্যবহার; এছাড়াও বিবৃতি দিয়ে বলেছিলাম;
“সাইবার পরিসরে ব্যক্তি এবং সামষ্টিক সুরক্ষার ধারণা আরও সংকুচিত হবে এবং সাইবার পরিসরকে করে তুলবে গোয়েন্দাময়। সাইবার পরিসর সংক্রান্ত কার্যকর আইনি-বিধি ও বিধানসমূহ ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিতে হলেও, নাগরিকদের “স্বাধীনতা” এর পরিবর্তে “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা” দৃষ্টিকোণ থেকে আইনগুলো প্রণয়ন করা হচ্ছে। এর ফলে আইনসমূহ নাগরিকদের জীবন-জীবিকার অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সভাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও নানাবিধ নাগরিক মৌলিক অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং নাগরিকদের মাঝে বিশেষ করে যুবসমাজের প্রতিনিধিদের জনবান্ধবমূলক কর্মকাণ্ডকে সীমাবদ্ধ ও অপরাধীকরণ করেছে। আইনে উল্লিখিত প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সংগঠিত হয়েছে শহর কেন্দ্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের গতি-প্রকৃতি এবং সমীকরণে রয়েছে ভিন্নতা, যা কোনভাবে গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার বান্ধব নয়। বিচারিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সাইবার আপীল ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্রেও রয়েছে সরকারের প্রায় ১৭ বছরের অবহেলা যা বিচার প্রক্রিয়াকে করেছে অবরূদ্ধ এবং নিপীড়নমূলক।”
এইবার বড় ঘটনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমাদের বিরুদ্ধে জনাব গোবিন্দ বরের মামলা করবার চেষ্টা এবং সাধনা মহলের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ প্রদানের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভিক্টিমস নেটওয়ার্ক এবং বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে উপলক্ষে বর্তমানে দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারা এবং বাতিলকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নের শিকার ৩৮ জন প্রতিবাদী ভুক্তভোগী সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিল্পী, ও মানবাধিকার গভীর উদ্বেগের সাথে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি), বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের এক্সটার্নাল এফেয়ার্সের টিম লিডার, গোবিন্দ বর কর্তৃক মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহার করে অপরাধিকরণ, ভয়-ভীতি প্রদান এবং মানবাধিকার হরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবাদ লিপি প্রস্তুত করেছেন। ধন্যবাদ প্রতিবাদী নাগরিকবৃন্দ। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি এই সকল নাগরিকদের সৎ সাহস দেখে, একইসাথে ৩/৪ জন ব্যক্তির আচরণে কষ্ট পেয়েছি কেননা, তাঁদের বিপদে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকগুলো নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছি তাঁদের পক্ষে এবং আমাদের বিপদে তারা নিশ্চুপ ছিলেন, নিশ্চুপ থাকবার অধিকার চর্চাও করেছেন। মাফ করে দিলাম কিন্তু দেখা হলে বলব এবং মনে করিও দিব।
যাক সাহসী ৩৮ জন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভিক্টিমস নেটওয়ার্কের সদস্যবৃন্দের জন্য সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং আইনের ধারাসমূহ ২৫, ২৬, ২৯ এবং ৩১ নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
প্রথমে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৫ নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করি, ধারা ২৫ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতিপ্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ আবার ধারা ৩১ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
একইসঙ্গে, ধারা ২৫ এবং ৩১-এ অত্যধিক বিস্তৃত শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা যদি ধারা ৩১-এর দিকে নজর রাখি তবে দেখব যে, ধারা ২৫-এর মূল শর্তগুলো অনির্ধারিত, যেমন: ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ বা ‘আইন শৃঙ্খলা’ বা ‘প্রতিকূলতা’। সহিংসতা বা বৈরিতা হওয়ার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত সম্পর্কে বিধানটি আরও অস্পষ্ট। এটি আন্তর্জাতিক নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের চুক্তি সংক্রান্ত দলিলের ২০(২) অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে কিছু দলকে সহিংসতা বা বৈষম্য প্ররোচনা থেকে সুরক্ষার বিষয়ে উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিধানটি সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা সম্পর্কিত মতবিরোধ বা সরকারের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিচার করতে সহজেই ব্যবহৃত হতে পারে।
এইবার আসা যাক, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৬। এটা সত্যি যে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ কী হবে তার কোনো উল্লেখ নেই। আমাদের জানামতে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের পাসপোর্ট, পৃষ্ঠা নং-৩ এ, ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ শিরোনামে কিছু তথ্য রয়েছে এবং এর মধ্যে রয়েছে শুধুমাত্র – নাম, পিতামাতার নাম, স্ত্রীর নাম এবং স্থায়ী ঠিকানা। যদিও, পৃষ্ঠা নং. ২, কিছু অন্যান্য তথ্য যেমন জন্মতারিখ, লিঙ্গ, জন্মস্থান, জাতীয় শনাক্তকরণ নম্বর, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই ব্যক্তিগত তথ্য এবং সাধারণত অন্যান্য দেশের মতো ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত থাকে, ব্যক্তিগত তথ্য’ এর সংজ্ঞার মধ্যে পৃষ্ঠা নং ২ এই তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা সেই ব্যাখ্যা সুযোগ রয়েছে. কেননা পৃষ্ঠা নং ৩ স্পষ্টভাবে ‘ব্যক্তিগত ডেটা’ হিসাবে কয়েকটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, সাইবার নিরাপত্তা আইন এর ধারা ২৬ ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছে; তবে বিভাগটি ‘শনাক্তকরণ তথ্য’ ব্যবহার করেছে এবং এই ধরনের তথ্য হিসাবে তথ্যের একটি দীর্ঘ তালিকা অন্তর্ভুক্ত করেছে। ধারাটির ব্যাখ্যা প্রদান করে যে ‘শনাক্তকরণ তথ্য’ মানে কোনো বাহ্যিক, জৈবিক, শারীরিক তথ্য বা অন্য কোনো তথ্য যা একা বা যৌথভাবে কোনো ব্যক্তি বা সিস্টেম সনাক্ত করতে পারে, যার নাম, ছবি, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, পিতামাতার নাম, স্বাক্ষর, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নম্বর, আঙুলের ছাপ, পাসপোর্ট নম্বর, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ই-ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর, ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল স্বাক্ষর, ব্যবহারকারীর নাম, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর, ভয়েস প্রিন্ট, রেটিনার ছবি, আইরিস ইমেজ , ডিএনএ প্রোফাইল, নিরাপত্তা প্রশ্ন বা অন্য কোনো পরিচয় যা প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য সহজলভ্য। গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হল যে এই ধারা ২৬; ‘শনাক্তকরণ তথ্য’ সংগ্রহ ও ব্যবহার করাকে একটি অপরাধ করেছে এবং এটি প্রদান করা হয়েছে যে যদি কেউ, আইনি কর্তৃত্ব ছাড়া, এই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে, বিক্রি করে, অধিকার করে, সরবরাহ করে বা ব্যবহার করে, তাহলে সে এমন কোনো অপরাধ করবেন যার জন্য তিনি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ।
‘শনাক্তকরণ তথ্য’ সংজ্ঞায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ‘ব্যক্তিগত তথ্য’-এর একটি প্রমিত সংজ্ঞা একটি স্পষ্ট রূপরেখা প্রদান করবে যার উপর তথ্যকে ‘ব্যক্তিগত তথ্য’ হিসাবে বিবেচনা করা হবে – অনেক দেশের আইন এবং আঞ্চলিক আইনগুলি ব্যক্তিগত তথ্য হিসাবে চিহ্নিত (যেমন নাম, আইডি নম্বর, পাসপোর্ট, ইত্যাদি) এবং সনাক্তযোগ্য উভয়ই অন্তর্ভুক্ত করে। (আইপি ঠিকানা, ওয়েবসাইট ব্রাউজিং ইতিহাস, ইত্যাদি) তথ্য, ইলেকট্রনিক এবং তথ্যের ম্যানুয়াল ফর্ম। যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তিগত ডেটাও সংবেদনশীল এবং অ-সংবেদনশীল ডেটাতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। যদিও ধারা ২৬-এর ব্যাখ্যায় ব্যক্তিগত তথ্যের কিছু উদাহরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবে এটি একটি সঠিক সংজ্ঞা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না।
ধারা ২৬-এ ‘আইনগত কর্তৃত্ব থাকা বা থাকা ব্যক্তি’ বা ‘আইনি কর্তৃত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া বা দৃষ্টান্ত’ ইত্যাদি সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। আমরা যদি অন্য কিছু ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের বিধান বিবেচনা করি তবে এই বিধানের সাথে কিছু গুরুতর সমস্যা রয়েছে। আইনটি ধারা ২৬ এর উদ্দেশ্যে ‘ব্যবহার’ এবং ‘সংগ্রহ’ সংজ্ঞায়িত করেনি। সামাজিক, পারিবারিক বা বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে সংগৃহীত ও ব্যবহৃত ‘শনাক্তকরণ তথ্য’-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি; এবং এই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বিষয়কেও পার্থক্য করা হয়নি। তদুপরি, সাধারণভাবে এই ধরনের তথ্য এবং প্রকৃতিতে সংবেদনশীল তথ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় না। এই বিষয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন এর ধারা ৫৮ এর অধীনে ভবিষ্যত নিয়ম প্রণয়নের কোন সুযোগ নেই। এটি ব্যতীত, ‘শনাক্তকরণ তথ্য’ সংগ্রহ এবং ব্যবহার করার এই ধরনের কাজগুলিকে বিবেচনাযোগ্য করা হয়, অর্থাৎ ৫২ ধারার অধীনে আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য; অপরাধ করা ছাড়াই যে কেউ গ্রেপ্তার হতে পারে।
অধিকন্তু, ডেটা সুরক্ষা আইনগুলি ডেটা প্রক্রিয়াকরণের আইনি ভিত্তিতে একটি নির্দেশিকা দেয় – যে শর্তে/পরিস্থিতিতে যে কেউ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ, ব্যবহার এবং প্রক্রিয়া করতে পারে। উপরন্তু, ‘ডেটা কন্ট্রোলার’ এবং ‘ডেটা প্রসেসর’-কে সংগৃহীত ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষা করার জন্য কিছু দায়িত্ব, দায়িত্ব এবং বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে। যাইহোক, সাইবার নিরাপত্তা আইন ডেটা প্রক্রিয়াকরণের আইনি ভিত্তিতে, ‘ডেটা কন্ট্রোলার’ এবং ‘ডেটা প্রসেসর’ এর বাধ্যবাধকতা এবং সম্মতির বিষয়গুলির কোনও বিধান নেই।
এইবার সর্বশেষে দেখা যাক, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মানহানি সংক্রান্ত অপরাধের বিধান, সেখানে বলছে “যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দন্ডবিধির ধারা ৪৯৯ এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির উক্তরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন”। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলোয় যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে, তার অধিকাংশই মাত্রাতিরিক্ত, অসম, অনুপাতহীন এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমনভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি হয়েছে মর্মে গণ্য হবে। এই ধারা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিরও মানহানি হতে পারে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন মানহানির মামলা করতে পারবেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। জনগণের কল্যাণে, সরকারি কর্মচারীর সরকারি কোনো কাজে তার আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, আদালতের কার্যবিবরণী বা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে, জনসমস্যা বিষয়ে বা কোনো ব্যক্তির আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, গণ–অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করলে, সরল বিশ্বাসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করলে এবং আদালতের সিদ্ধান্তে মামলার দোষ, গুণ নিয়ে সরল বিশ্বাসে কথা বললে মানহানি হবে না। চমৎকার তাই না?
প্রথমে, মনে রাখা দরকার ‘সরল বিশ্বাসে’ বাতিলকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোন সরকারী কর্মকর্তা অপরাধ করলে অপরাধ হত না কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই সরল বিশ্বাস সংক্রান্ত ধারা বাতিল করা হয়েছে। আবার যেহেতু দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারার সাথে সংযোগ করা হয়েছে তাহলে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে বাতিল করে কার নিরাপত্তা রক্ষা করা হল? দ্বিতীয়ত, ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞায়ন করতে গেলে ব্যক্তি কথা বলেছে, কোন প্রতিষ্ঠানের মানহানি হয়েছে সেইরকম কোন প্রকার কথা বলা হয় নাই, এমন ভুল ধারণা অনেকেই করেন এবং করে থাকেন এবং নিম্নআদালতসমূহের বিচারকবৃন্দ সঠিক সময়ে সঠিক বিবেচনাও করতে পারেন না, না করতে পারবার অনেক বাস্তবতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত।
তৃতীয়ত, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। আইন মতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানহানিকর তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ২৫ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ দণ্ডবিধির ৪৯৯ ও ৫০০ ধারা, ১৮৬০ ফৌজদারি মানহানির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটিতে মানহানির কারণে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির জন্য জরিমানাসহ বা ছাড়াই ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানহানির কারণে উপরোক্ত আইনের সংজ্ঞা ব্যবহার করা হলেও ভিন্ন শাস্তির বিধান করা হয়েছে, যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই অপরাধের জন্য একজন অভিযুক্তকে উচ্চতর সাজা দেওয়া যায় না। যেহেতু ধারা ২৯ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭-এর বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাই সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে এটি অকার্যকর হয়, যা আসলে অবৈধ, বেআইনি এবং বাতিলযোগ্য।
মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের আইনে ফৌজদারি মানহানিকে বিশেষভাবে দণ্ডবিধির অধীনে একটি অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে দেওয়ানি মানহানি টর্ট আইনের ওপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয়। টর্ট আইনে লিখিত আইন দ্বারা ভুল নির্ণয় হয় না, বরং বিচারক কর্তৃক মামলার রায় দ্বারা তা নির্ণয় করা হয়। তদুপরি একটি ফৌজদারি মামলায় মানহানি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু দেওয়ানি মানহানির মামলায় ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে। বেশির ভাগ গণতন্ত্রে ফৌজদারি মানহানি আইন বাতিল করা হয়েছে এবং দেওয়ানি ভুল আকারে বিচার করা হয়। তাই যোগাযোগের নতুন পদ্ধতিগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের মানহানি সংক্রান্ত আইনকে আধুনিক করা দরকার।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩১-অত্যধিক বিস্তৃত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধীকরণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বিধানগুলো সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কিত যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা এবং সমালোচনামূলক মতামত প্রদানের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আইনি নিগ্রহ করতে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে।
রেজাউর রহমান লেনিন, সমাজ-রাজনৈতিক গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী।