মাসকাওয়াথ আহসানঃ
শৈশবে যারা মসজিদ ও মন্দিরে জুতা চুরি করে; এরাই বড় হয়ে দলীয় ক্যাডার হয়ে জনগণকে লুন্ঠন করে; আমলা হয়ে ঘুষ খেয়ে নাগরিকের পকেট কাটে। কাজেই ইজরায়েল বিরোধী বিক্ষোভের নাম করে জুতা চুরি দেখে অমন চক্ষু কপালে তোলার কোন কারণ নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে জুতা চুরির ট্যালেন্ট দেখে এমপি-মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ী বানানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে জুতা বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি হয়; তারাই জুতা চুরিকে সাফল্যের সূচক হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
আমাদের সমাজ মনস্তত্ব হচ্ছে, কেউ একবার জুতার মালিক হয়ে পড়লে তখন চেষ্টা করে; অন্যেরা যেন সারাজীবন খালিপায়ে ঘোরাঘুরি করে।
বৃটিশেরা যে কোলাবরেটর জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি করেছিলো; তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় প্রজাদেরকে প্লাস্টিকের জুতা মাথায় নিয়ে পার হতে হতো। বেগুণী মুখমণ্ডলের নধর গোলগাল কৃশ জমিদার চামড়ার জুতো পরে আরাম কেদারায় বসে পা নাচাতো প্রজার মুখের সামনে। বৃটিশ ভ্যাগাবন্ডেরা জুতাসহ পা টেবিলে তুলে জমিদারের মুখের সামনে নাচাতো; জমিদার সেই রাগ ঝাড়তো প্রজার ওপরে।
খালি পায়ে হেঁটে পা ফেটে যাওয়া লোকেরা স্বাধীন বাংলাদেশে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে জুতো পরে মচ মচ শব্দ করে ঘোরা শুরু করে। প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরা লজিং মাস্টার স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে আমলা হলে চকচকে জুতা পরে লোকজনকে বলে বেড়াতে শুরু করে; এই আমাকে স্যার বলবি।
দেশে জীবন কুশলতা অর্জনের লক্ষ্যে দুটি দোকান চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোকান ও ইসলামি চেতনার দোকান। এই দোকানদারি করে চৌদ্দ গুষ্টি জুতা পরে ঘুরতে শুরু করে। কেউ মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে বসলে, এতো টেকাটুকা পাইলেন কই! দোকানির একটাই উত্তর, আমার দাদা জমিদার ছিলেন। এ পর্যন্ত যতজন দোকানি তার দাদার জমিদারির গপ্পো দিয়েছে; সেইসব জমি জোড়া দিলে; বাংলাদেশের আয়তন চীনের চেয়ে বড় হবার কথা।
প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাওয়ার অনুকূলে ঝান্ডা উড়িয়ে নতুন নতুন লোকের জুতা পরার সুযোগ তৈরি হয়। একবার পায়ে জুতো চড়ে গেলেই সেই লোকের ছেলেমেয়ে ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথ ও আওরঙ্গজেবের ছবি ঝুলিয়ে বড্ড জোড়া সাঁকো ও কুতুব মিনার হয়ে ওঠে। তারা তখন ফেসবুকে জুতা চোরের ছবি দেখে ছ্যা ছ্যা করতে থাকে।
ফেসবুকে জুতা চোরের চেহারার সঙ্গে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথ ও লব্ধ প্রতিষ্ঠ আওরঙ্গজেবের ছবি মিলিয়ে দেখবেন; একই চেহারা। একজনের বাবা দুই চেতনার যে কোন একটির দোকানি হতে পেরেছিলো। আরেকজনের বাবা অতো চালাক চতুর না হওয়ায় ছেলেকে জুতা কিনে দিতে পারেনি।
৫৪ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামি চেতনার জিগির তুলে দেশ লুন্ঠন করে যে অভিজাত জুতা সমাজ তৈরি হয়েছে; তাদের তৈরি করা সমাজ বৈষম্যের গ্যাঁড়াকলে পড়ে প্রান্তিক জুতাবিহীন মানুষ রয়ে গেছে। দুই চেতনার মবসার্ভিসে দখল করা অন্যের বাড়িতে বসে; কুঁড়ে ঘর থেকে রাজপ্রাসাদে ওঠা জুতা দুলাল ও দুলালি; সারাদিন মব ভায়োলেন্সকে গালাগাল করে। এমন একটা ভাব নিজে যেন কোন সততার মিঠা পুকুরের মাছ।
চোখের সামনে দেশ ডাকাতি করে দেশটাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেলো হাসিনার জুতাবাহকেরা; তখন বেশ রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে তেলাঞ্জলি দিয়ে ও শোকরানা মেহেফিল করে কওমি জননী ডেকে স্পিকটি নট ছিলো। বুবুর জুতার বাড়ি খেয়ে রাবীন্দ্রিক ও আওরঙ্গজেবিয় দাড়িরা তখন পুলকে হাকালুকি করেছে, বুবুর জুতার বাড়ি মানেই দুবাই-সিঙ্গাপুরে বাড়ি। দুর্নীতি বসন্তে দেশটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে এখন ছিদ্রান্বেষণের বাবু কালচার চলছে।
আর এখন এসেছে জাতির বিবেক সেজে সমাজ সংসার উচ্ছন্নে গেলো বলে; ভাটের কেত্তন করতে। এই যে জুতা আভিজাত্য; মধুমতী নদীতে গামছা দিয়ে ডানকিনে মাছ ধরে কেটেছে যার বাবার শৈশব; সে এখন সী ফুড খেতে খেতে ছোট খাট মানুষের জুতা চুরি নিয়ে চুক চুক করে বলে, সততা বলে আর কিছুই রইলো না।
যতদিন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবেনা; বৈষম্যের ধূসরতা সরে গিয়ে মৌলিক মানবাধিকার পূরণ হবে না; ততদিন চক্রাকারে চলতে থাকবে এই জুতা সভ্যতা। আজ যে জুতা চুরি করছে; কাল সে পার্টির চাঁদাবাজির লাইসেন্স পেয়ে গেলে; একদিন ঠিকই তার ছেলে-মেয়ে দুর্নীতির জুতাগৃহে বসে চুক চুক করে বলবে, সমাজে সততা বলে আর কিছুই রইলো না।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।