মাসকাওয়াথ আহসানঃ
বিচিত্রা ছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল সাপ্তাহিক। বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির; তরুণ প্রতিবেদকদের দিয়ে তৈরি করাতেন এমন সব প্রতিবেদন যা এক একটি প্রামাণিক দলিল হয়ে রয়ে গেছে। প্রতিবেদনের বিষয় শৈলী ও উপস্থাপনের দক্ষতা দেখে বোঝা যেতো; শাহরিয়ার কবির ছিলেন জাত সাংবাদিক। তার সাহচর্যে যে তরুণ প্রতিবেদকেরা তৈরি হয়েছিলো তারা প্রত্যেকে পরে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছে।
১৯৯৭ সালে বিচিত্রা বন্ধ হয়ে গেলে শাহরিয়ার কবিরের সাংবাদিকতার সোনালী যুগের অবসান ঘটে। ঢাকার মিডিয়া জগতটাই এমন; যেখানে এক্সট্রা অর্ডিনারি সাংবাদিকদের সাইড বেঞ্চে বসিয়ে মিডিওকারেরা রাজত্ব করে। ফলে আর কোন মিডিয়া গ্রুপ শাহরিয়ার কবিরের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেনি।
শুরু হয় শাহরিয়ার কবিরের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়; একজন এক্টিভিস্ট হিসেবে। শাহরিয়ার কবির পাকিস্তানের বামপন্থী নেতা ও একাডেমিশিয়ান তারিক আলীর স্নেহধন্য ছিলেন। কিংবদন্তীর নেতা তারিক আলীর “গোঁফ” নিয়ে বিচিত্রার একটি প্রচ্ছদ কাহিনীও করেছিলেন শাহরিয়ার কবির। পাকিস্তান ও ভারতের সোনালী যুগের বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে কবিরের সখ্য রয়েছে।
কবিরের জগত ধর্মহীন নয়। তিনি ইসলামের সুফি ধারার গভীর অনুরাগী। তুরস্কের জালালউদ্দিন রুমী, পাকিস্তানের বুল্লে শাহ, শাহ আব্দুল লতিফ ভিটাই, ভারতের কবির, বাংলাদেশের লালনের দর্শন উঠে এসেছে তার নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রগুলোতে।
সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান স্বীকার করেছেন, পশ্চিমা শক্তি সমাজতন্ত্রকে পরাজিত করতে সৌদি আরবকে কঠোর ওহাবী ইসলাম প্রচারে প্ররোচিত করেছিলো। শাহরিয়ার কবির কোমল ইসলামের বিপরীতে কঠোর ইসলাম প্রসারে আপত্তি জানিয়েছেন। কারণ কঠোর ইসলাম বিশ্বজুড়ে ইসলাম ধর্মের সুনাম বিনষ্ট করেছে।
শাহরিয়ার কবির শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটিকে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। একাত্তরে কবির তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হানকে হারিয়েছেন। ফলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া তার ন্যায্য দাবি। ২০০১ সালে বিএনপির জোট সঙ্গী হয়ে জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় কবিরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
২০২৪-এর জুলাই-এর মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার চাওয়ার কারণে ভবিষ্যতে ভারত সমর্থিত কোন সরকার এসে যদি এই প্রজন্মের কাউকে কারাগারে পাঠায়; তা যেমন অন্যায় হবে; ২০০১-০৬ পর্বের জামায়াত সমর্থিত সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে কবিরকে জেলে পাঠানো ঠিক একই রকম অন্যায় ছিলো।
২০২৪ এর জুলাই-এ শাহরিয়ার কবিরের অন্যায় হয়েছে খুনে শেখ হাসিনার পক্ষে বিবৃতি দেয়া। এই অপরাধ একাত্তরে কেবল আদর্শিক কারণে খুনে পাকিস্তানকে সমর্থন করার মতো। যেখানে হত্যাকান্ডের সঙ্গে সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর কেবল আদর্শিক কারণে পাকিস্তানকে সমর্থনকারীরা বিচারের আওতায় আসেনি। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার করা হচ্ছিলো। একই যুক্তিতে শাহরিয়ার কবির হাসিনাকে কেবল আদর্শিক সমর্থন করায় এবং হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত না থাকায় বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় তাকে মুক্তি দেয়া উচিত।
আমি কেন শাহরিয়ার কবিরের মুক্তির দাবি রাখছি? কারণ তিনি শেখ হাসিনার আদর্শ সমর্থন করেও আমার হাসিনা বিরোধী প্রতিটি লেখা পড়ে ফোন করে কিংবা হোয়াটস এপ বার্তায় অনুপ্রেরণা দিতেন লেখালেখি চালিয়ে যেতে। এই যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ; তা তাকে দলান্ধ মানবতাবিরোধী অপরাধী থেকে আলাদা করে।
উনি প্রতিটি প্রজন্মের আলাদা বাস্তবতা অনুধাবন করতেন। উনার জীবনের লড়াই ছিলো পাকিস্তানের উপনিবেশ ও কট্টর ইসলামপন্থার বিরুদ্ধে। আর আমাদের প্রজন্মের লড়াই ভারতের ছায়া উপনিবেশ ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী মোদি প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে। আমাদের উভয়ের লক্ষ্য একটি সার্বভৌম বহুত্ববাদী সমাজ।
শাহরিয়ার কবিরের এক্টিভিজম হচ্ছে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা আর মিডিয়ায় প্রেসরিলিজ পাঠানো। আর প্রতিপক্ষের অন্যায়ের শ্বেতপত্র প্রকাশ। মাঝে মধ্যে টকশোতে এসে কঠোর ইসলামের সমালোচনা করা। শেখ হাসিনার জন্য এটুকু পক্ষপাতের জন্য একজন বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষকে কারাগারে রাখা যৌক্তিক বলে মনে হয় না।
দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করলে দেখবে; উনি শেখ হাসিনার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেননি, কোন পদ বা পদক পাননি। নিজের পারিবারিক একটি প্রেসের উপার্জনে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন। পারিবারিক ভিটেটা প্রোমোটারকে দিয়ে; এপার্টমেন্ট বানিয়েছেন। যে যুগে শেখ হাসিনার পিয়ন হেলিকপ্টারে চড়ে ঘুরেছে; সে যুগে শাহরিয়ার কবির পাঁচ পয়সার ব্যক্তিগত অনুদান নেননি।
শাহরিয়ার কবির এমন একজন মানুষ; যিনি বিতর্ক বা সংলাপে আগ্রহী। দেশে দেশে তিনি কট্টর ইসলামপন্থীর সঙ্গে বাহায করেছেন। তারপর হাসিমুখে বিদায় নিয়েছেন। কবি জালালউদ্দিন রুমী এরকম অসংখ্য বিতর্ক করেছেন কট্টর ইসলামপন্থীদের সঙ্গে।
তিনি যদি কারাগারের বাইরে থেকে আমৃত্যু বিতর্ক করেন; তার সঙ্গে বিতর্ক চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। সংলাপের মানুষকে কারাগারে রাখা বুদ্ধিদীপ্ত নয়। কঠোর ইসলামের সঙ্গে কোমল ইসলামের বিতর্কের মাঝ দিয়ে শান্তির ইসলাম তার সুনাম পুনরুদ্ধার করতে পারে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।