মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সব সময় শুধু নেবার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। কাউকে কিছু দিতে গেলে তাদের হৃদয় ক্ষয়ে যায়। এই তিনটি দেশের লোক শরণার্থী হয়ে ইউরোপ-এমেরিকায় গিয়ে খাচ্ছে-দাচ্ছে; চর্বি বেড়ে যাওয়ায় একে অপরের হাইকমিশন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করে চর্বি গলাচ্ছে। অথচ ভারতের কিছু লোকের সারাক্ষণ অভিযোগ, বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে উঁইপোকার মতো সব খেয়ে নিচ্ছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, আফঘান শরণার্থীরা পরিবেশ নষ্ট করছে, সব খেয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু লোকের অভিযোগ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে।
ভাবখানা এমন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐ লোকগুলো রয়্যাল ফ্যামিলির লোক। আর শরণার্থীরা পোকামাকড়।
নিজেরা নির্লজ্জের মতো পশ্চিমের দেশে যাবার জন্য উন্মুখ, ছেলে-মেয়ে পশ্চিমে গেলে গর্বভরে ছবি দেয় ফেসবুকে। আর শরণার্থীদের নিজ দেশে আশ্রয় পেতে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে। একেই বলা হয় ছাপড়ি মেন্টালিটি। শুধু নিজের টুকু বুঝে নেয়া।
এই আত্মকেন্দ্রিকতা ও নীচতার কারণে; স্বাধীনতার দশ বছরের মাঝে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেখানে সভ্য জনপদ গড়েছে; স্বাধীনতার ৭৮ ও ৫৪ বছর পরেও এই তিনটি দেশ বৈষম্য ধূসর ডাকাতের গ্রাম হয়ে রয়ে গেছে; ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছে মানুষ খেকো জনপদ।
এই তিনটি দেশের লোকেদের নির্লজ্জভাবে পশ্চিমে অভিবাসী হওয়া; ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে শিশুভাতা গ্রহণ, সামাজিক ভাতায় গতরপোষা; আর সময় সময় উত্তেজিত হয়ে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পশ্চিমের রাস্তায় হাডুডু খেলা; ভ্যাড়ভেড়ে গ্রাম্যতায় একে অপরের প্রতি মিডল ফিঙ্গার প্রদর্শন করে; পশ্চিমা পুলিশের ডান্ডার বাড়ি খেয়ে ও গ্রেফতার হয়ে, ওরে বাবারে বলে কান্না জুড়ে দেয়া; এইতো জীবন তাদের। আবার ফেসবুকে বসে নাকের ময়লার বল বানাতে বানাতে নিজ নিজ দেশে আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষদের তুচ্ছ করে খানিকটা সুপিরিয়র সাজতে চেষ্টা করে।
প্রকৃতিকে আমরা যে ইতিবাচকতা উপহার দিই; প্রকৃতি আমাদের তা ফিরিয়ে দেয়। আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে গিয়ে নিজের সন্তানের বাইরে পৃথিবীর অধিকার বঞ্চিত শিশুদের জন্য আমরা যতটুকু ভালোবাসা জমা করি, সেটাই জীবনকে ইতিবাচকতা ফিরিয়ে দেয়। অনেকেই অবাক হয় যখন দেখে একটি পরিবার সাত পুরুষ ধরে কি করে সুখি রয়ে গেলো! আর তাদের চারপাশে নানাবিধ অসুখ। পার্থক্য তৈরি হয় শুধু নিজের কল্যাণ নিয়ে না ভেবে সামষ্টিক কল্যাণ চিন্তা ধরে রাখার মাধ্যমে।
ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সচ্ছল পরিবারগুলো যদি শুধু নিজের সন্তানকে ভালো না বেসে সমাজের অধিকার বঞ্চিত শিশুদের ভালোবাসতে শিখতো; তাদের ফিল্যানথ্রপিতে অধিকার বঞ্চিত শিশুরা সুন্দর জীবন পেতো। কল্যাণরাষ্ট্রে নাগরিকেরা সততার সঙ্গে ট্যাক্স দেয় বলে; সেই অর্থে রাষ্ট্রের প্রতিটি শিশু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার ভোগ করে। কিন্তু এই তিনটি দেশের অর্থশালী লোকেরা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়; আবার গাড়িতে নিজের ছেলের হাতে কে এফ সি ফুড আর দামি খেলনা তুলে দিয়ে; গাড়ির জানালা তুলে দেয় গরিব শিশুর মুখের ওপর।
এই শিশুরা শৈশবের তিক্ততা থেকে প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে বড়ো হয়। রাজনৈতিক দলগুলো খুনে ক্যাডার আর রাষ্ট্র খুনে পুলিশ-প্রশাসক-ব্যবসায়ী পায় এইসব প্রতিশোধ উন্মুখ শিশুদের মাঝ থেকে। ফলে দক্ষিণ হয়ে ওঠে অসংখ্য প্রতিশোধের গল্প।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে অধিকার বঞ্চিত মানুষ পার্টির ক্যাডার হয়ে ধনাঢ্য হলে, পুলিশের ইউনিফর্ম পরলে, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী হলে; সে গরিব নিপীড়ক হয়ে ওঠে। যেভাবে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হওয়া অসহায় দক্ষিণ এশীয় শরণার্থীরা ওসব দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া মাত্র, নিজ নিজ দেশে অন্য দেশ থেকে আসা শরণার্থী ও অভিবাসীদের নিয়ে নিষ্ঠুর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে মেতে ওঠে। গরীব ছোট লোক হয় না; বরং একটু সচ্ছলতা এলে সেই ধনীরা এরকম ছোটলোক হয়। ছোট লোক মানে মনটা গরীব যাদের।
দক্ষিণ এশীয় সমাজে কঠোর পরিশ্রম করে যারা সম্পদ অর্জন করেন, তারা অধিকার বঞ্চিতদের সাহায্য করেন বলেই কেউ অনাহারে মরে না। কিন্তু দুর্নীতি বসন্তে ধনী হয় যারা; তারা লোক দেখানো ফিল্যানথ্রপি করতে গিয়ে গরীবদের ভীড়ের চাপে পদপিষ্ঠ করে মারে।
দক্ষিণ এশীয় ছাপড়ি মনস্তত্ব, একটু সম্পদ হলেই গরীবদের তুচ্ছ করার কর্কট রোগ এই জনপদগুলোকে সভ্যতার আলো বঞ্চিত রেখেছে। একদা ভূমিহীন দুর্নীতি বসন্তে কুঁড়ে ঘর থেকে পাকা দালানে উঠে নিজেকে দেশের মালিক বলে দাবি করে ও স্বপ্রণোদিত ইমিগ্রেশন অফিসার হয়ে ওঠে।
বৃটিশ কোলাবরেটর লাহোর ও কলকাতার ভ্যাগাবন্ডেরা যেরকম কাঁচা পয়সার মুখ দেখে পূর্ব বঙ্গের মানুষকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো; ঢাকার পাওয়ার করিডোরের কোলাবরেটরেরা ঠিক তেমনি কাঁচা পয়সার মুখ দেখলেই অধিকার বঞ্চিতদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি বসন্তে নতুন বড়লোক হওয়া লোকগুলো দেখবেন, রোহিঙ্গারা দেখতে খারাপ, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী এসব রেসিজম চালাতে থাকে। অথচ একবার আয়নার সামনে সবুজ লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে কেমন ব্যাঙ্গাচির মতো দেখায় নিজেকে।
যতদিন পর্যন্ত এইসব মানসিক দৈন্য ও অবচেতনের অশ্লীলতা দূর করে প্রতিটি মানুষকে সম্মান জানাতে আর তাদের প্রতি সমানুভূতি প্রকাশের মত সভ্য হয়ে উঠতে পারবো না আমরা; ততোদিন পর্যন্ত একটি সুখি ও সভ্য জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।