মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামার মাঝে গতকাল ও আজ বাংলাদেশের অন্ততঃ তিনটি সীমান্তপথে ভারত শতাধিক মানুষকে পুশ ইন করেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক সেখানকার দরিদ্র মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করে বাংলাদেশে পুশ ইন করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। সম্প্রতি গুজরাটের বস্তিএলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক মুসলমানদের উচ্ছেদ করে তাদের বাংলাদেশি বলে তকমা দিয়েছে। মোদি কার্যত দেশের ভেতরে ও বাইরে একটি ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত। এরমাধ্যমে এগারো বছর ধরে ভারতকে ক্রমাগত হিন্দু-ভারতে রুপান্তরের মাধ্যমে একদলীয় হিন্দুত্ববাদী শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী করে চলেছে।
পাকিস্তানের কাছে পারমানবিক অস্ত্র থাকায়; দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ কিংবা সেখানে রাষ্ট্রহীন করে ফেলা মুসলমানদের পুশ ইন করার সাহস পায়না। পাকিস্তান সীমান্তে পাকিস্তানিদের হত্যার বীরত্ব দেখাতে পারে না ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা। এইসব অক্ষমতাজনিত সঞ্চিত বীরত্ব ভারত খরচ করে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ; নিয়মিত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার পর এখন সে রাষ্ট্রহীন করে ফেলা মুসলমানদের বাংলাদেশে পুশ ইন করার সাহস দেখাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানে ইন্ডিয়া আউট সেন্টিমেন্ট ও দেশপ্রেমিক জনতার প্রতিরোধের মুখে ভারত আজ বিতাড়িত সেখান থেকে। দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রশাসন সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একাট্টা থেকে ভারতের হেজিমনিকে পরাজিত করেছে।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশকে পেয়ে বসেছে ভারত। শেখ হাসিনাকে মনপছন্দ সরকার হিসেবে স্থাপিত করে ভারত বাংলাদেশে যে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলো; জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে তা উচ্ছেদ হয়ে যাবার পর থেকে ভারতের রাজনীতিক, সেনা প্রশাসন ও মিডিয়া যেরকম নির্লজ্জ বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে; উপনিবেশ ফিরে পাবার আকুতি তাদের চোখে মুখে।
ভারত তার বাংলাদেশ ল্যাবরেটরিতে জন অভিমত ডিকটেট করতে চায়। যেহেতু সে মনপছন্দ হাসিনা প্রশাসনের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও বানিজ্যনীতি ডিকটেট করতো; ডিকটেশন দেবার নেশায় আসক্ত সে। বাংলাদেশে কবে নির্বাচন হবে, নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী দলটি তার বয়ান ফেরি করবে কিনা, ভারতের প্রতি আনুগত্য কে কে প্রমাণ করতে পারবে সেই জল্পনায় দিল্লি এখন ব্যস্ত।
বর্ষা বিপ্লবের ম্যান্ডেট নিয়ে আসা ড ইউনুসের সরকার প্রথম ভারতের এঁকে দেয়া লক্ষ্মণরেখার বাইরে গিয়ে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও বানিজ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ইউনুসের প্রতি ভারতের আক্রোশ নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ৫৪ বছর ধরে ভারতের কালচারাল ব্যাপ্টিজম করা ছদ্ম প্রগতিশীল বলয়টি গত নয় মাস ধরে ইউনুস বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। ভারতের পলিটিকাল ব্যাপ্টিজম করা আওয়ামী লীগের পতন অবশ্যম্ভাবী হলে; ২০২৪-এর অগাস্টের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে ভারতের বি টিম হিসেবে কালচারাল ব্যাপ্টিজম করা গোষ্ঠীটি জনস্রোতে মিশে গেছে। সেই গোষ্ঠীটি একটি নেসেসারি ইলিউশন দেয়, প্রগতিশীলতার পক্ষে তারা কাজ করছে; অথচ তা নেহাত মোদিশীলতা। ঘুরে ফিরে তারা ভারতের ইসলামোফোবিয়ার বয়ান ফেরি করে। হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগ যেভাবে মৌলবাদের জুজু দেখিয়ে জঙ্গী অভিযানের নাটক করেছে; ফেসবুকে উস্কানি দিয়েছে, জঙ্গীরে ডিম দেও, জঙ্গীরে নিয়া অস্ত্র উদ্ধারে যাও; হাসিনা পতনের পর সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে ভারতের কালচারাল ব্যপ্টিজম করা ছদ্ম প্রগতিশীলেরা।
বাংলাদেশের শিক্ষিত ও অভিজাত শ্রেণীর হিন্দু জনগোষ্ঠী হাসিনা অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছেন। তাদের সন্তানেরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে সবশেষে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী হচ্ছে ভারত ও আওয়ামী লীগের ভিক্টিম। তাদের কাছে অন্ধ আনুগত্য প্রত্যাশা করে কল্পিত রাজনৈতিক প্রভুরা। ফলে যে অভিজাত হিন্দুরা ভারতের হেজিমনির বিরুদ্ধে কথা বলেন; তাদের ওপর নেমে আসে ভারত ও আওয়ামী লীগের খড়গ।
আওয়ামী লীগ নিম্নবর্গের হিন্দুদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একটি তপশীলি প্রগতিশীল ব্রিগেড তৈরি করেছে। এদের দায়িত্ব প্রতিবাদী অভিজাত হিন্দুদের দিকে গোবর ছোঁড়া। মুসলমানদের ক্ষেত্রেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী র কর্মচারিদের উচ্চাভিলাষী ছেলেমেয়েদের একটু সংস্কৃতি করতে শিখিয়ে দ্রুত এলিট হবার ভ্রান্ত স্বপ্ন দেখিয়েছে। এরা শিখেছে ইসলাম নিয়ে তির্যক কথা বললেই প্রগতিশীল হওয়া যায়। চেহারা সুরতে না কুলালেও গালে সুপোরি পুরে কাল্পনিক আর্য হওয়া যাবে। ফলে বাংলাদেশের হিন্দুদের চেয়ে হিন্দুত্ববাদকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে এই নিম্নবর্গের কালচারাল উইং। এরা রেগে গেলেই নতুন শেখা রবীন্দ্র বুলির জায়গায় বেরিয়ে আসে আদি অকৃত্রিম কলতলার ভাষা ও শব্দ।
বাংলাদেশে তপশীলি প্রগতিশীলেরা দশ চক্রে ভগবান ভুত প্রমাণে সক্রিয় থাকে। একটা মিথ্যা একশোবার বলে তা সত্য প্রমাণে সচেষ্ট থাকে। বর্তমানে এদের সমস্ত রাগ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছেলেমেয়েদের প্রতি। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের তরুণ-তরুণীদের একটি অংশকে কোলে টেনে নিয়ে তাদের কালচারাল ব্যাপ্টিজম দেবার কাজ চলছে। ঐ যে যারা ১ ও ২ অগাস্টে বন্ধু সেজে নেমে পড়েছিলো রাজপথে; তারা এখন তাদের আসল চেহারা দেখাচ্ছে। এদের প্যাটার্নটা হচ্ছে, এরা একটি সমাজে অন্যতম হয়ে বাঁচতে শেখেনি। এদের অবচেতনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হবার স্বপ্ন। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে ড ইউনুস কি ভুল করিলেন তা তুলে ধরা আর জাতীয় নাগরিক পার্টির ছেলেমেয়েদের ছিদ্রান্বেষণ এদের গত নয়মাসের কাজকর্মের সারাংশ। এ আসলে ইকুয়ালাইজিং -এর খেলা। এইভাবে সে অতীতে ক্ষমতায় যাবার মাত্র একবছরের মধ্যে বিএনপিকে ব্যর্থ হিসেবে চিত্রিত করেছিলো। নির্বাচন দিয়ে ড ইউনুস চলে যাবার পর যে দল ক্ষমতায় আসবে, এরা আবার তার ছিদ্রান্বেষণ করবে। ভারতের আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন প্রকল্পের নটনটী এরা।
এরা থট কন্ট্রোল বা চিন্তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ভারত বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালালে স্পিকটি নট হয়ে থাকে; কেউ ভারতের হেজিমনির সমালোচনা করলেই তাকেই হিতোপদেশ দেবে, এভাবে বলা ঠিক নয়কো। সুতরাং অগাস্ট ৫-এ ভারতের এ’টিম পালিয়ে গেলেও বি’টিম আপনার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো। সে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুটি কথা বলে আপনার আস্থা অর্জন করেছিলো; কিন্তু ভারতের স্বার্থ উদ্ধারে সে একদিনও বসে থাকেনি। এই ভারত পেলবতা ছাড়া ওর এই প্রগতিশীলতার ভেক, মুখ ব্যাঁকা করে নীতিকথা বলার অভিনয় অসম্পূর্ণ। বাবা-মা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে জন্য ওকে সবসময় নদীয়ার ভাষায় কথা বলতে হয়; দাদার দু’গাছা দাড়ি ছিলো জন্য সারাক্ষণ দাড়ি-টুপি নিয়ে প্রণব মুখার্জির মতো মুখ টিপে হাসতে হয়; অল্প বয়সে ছাপড়ির মতো দেখাতো বলে, এখন খুব গুছিয়ে এমন জমিদার সেজে থাকতে হয়। ওর প্রতিশীলতার সনদটি এসেছে হিন্দু কলেজের বেঙ্গল রেনেসাঁর কাছ থেকে; তাই শয়নে স্বপনে জাগরণে সে অখণ্ড ভারতের মৃন্ময় ও চিন্ময় হতে চায়।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।