মাসকাওয়াথ আহসান
সমকালে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির যে রাজনীতি, তা এক অর্থে ভ্রান্ত ক্লাস স্ট্রাগল বা শ্রেণী সংগ্রাম। গোটা পৃথিবী যখন ইন্টারনেটভিত্তিক সাম্যচিন্তার চর্চা করছে; এদের তখন ঘন ও স্যাঁতসেতে কাস্ট সিস্টেম সৃজনের নেশা লেগেছে।
নেহেরুর কংগ্রেস এমনকী বাজপেয়ীর বিজেপিও ছিলো ভারতের এলিটদের রাজনীতি। সুহরোয়ার্দী এবং মুজিবের আওয়ামী লীগও ছিলো বাংলাদেশের এলিটদের নিয়ে রাজনীতি। কেবল অভিজাত শ্রেণী আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের দিয়ে শাসন কার্য পরিচালনা করতে চেয়েছেন তারা। এ সেই ফ্রিডেরিশে নিটশে ও বার্নার্ড শ’র ম্যান এন্ড সুপারম্যানের ধারণা। জিয়া ও খালেদার বিএনপি, এরশাদের জাতীয় পার্টি একইরকম এলিট কেন্দ্রিক রাজনীতি।
২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমান প্রথম প্রান্তিকদের নেতা করেন। কারণ তারেক মনে করতেন, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালাতে পারে যে, দেশ চালানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। নতুন পয়সাওয়ালা প্রান্তিকেরা ক্ষমতা হাতে পেয়েই বি চৌধুরীকে ক্ষমতা থেকে সরায়। এটা সত্যজিত রায়ের “জলসাঘর” চলচ্চিত্রের মতো পুরোনো এলিট সরিয়ে নতুন এলিট তৈরির রাজনীতির কারখা্নাতে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনাও মনে করতে শুরু করেন, চিন্তার আভিজাত্য দিয়ে আর কী হবে; নতুন পয়সাওয়ালাদের হাতে রাজদণ্ড দিতে হবে; যারা টাকা ছড়িয়ে ভোট কিনতে পারবে। প্রয়োজনে একটি নতুন এলিট শ্রেণী তৈরি করতে হবে। একটু পয়সাকড়ি, একটা নতুন বাড়ি, মুঘল আমলের মতো পর্দা, সৌদি আরবের মতো সোফা। পূর্ববঙ্গের প্রান্তিক হিন্দুরা যেহেতু আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছে; তারা একটু রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে, পুজো-আর্চা করে সেকুলার সংস্কৃতির আবির ছড়াবে।
এই ধরুন আমাদের সমবয়েসী ছেলে-মেয়ে; বাম রাজনীতি করতো; ধর্ম-কর্ম তেমন করতো না; আমরাও যেমন উতসবে আছি কিন্তু নিয়মিত ধর্ম অনুশীলনে নেই। ফলে মানুষ হিসেবে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে; তারা কালচারাল এলিট হবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। এখন হুট করে তো কালচারাল এলিট কেউ হয়না; যদি ভেতরে ধর্মের কুঁচকুঁচানি থেকে যায়। ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর; এরা ১৭৯৩-এর কর্নওয়ালিশের বালিশ পেতে এমন ভাব করতে চেষ্টা করলো; যেন ১৯৪৭ সালে সে জমিদারি হারিয়েছে। লক্ষ্য করুন; সে বর্তমানে আওয়ামী কালচারাল এলিট হয়েই সন্তষ্ট নয়; সে তার কাল্পনিক অতীত বিনির্মাণ করে নিজেকে সত্যজিত রায় কিংবা অমর্ত্য সেনের জায়গায় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করছে। মেধার লিলিপুটের গালিভর সাজার কষ্টকল্পনা যেন।
আমি কখনো খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে গিয়ে প্রশ্ন তুলিনি, ছুটি কেবল খ্রিসমাসে কিংবা ইস্টারে কেন; আমাকে ঈদের ছুটি কেন দিচ্ছেন না! ঈদের রাতে নিউজরুমে নাইটশিফট করেছি। কারণ আমার মধ্যে ধর্মের কুঁচকুঁচানি নাই। ধর্ম থাকে জীবন দর্শনে মিশে; আধ্যাত্মিকতায়; বরং প্রাগৈতিহাসিক পোশাক পরে ধর্মীয় রিচুয়ালকে আমার আদিবাসী কালচার মনে হয়। আমি বিশ্বের চোখে অমন দর্শনীয় নৃগোষ্ঠীর এক্সটিক নৃত্য হতে চাইনা। একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই।
কিন্তু ঐ যে আমার বাল্যবন্ধু-বান্ধবী; বেশ কিছু সার্টিফিকেট; বুদ্ধিজীবীর ভং; ডিসকোর্স নিয়ে আলোচনা; শৈশবে যে বামপন্থী ছিলো; সে আজ প্রবল রামপন্থী হয়ে প্রশ্ন তুলছে, পুজোর দিনে ফিলিস্তিনিদের জন্য শোকদিবস করলেন কেন! খানিকটা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যের স্বপ্রণোদিত নেতার ভেক ধরে জিজ্ঞেস করলো, প্রবারণা পূর্ণিমার দিনে বিএনপির মহাসমাবেশ কেন!
আমারই অসংখ্য হিন্দু-বৌদ্ধ বন্ধু; যারা শৈশবে বামের ভং করেনি; তারা কিন্তু এতোটুকু রামপন্থী হয়নি। নান্দনিকভাবে পুজো ও প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন করেছে; যার পুরোটা জুড়েই সত্য সুন্দর ও মঙ্গল। আর তারা ফিলিস্তিনিদের কষ্ট বোঝে; কিংবা স্বদেশে ফ্যাসিজমের লৌহ গরাদে প্রায় হয়ে ওঠা প্যালেস্টাইন; এই বেদনা অনুধাবন করার মতো যথেষ্ট সমানুভূতি তাদের রয়েছে।
কিন্তু যে কখনো ধর্মেই ছিলো না; সে এখন বজরঙ্গী বোন হয়েছে; অপারেশন জিরো কস্টের আদলে। সে একটা কাল্পনিক জমিদারি কায়েমের নেশায় উত্তাল। এ তার কষ্টকল্পিত শ্রেণী সংগ্রাম।
আওয়ামী লীগের শাসনমালে লুন্ঠনের পথ খোলা রেখে আমব্রেলা ইঞ্জিনিয়ারের ছেলেকে দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকানের মালিক করা হলো; যাকে কিন্ডারগার্টেনে পড়াতে দিলে বাচ্চাদের ক্ষতি হবে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করা হয়েছে। লীগের নেতা দেলোয়ারকেন্দ্রিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন “স্যার ডাকের আকুতি ভরা” লোকেদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছে। ইন্টেলিজেনশিয়ার এপারথেইড ঘটিয়ে শেখ হাসিনা লোয়ার আইকিউদের পুনর্বাসিত করেছেন। তিনি কিন্তু এটিকে তার স্টাইলের সাব-অলটার্ন মুভমেন্ট ভাবছেন।
অথচ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ; যেখানে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষ আমাদের সংগীত ও কবিতাভিত্তিক প্রত্ন চরিত্রের কারণে মেধার মূল্যায়নকে পছন্দ করেন। একটা ছেলে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে শুনলে একজন রিক্সাচালক তাকে অভিনন্দন জানান। একটা মানুষ ভালো গান গাইতে পারলে তাকে ফ্রিতে চা খাওয়ান একজন চা বিক্রেতা। এই যে মেধা ও সৃজনশীলতার বাংলাদেশের মানুষের আজন্ম লালিত ভালোবাসা; যে কারণে বাংলাদেশের একটি ছেলে সমুদ্র সাঁতরে ইউরোপে পৌঁছালেও সফল হয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমটিই ধরুন পঞ্চপান্ডবের উত্থানকালে কত সম্ভাবনাময় দল হিসেবে বিকশিত হচ্ছিলো। যেই তাদের গণভবনে ডেকে দাওয়াত খাওয়ানো হলো; অমনি তাদের মনে এমপি হবার স্বপ্ন জারিত হলো। এই যে আওয়ামী লীগের একটি ধর্মের আদলে সবাইকে কনভার্ট করার আকাংক্ষা; এটি বাংলাদেশের ক্রীড়া-শিক্ষা-সাংবাদিকতা-সংস্কৃতি এবং প্রগতির পথে যা কিছুতে উতকর্ষ দরকার তাকে বনসাই করে দিয়েছে।
ভারত একটি অনেক বড় আয়তনের দেশ আর ওখানে মেরুদণ্ডী নাগরিক সমাজের শক্তি প্রবল বলে; নরেন্দ্র মোদী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শ্রেণী সংগ্রাম বলে অশিক্ষা ও অযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হননি। ইতিহাস নিয়ে দলীয় মুজরা করতে গিয়ে হাসাহাসির পাত্র হয়েছেন মোদী। ফলে মেধা ও যোগ্যতা এপারথেইড করে বিজেপির রকের ছেলেদের পদ-পদক-প্লট দেয়া ততোটা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ঠিক গোপাল ভিলেজের আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করায়; বোয়ালমারীর মনীষা, চিতলমারীর ক্রীড়া, হরিদাসপুরের সংস্কৃতি, গওহরডাঙ্গার মদিনা সনদ, পাটগাঁতির চাণক্যনীতি, ঠোঁঠা বাজারের অর্থনীতি; এই দিয়ে সাজানো হয়েছে আমব্রেলা রিপাবলিকের ভাঙ্গাচোরা বুদ্ধিবৃত্তি ও বিকাশ।
ফেসবুকে দেখবেন, ঠিক কীরকম লোকেরা ক্রসফায়ার ও গুম সমর্থন করে; কোন সংঘর্ষে তিন জন নিহত হলে; একটি লাশ কীকরে বেছে নিয়ে মানবতার মাতম করে। দেখবেন কেমন বেসুরো রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত গায়; আর কী রকম কষ্টকল্পিত শেক্সপিয়ার বিষয়ক দাঁতভাঙ্গা আলোচনা করে।
হিন্দুধর্মের কাস্টসিস্টেম ভারতীয় মনীষা ও দর্শন আলোচনার ঔজ্জ্বল্যে প্রায় তিরোহিত। এখনো যারা জাত-পাত নিয়ে পড়ে আছে; তারা অনগ্রসর ও অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে বিবেচিত। যার কিছু নেই; সে পড়ে আছে জন্মসূত্রে পাওয়া একটি লোকজ পরিচয়ের কাঁথা গায়ে।
অথচ এই কাস্ট সিস্টেমই বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ প্রত্যেকের মধ্যে প্রবল এক তোলপাড় তুলে চলেছে আওয়ামী লীগের আমলে। শেখ হাসিনা নিজহাতে কাস্ট বিনির্মাণ করছেন। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন ব্রান্মণ, সেনা-পুলিশে লীগের লোকেরা ক্ষত্রিয়, বিসিএস হচ্ছে কায়েস্থ, আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী হচ্ছে বৈশ্য। আর যারা লীগের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি অভিমত মেলাতে অক্ষম তারা কাস্ট চ্যুত। লীগের পোষা সেন্টার ফর ইন্টেলিজেন্স (ক্রাই)-এর ডোমেরা আছে তাদের দিকে চিন্তামল ছোঁড়ার জন্য।
লীগের তৈরি করা সংস্কৃতি পুরোহিত শ্রেণীটি দেখবেন; এমন করে নিজেদের একটি বৃত্ত রচনা করেছে; ঠিক যেন সেই চৌধুরী বাড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “কেউ কথা রাখনি” ছিলো এদের প্রিয় কবিতা। এরা চৌধুরী বাড়ির রাস উতসবের দিকে টুল টুল করে তাকাতো। এখন তাই নিজেরাই আওয়ামী চৌধুরী হয়েছে। তাদের ফেসবুক পোস্ট ও এর মন্তব্যে জুলেখাদের মাটিতে পা না পড়া ভাবচক্কর দেখে মহতের লজ্জা পাই।
পৃথিবী এগিয়ে গেছে নিরহংকার সাম্যচিন্তায়। সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু সাম্যভাবনা প্রবর্তনের সামাজিক প্রয়াস। পশ্চিমের ১০১টি দোষ খুঁজে বের করলেও কিছু জিনিস তো তারা অর্জন করেছেই। কল্যাণরাষ্ট্র, সাম্যভাবনা, সাদাসিধে জীবন যাপন দর্শন (মিনিমালিজম)। সেইখানে আওয়ামী লীগ পড়ে আছে তার ১৭৯৩-এর লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর বালিশের খোঁজে; লীগের নিও এলিটেরা আছে ঠাকুর বাড়ির পোশাক আষাকে। আর দেশের সম্পদ লুট করে স্লামডগ বিলিওনিয়ার বানানোর আত্মঘাতী শ্রেণী সংগ্রামে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।