গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজীম
স্বৈরাচারকে ঘায়েল এর অস্ত্র হিসেবে রেমিট্যান্স শাটডাউন অসহায় জনতার অল্প কিছু শেষ সম্বলের মধ্যে যেমন একটা, তেমনি এর আত্মঘাতী নানা দিকও আছে! এই নিয়ে কয়েক দিন দ্বিধায় ছিলাম।
নানা বিচার বিশ্লেষণ করে এবং ঢাকার পথে পথে নৃশংস খুনের ছবি দেখে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলেছি।
খেয়াল করে দেখবেন, সরকার ইন্টারনেট শাটডাউনের মধ্যে প্রথম যে মিটিং এর ছবিটা ছেড়েছে তা ছিল তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে। এরপরের মিটিং হল এলিট ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে।
জনতাকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করতে করতে সরকার তার ক্রোনি ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করছে, তোমাদের ভয় নাই। আমাদের সাথে থাকো।
এই ব্যবসায়ীরা কারা? ব্যাংক লুটেরা, আমাদের পাঠানো রেমিট্যান্স এর সুফলভোগী টাকা পাচারকারী, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় করা উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার, বিদ্যুতকেন্দ্রের মালিক ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনি দুবাই কিংবা কাতার অথবা মালয়েশিয়া থেকে এক মাস কাজ করে যে টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠান, সেই ডলার তারা এক রাতের জন্য সিংগাপুর কিংবা ইউরোপে বেড়াতে গিয়ে হোটেলের রুম ভাড়া দেয়। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স এর শ্রেণিচরিত্র!
গত এক সপ্তাহে দেখেছি- আওয়ামী লীগ-পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আর্মি-ব্যবসায়ী এই কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার লড়াই এক ভীষণ অসম লড়াই!
অসম লড়াইতে একিলিসের হিল খুঁজে আঘাত করতে হয়!
প্রবাসীরা ইতোমধ্যে সেটা খুঁজে পেয়েছেন। রেমিট্যান্স শাটডাউন।
এর ফলে আগেই লুট হয়ে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ শূন্য হয়ে গেলে দেশে মূল্যস্ফীতি, দেউলিয়াত্ব, বেকারত্ব ইত্যাদি হবে, আপনারা সবাই জানেন।
তাহলে কী করবেন? ডলার, রিয়াল, দিরহাম পাঠাতে থাকবেন- আপনার সন্তানকে গুলি করার বন্দুক কেনার জন্য? আর যাতে সেই খুনী সৈন্যকে বেতন দেয়া যায়?
যাতে আপনার খাজনার টাকা নিয়ে লুটেরাদের সন্তানরা আমেরিকা ইউরোপে থাকে দুধেভাতে?
কতদিন? কতকাল দিতে থাকবেন?
এইদিকে গত সপ্তাহের পর লুটেরারা ব্যাপক ভয় পেয়েছে। আমার অনুমান ব্যাংক ও লেনদেন খুলে দিলেই লুটেরা রাজনীতিবিদ আর আমলারা, এবং এলিট ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পদের বড় অংশ দেশ থেকে সরিয়ে ফেলা শুরু করবে। এই সপ্তাহে তারা জেনে গেছে জনতার মাঝে বাতাস উলটে গেছে, এরপর কোন এক ঝড় তাদের টাকা সরানোর পর্যাপ্ত সময় নাও দিতে পারে। ফলে হুন্ডির আউট ফ্লো এর চাহিদা এমনিতেই বেড়ে যাবে।
এই অবস্থায় আপনি রেমিট্যান্স প্রেরণ চালিয়ে গেলে আসলে এদের পকেটে সেই ডলার তুলে দিতে থাকবেন!
চাইলে দিতে থাকেন, আপনার সিদ্ধান্ত।
না দিতে চাইলে, প্রশ্ন হল কতদিনের জন্য রেমিট্যান্স শাটডাউন?
২০২৪ এর এপ্রিলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন।
গত বছরে দেশে রেমিট্যান্স গেছে ২৩ বিলিয়ন ডলার। গড়ে মাসে ১.৯ বিলিয়ন।
আমাদের ধারণা- এটাকে আগামী ছয় মাসে গড়ে প্রতি মাসে ০.৫ বিলিয়নে নামিয়ে আনতে পারলে আপনি এই শাটডাউনের তীব্র প্রতিক্রিয়াগুলো দেখতে পারবেন।
মানে এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে যা যায় তার তিন ভাগের দুই ভাগ হ্রাস করতে হবে অন্তত।
এর ফলে প্রথম তিন মাসের মধ্যেই প্যানিকে আর্থিক খাতের সব পলিসি এলোমেলো হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে! ন্যূনতম তিন থেকে ছয় মাস এই বয়কট ধরে রাখতে হবে।
এই বয়কটের প্রতিক্রিয়াগুলো কী হবে? অনেক কিছুর মধ্যে তিনটি সম্ভাব্য ঘটনা হতে পারে, যা এই ক্রোনিদের কোয়ালিশনকে এলোমেলো করে দেবে-
- ডলারের সংকটে এই লুটেরা এলিট ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারবে না, রপ্তানিকারকরা কাঁচামাল আনতে পারবে না, আমদানিকারকরা প্রচন্ড চাপে পড়বে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ব্যবসায়ী মহল সরকারের উপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নিতে শুরু করবে। (কিন্ত বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষ আরও চাপে পড়বে)
- সরকার আমার আপনার ভবিষ্যতকে দেনাগ্রস্ত করে লুটের জন্য নতুন নতুন মেগা প্রকল্পের বিদেশি ঋণ সহজে পাবে না। এর দুইটি পজিটিভ দিক- ১। নতুন করে লুটের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দেশের উপর ঋণের চাপ বাড়ানো কঠিন হয়ে যাবে, ২। এবং সেই উন্নয়নের টাকা নিজেদের দলের লোকজন, ক্রোনি ব্যবসায়ী, আমলা ইত্যাদিকে দিয়ে সবাইকে পেলে পুষে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
- তেল-গ্যাস-জ্বালানি আমদানির পেমেন্ট করতে পারবে না, ফলে শিল্পখাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ধ্বসে পড়বে। কারখানার মালিক ও শ্রমিক, উভয়েই তখন পথে নেমে আসবে।
গত দশকে রপ্তানি আর রেমিট্যান্স এর এত প্রবৃদ্ধির পরও বিপুল টাকা পাচারের কারণে ডলারের সংকট আগেই ঘনীভূত হচ্ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও এটাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা, যার সমাধানের কোন ফর্মুলা আপাতত এদের কাছে নেই!
কিন্ত এই শাটডাউন কনসিসটেন্টলি ধরে রাখতে হবে। অন্তত তিনমাস!
মনে রাখবেন, যে রাজার কোষাগার শূন্য, তাকে তার সৈন্যরা ছেড়ে যায়
গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজীম, উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক