মাসকাওয়াথ আহসান
আইকিউ বা বুদ্ধাংক সংক্রান্ত বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হই শৈশবে। আব্বা দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। তিনি নানারকম মনোসমীক্ষা আমাকে খেলাচ্ছলে শেখাতেন। তিনি কতকগুলো ছবি দেখিয়েছিলেন, বিভিন্ন আইকিউ-এর মানুষের মাথার খুলি কেমন হয়। শিখিয়েছিলেন, কী করে নিজেই নিজের আইকিউ পরীক্ষা করা যায়। তিনি বলেছিলেন, পুষ্টি প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে আইকিউ। পুষ্টির অভাবে ও শোষণ-বৈষম্যমূলক পরিবেশে মেধা বিকাশ বিঘ্নিত হয়।
আমার এই স্মৃতিচারণের উস্কানিটুকু এসেছে অনুজপ্রতিম বিতার্কিক সাকিব প্রত্যয় ও হাসনাথ এ কালামের দুটি আলোচনা থেকে। ই-সাউথএশিয়া স্যাটায়ার শো’র আলোচনায় “চিন্তা না করে কথা বলার” অভ্যাসের জন্য নিম্ন বুদ্ধাংককে কারণ হিসেবে খুঁজে পেয়েছে সাকিব। হাসনাথ এ কালাম আমাদের ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি আর যে কোন বিষয়ে রবাহূত হয়ে দৌড়াদৌড়ির পেছনে আমাদের গড় আই কিউ কম হবার বিষয়টি খুঁজে পেয়েছে।
এই যে দক্ষিণ এশিয়ার গড় আইকিউ কম হওয়া; বিশেষত আমাদের শ্রীখণ্ডে আইকিউ কম হবার পেছনে একটি করুণ ইতিহাস আছে। কলকাতার ইতিহাস গবেষক বিশ্বেন্দু নন্দের গবেষণা থেকে সে ইতিহাস খুঁজে পেয়েছি। সুলতানী ও নবাবী আমল পর্যন্ত এসএম সুলতানের পেশীবহুল পুরুষ আর স্বাস্থ্যবতী নারীর সমাজ ছিলো পূর্ব বঙ্গ। সেসময়ের কৃষকেরা কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে বিভিন্ন জাতের ধান ও অন্যান্য খাদ্য শস্য উদ্ভাবন করেছিলেন। চট্টগ্রামে ছিলো জাহাজ নির্মাণ কারখানা। পূর্ব বঙ্গের প্রকৌশলীরা বানিজ্য জাহাজ নির্মাণ করতেন; আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সওদাগরেরা এখান থেকে জাহাজ কিনতেন। পূর্ব বঙ্গের টেক্সটাইল প্রকৌশলীরা মসলিনের মতো জগত বিখ্যত বস্ত্রের উদ্ভাবক ছিলেন। তরবারির ফলা ও খাপ তৈরির জন্য সুখ্যাতি ছিলো আমাদের অস্ত্র প্রকৌশলীদের। চিকিতসা ক্ষেত্রে স্থানীয় হেকিমেরা ভেষজ ও ঔষধি বৃক্ষ থেকে তৈরি করতেন নানা রোগের ওষুধ। এইখানে সম্পন্ন কৃষক ও কারিগর সমাজে সঙ্গীত, কবির লড়াই, গীতিকবিতা মিলিয়ে মিউজিক্যাল থিয়েটারের নানা অনুশীলন ছিলো। হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমানদের স্ব স্ব ধর্ম পালন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিলো। শাসক গোষ্ঠী ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বিবেচনা না করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে রাজকর্মচারী নিয়োগ করতেন। কৃষক ও কারিগরের ওপর অযৌক্তিক শুল্কের বোঝা চাপানো হতো না। সওদাগরের সঙ্গে যে কোন চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবার স্বাধীনতা ছিলো কৃষক ও কারিগরের।
আজকের রাজশাহী শহরটি তখন মহাকালগড় হিসেবে পরিচিত ছিলো। এ ছিলো শিক্ষানগরী। সংস্কৃত ও ফারসি পণ্ডিতদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার নগরী ছিলো এটা। লক্ষণাবতী বা লখনৌতির অধীনে যে ছোট ছোট রাজা বা জমিদার ছিলেন; তাদের বসবাসের জনপদ ছিলো এটি। কৃষকদের সঙ্গে তাদের ছিলো মানবিক সম্পর্ক। এরা জানতেন, কৃষক ও কারিগরই হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। সুতরাং তারা যদি খেয়ে পরে আনন্দে বাঁচে; তবেই রাজ শাহীদের জীবনের জৌলুস বজায় থাকবে। কবি আমির খসরু ১২৭৯ সালের দিকে আজকের রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সোনারগাঁ ভ্রমণ করে সমৃদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির এই জনপদ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলা বিহার উড়িষ্যার জনমানুষের দুর্ভাগ্য উপস্থিত হয়। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, জগতশেঠের মতো কোলাবরেটর আর মীর জাফরের মতো পুতুল নবাবদের নিয়ে কৃষক ও কারিগর শোষণ শুরু করে। কৃষকদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, কারিগরদের “ঢাকা আড়ং” ভেঙ্গে দিয়ে ভুখা মিছিল তৈরি করে। দাস তৈরির নরভোজি খেলার সেই শুরু। এসময় বৃটিশ ও তাদের স্বদেশী কোলাবরেটরদের তৈরি দুর্ভিক্ষে এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। সেটাই ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম গণহত্যা। এই গণহত্যার কোলাবরেটরদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর মাধ্যমে লর্ড কর্নওয়ালিশ পূর্ব বঙ্গে একটি সহমত ভাই জমিদার শ্রেণী তৈরি করে। এই জমিদারেরা পূর্ব বঙ্গের প্রজা শোষণ করে কলকাতায় সেকেন্ড হোম তৈরি করে। নব্য জমিদার তনয়েরা ইংরেজি শিখে সংস্কৃত ও ফারসি শিক্ষিত মানুষকে “অশিক্ষিত ও মূর্খ” বলে তকমা দেয়। বৃটেন থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা ভ্যাগাবন্ড ইংরেজ আর তাদের স্বদেশী ভ্যাগাবন্ড কোলাবরেটরেরা মিলে, বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি শিক্ষিত জনগণকে হীন মানুষ, নীচ মানুষ ইত্যাদি তকমা দিয়ে তাদের মানসিক শক্তি ভেঙ্গে দেয়া হয় ক্রমাগত।
কলকাতায় একটি কৃত্রিম সংস্কৃতি সৃষ্টি করে সেটাকে আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে লেগে পড়ে বৃটিশ বিদূষক বাঙালি লেখক ও তেলাঞ্জলি নির্ভর ইতিহাস রচয়িতারা। মধ্য এশিয়া ও দূর প্রাচ্যের অভিবাসীদের সঙ্গে শংকরায়নে সৃষ্ট সামান্য উজ্জ্বল বর্ণের লোকেদের মধ্যে তখন ভ্রান্ত আর্য স্বপ্নপ্রসূত এক ধরনের উন্মাদনা তৈরি হয়, বৃটিশদের সামনে নিজেদের সুপিরিয়র জীন হিসেবে উপস্থাপন করার অভিপ্রায়ে। বৃটিশের মাসহরা খেয়ে পেটমোটা ও কাঁধে গোশত লেগে পৃথুল শরীরের সামান্য উজ্জ্বল বর্ণের লোকগুলো নিজেদের আর্য বংশোদ্ভুত পরিচয় দিয়ে পূর্ব বঙ্গের জনমানুষকে নিম্ন বর্গের বলে ছোট করতে শুরু করে বৃটিশ প্রচার কৌশলকে ব্যবহার করে।
বোম্বের শাড়ি নিয়ে এসে শংকরায়নে উজ্জ্বল বর্ণের কিছু নারীকে সাজিয়ে ও বৃটিশ উন্নয়নের সরকারের দেয়া ব্লাউজ পরিয়ে “বাঙালি অভিজাত নারী”-র অবয়ব তৈরি করা হয়। অথচ পূর্ব বঙ্গের বাঙালি নারীর শিল্পিত রুপ ও সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য্যের দেখা পাওয়া যায়; ময়মনসিং গীতিকার নারী চরিত্রের বর্ণনায়, পটচিত্র, পোড়ামাটির শিল্পে। বৌদ্ধ-হিন্দু ও মুসলিম শাসনের সময়ের নানা উপাখ্যানে অভিজাত মনের আত্মবিশ্বাসী নারীর দেখা মেলে। মনে রাখা দরকার যে, এই জনপদে নারীর জমির উপর অধিকার ছিলো; সে নিজে গিয়ে খাজনা দিতো বৃটিশ আগমনের আগে পর্যন্ত; সে আসলে পশ্চিমের নারীদের অনেক আগেই সমাজে সমান অধিকার পাওয়া নারী। কৃষিকাজ ও কারিগর পেশায় তাদের অংশগ্রহণ ছিলো সহজাত; এরা বৃটিশের কল্পিত কলকাতা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির কথিত কোলাবরেটর শ্রেণীর নারীর চেয়ে অনায়াসে উতকৃষ্ট ছিলো। পূর্ববঙ্গে ছিলো স্বাধীন স্বাবলম্বী নারী। কোলাবরেটর স্বামীর উপার্জনে রুপচর্চা করা আর গলা ফুলিয়ে ঘোরা নারী নয়।
একদিকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে; অন্যদিকে নিম্নবর্গের বলে ছোট করে; গভীর স্বাস্থ্যগত ও মানসিক বিভ্রমে ফেলা হয় বাংলাদেশের মানুষকে। সম্পন্ন মানুষকে পথে বসিয়ে, অনাহারে রেখে, পুষ্টিবঞ্চিত করে, এরপর দাস হিসেবে নিয়োগ করে; প্রতিবাদী হলে পিটিয়ে কারাগারে ছুঁড়ে দিয়ে ও হত্যা করে; বৃটিশ ও তার কোলাবরেটরেরা উজ্জ্বল বুদ্ধাংক বা আইকিউ-এর মানুষকে ক্রমে ক্রমে নিম্ন বুদ্ধাংকের মানুষে রূপান্তর করেছিলো তাদের শাসন শোষণের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজনে।
এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি উপনিবেশ ২৩ বছর ও ভারতীয় ছায়া উপনিবেশ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থা চালু রেখেছে। নেহাত শেরে বাংলা ও ভাসানি কৃষক প্রজাদের নিয়ে আন্দোলন করে কলকাতা কেন্দ্রিক বৃটিশ কোলাবরেটরদের হাত থেকে পূর্ববঙ্গকে মুক্ত করেছিলেন আর সুহরোয়ার্দি ও শেখ মুজিবের মতো নেতারা রাওয়ালপিন্ডি কেন্দ্রিক পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শোষকদের হাত বাংলাদেশকে মুক্ত করেছিলেন বলে; আজো একটি মানচিত্র ও পতাকা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে।
(এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে পূর্ববঙ্গের নারী)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।