মাসকাওয়াথ আহসানঃ
স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা ৫৪ বছর ধরে ষড়যন্ত্রের গল্প শুনছি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে; সেই দলের অনুসারীরা প্রতিদিন সকালে একটা করে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। চুনো পুঁটিকে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু ষড়যন্ত্র বা কন্সপিরেসি মোটেই চুনো পুঁটির সাধ্যের মধ্যে থাকার বিষয় নয়।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সাধারণ মানুষের অভিমতের ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তন হয়। অথবা সরকারের স্বৈরাচারি আচরণে বিরক্ত হয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকার পরিবর্তন ঘটায় সেই সাধারণ মানুষ। সেখানে যেসব ষড়যন্ত্রের গল্প চাউর হয়; তা আসলে ভূত-প্রেতের গল্পের মতোই বিনোদন বিশেষ।
ষড়যন্ত্র করতে গেলে ভারতের প্রয়াত নেতা প্রণব মুখার্জির মতো উচ্চ বুদ্ধাংক ও ক্ষমতা থাকতে হয়; জেনারেল মইন উ আহমেদের মতো ক্ষমতা থাকতে হয়। তারা ওয়ান ইলেভেনের সময় যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, সেখানে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারেরা কেবল দাবা খেলার বড়ে ছিলেন; তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিলো। কারণ তারা পদাধিকার বলে রিটার্নিং অফিসার ছিলেন।
ষড়যন্ত্র করার মতো বুদ্ধাংক শেখ হাসিনারও নেই। তিনি প্রণব মুখার্জির বুদ্ধাংক ধার নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে দিল্লির সাউথ ব্লকের দাবা খেলার বড়ে হিসেবে কাজ করেন। তিনি যেহেতু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী; দিল্লির কথা শোনেন, ভাটিয়ালি আবেগে উজাড় করে দেন বাংলাদেশের স্বার্থ; ফলে তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করেন ভারতের দাক্ষিণ্যে।
ষড়যন্ত্র করার মতো বুদ্ধি বিএনপির কোন নেতা-নেত্রীর নেই। এই বুদ্ধি থাকলে তারা ২০০৮-২৪ পর্যন্ত পড়ে পড়ে মার খেতো না। ষড়যন্ত্র করার বুদ্ধি জামায়াতের নেতাদের রয়েছে। কারণ তারা বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত সতরাঞ্জ কি খিলাড়ির আসরে ঘোড়ার মতো আড়াই ঘরের খেলা খেলতে শিখেছে। একইরকম ক্ষমতা বামপন্থীদের রয়েছে। তারা হচ্ছে দাবা খেলার আসরের ন্যারেটিভ মামা। এরা দাবা খেলার সময় প্রতিপক্ষকে গল্পে ব্যস্ত রেখে খেলায় এগিয়ে যায়। কিন্তু ফিনিশিং দিতে পারে না। জামায়াত ও বামদের রাজনীতি ব্রাজিলের মতো সাজানো ফুটবল যা দেখতে ভালো লাগে; কিন্তু প্রতিপক্ষের কাছে ৭-১ গোলে হেরে মুখ কালো করে বসে থাকাই এদের অভ্যাস। এরা নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক; গরীবের ছেলেকে সাম্যের স্বপ্ন দেখিয়ে গ্ল্যাডিয়েটরের ভেড়ার মতো ব্যবহার করে।
ষড়যন্ত্র করতে সক্ষম ভারতের রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি। তিনি জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হতেই বলে দেন, এটা হিজবুত তাহরীরের বিপ্লব। কিন্তু বীণার মতো আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তা রিপাবলিক বাংলার ময়ূখ কিংবা আজতাক চ্যানেলের হিন্দুত্ববাদী দিদিদের না থাকায় তারা বীণা সিক্রির তৈরি ন্যারেটিভের এক্সিকিউশানে ফেইক নিউজ আর প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে লেজে গোবরে করেছে। বাংলাদেশে যে কট্টর আওয়ামী ক্যাডার ও হিন্দুত্ববাদী ক্যাডার বীণা সিক্রির ন্যারেটিভ প্রচার করে; তাদের আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তা ময়ূখের মতো হওয়ায় আজকাল ক্লাউনের মর্যাদা পেয়েছে।
বীণা সিক্রির পোষা চারটে লালঘোড়া উপহার নিতে যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লোক দিল্লিতে না যাচ্ছে; ততদিন পর্যন্ত চলমান ষড়যন্ত্রে ভারতীয় ছায়া উপনিবেশ কায়েমের সম্ভাবনা নাই। বাংলাদেশের জনমত যেহেতু হাসিনার ফ্যাসিজমকালে ভারত বিরোধী হয়ে পড়েছে যৌক্তিক কারণে; তাই প্রতি অভ্যুত্থানের আর কোন সম্ভাবনা নাই। এখন ভারতের মনের আশা সামনে ইলেকশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করে রিটার্নিং অফিসারের এক্সিকিউশানে কিছু ভারতপন্থী ভেড়াকে সংসদের গ্ল্যাডিয়টরে প্রবেশ করানো যায় কীনা। এই ভেড়া জামায়াত, বাম ও বিএনপি সব জায়গায় আছে। একে ল্যাম্ব ট্রেডিং বলা হয়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ ও নাগরিক কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে; যেভাবে বুড়ো ভামদের কোন পরামর্শ না নিয়ে জুলাই বিপ্লবকে সফল করেছে; একইভাবে এই বিপ্লব সম্পন্ন করা। বুড়োদের বুদ্ধি শুদ্ধি হচ্ছে সব আওয়ামী লীগের বুদ্ধি; আওয়ামী লীগের লাথি খেয়ে বুড়োরা এন্টি আওয়ামী লীগ হয়। কিন্তু তার পলিটিক্যাল ডিসকোর্স হয় হুবহু আওয়ামী কালচারের। আওয়ামী কালচারের পলিটিক্স মানেই তকমা দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারানো, গালাগাল দিয়ে প্রবীণদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা হারানো, আর ভাংচুর করে নৈরাজ্য সৃষ্টি। এইসব আওয়ামী অস্থির আদু ভাইদের এন্টি আওয়ামী লীগ প্রতিশোধ কাহিনীতে বাংলাদেশের উত্তরণ নেই।
বরং বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ ও নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যে মৌলিকত্ব রয়েছে; একমাত্র তাই পারে ভারত প্রযোজিত আওয়ামী কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে। মানুষের চিন্তা জগত থেকে আওয়ামী ফ্যাসিজম ও বর্বরতা সরাতে ঐক্যবদ্ধ সত্য ও সুন্দরের আলাপ আমাদের সমাজে বেশি প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ দ্রুত ধনী হবার দুর্নীতি বসন্ত আয়োজন করে যেভাবে টেকাটুকাকে সাফল্যের সংজ্ঞা হিসেবে নির্ধারণ করেছে; সেটা গুঁড়িয়ে দিয়ে জ্ঞানভিত্তিক জীবনকে সাফল্যের সংজ্ঞা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড ইউনুস সরকার সমালোচনাকে প্রথম থেকেই স্বাগত জানিয়ে আসছেন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের মতো সমালোচনা করলেই প্রজাকে ধরে আনার মনোজগত রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন পদ পদবীধারীদের। আওয়ামী লীগের নতুন জমিদারদের ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যারাম; আজ তাদের কলকাতা দিল্লির পথে ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘুরে বেড়ানোর জীবন দিয়েছে। অথচ পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অগ্রসর বংশগতির পদ পদবীধারী লোকেরা এতো ভাবমূর্তি রক্ষার তোয়াক্কা করেনা। যে লোকটা নিজে নিজের সম্মান রক্ষা করে চলে; সে কলতলার লোকের গোবর ছোঁড়াকে গুরুত্ব দেয়না। আমাদের বংশগতি শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকায়, আমাদের শুধু ইজ্জত যাবার ভয়। লোকে কি বলবে বা পাছে লোকে কিছু বলে জাতীয় সংকোচ কাটিয়ে ওঠাই নতুন সমাজের দায়িত্ব।
ষড়যন্ত্র করেছে বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে বলে পুলিশ দিয়ে চুনো পুঁটিকে ধরে আনলে; ভারতীয় সম্পাদকীয় নীতিতে পরিচালিত বিবিসি বাংলা, ডয়চেভেলে বাংলা ও ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা সেই চুনো পুঁটিকে সেলিব্রেটি বানিয়ে ছেড়ে দেবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জানে চুনোপুঁটি ষড়যন্ত্রে সক্ষম নয়; আর ভাবমূর্তি রক্ষাটা সভ্য বিশ্বে অপরিচিত কনসেপ্ট; ফলে চুনোপুঁটি গ্রেফতার মানবাধিকার লংঘন বলে বিবেচিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে আওয়ামী চিন্তার ক্লিশে স্টাইলে আউটডেটেড সিদ্ধান্ত গ্রহণ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বিঘ্নিত করবে।
এ কথাটা আমি ৫ অগাস্ট থেকে নানাভাবে বলতে চেষ্টা করেছি, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতা-প্রশাসন-পুলিশ-দলীয় ক্যাডার যা যা করেছে; ঠিক তা তা না করলেই আপনি সফল হবেন।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।