মাসকাওয়াথ আহসানঃ
আমাদের সমাজে যে কোন ঘটনার প্রতিক্রিয়া এতো তীব্র কেন! কেন এক একটি ঘটনায় মনে হয় মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে! এর পেছনে রয়েছে আমাদের ডিএনএ’তে ট্রমা। এই ট্রমা ১৭৯৩ সালের পর বৃটিশ কোলাবরেটর মধ্যস্বত্বভোগী জমিদারের নির্যাতন, ১৯৪৭-কে ঘিরে অনেক মানুষের উদবাস্তু ও শরণার্থী হবার ট্র্যাজেডি, ১৯৭১-সালে খুনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্যাতন, উদবাস্তু ও শরণার্থী হবার বেদনা, ১৯৭২-৭৫ রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন, বাড়ি-জমি দখল, দুর্ভিক্ষ ও বাকশাল নামে ভারতীয় ছায়া উপনিবেশের খলছায়ার ফলাফল।
১৯৭৬-৯০ সেনাশাসন আর ইসলামের নামে একটি উগ্রগোষ্ঠীর সমাজ-পুলিশ হয়ে ওঠা; ২০০১-০৬ বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উত্থান; ২০০৮ সালে ভারতের ছায়া উপনিবেশ প্রকট হয়ে ওঠা। ২০০৯ সাল থেকে বাকশাল টু পয়েন্ট ও ফিরে আসা, ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের বিচার করাকে কেন্দ্র করে; তাদের ফাঁসিকে উপলক্ষ করে বিরিয়ানি খাওয়ার প্রগতিশীল মব কালচার প্রচলিত হয়। ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও বিজেপি ভাই ভাই হয়ে ইসলামোফোবিক রাজনীতি শুরু করে। প্রগতিশীলতা তখন মোদি প্রগতিশীলতায় রুপান্তর। ক্রসফায়ার, গুম, আয়নাঘর, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের নাটক সাজিয়ে বাংলাদেশকে প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরিতে পরিণত করা। সবশেষে ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগের খুনে হাসিনাতসিদের হাতে হাজারো শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণী ছাত্র-ছাত্রী, মেহনতী মানুষের নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
বাংলাদেশের মনোজগত চিরস্থায়ী ট্রমায় আচ্ছন্ন হওয়ায়; এখানে ঐ মোদি জনতা আবার দখল নিতে এলো; ঐ তৌহিদি জনতা সব কিছু দখল করে নিচ্ছে; এমন প্রাত্যহিক ভীতিতে মানুষের জীবন কাটছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিকে রয়েছে সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ঘটনাবলী। আবার হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি অংশ ১৯৪৭ সালে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে না পারাকে আজো মেনে নিতে পারেনি। মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি অংশ যেমন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাকে আজো মেনে নিতে পারেনি। এই কনফিউজড মানুষগুলো সংখ্যায় কম হলেও; সমাজ জুড়ে কুঁচ কুঁচ করে বেড়িয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানারকম জুজু তৈরি করে।
বাংলাদেশে আবহমান কালের সংস্কৃতি চর্চা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। বৃটিশ আমলে কলকাতায় বৃটিশের প্রণোদনায় গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকেই বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূলধারা হিসেবে প্রচার করেছে আওয়ামী লীগ, বাম দলের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি নেতা-নেত্রীরা। বাংলাদেশ প্রায় একভাষী দেশ হওয়ায়; ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতার কারণে বিশ্ব-সংস্কৃতির প্রয়োজনীয় উপাদান যুক্ত হয়নি বাংলাদেশের সংস্কৃতির নদীতে। এর ফলে সংস্কৃতি চর্চা বলতে বাংলাদেশে যা আছে তা কলকাতার অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের সংস্কৃতি। এই প্রাচীন সংস্কৃতি এখন কলকাতাতেই চর্চিত হয় না। বাংলাদেশে যেভাবে বৃটিশ আমলের আমলাতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে; যে আমলাতন্ত্র এখন খোদ বৃটেনেই প্রচলিত নয়।
বাংলাদেশে প্রচলিত অষ্টাদশ শতকের কলকাতার সংস্কৃতি কালক্রমে কট্টর একটি ধর্মের মতো অনুশীলিত। এরা ঐ তামাদি সংস্কৃতি নিয়ে এতো রক্ষণশীল যে; ঐ সংস্কৃতিতে সামান্য আঘাত এলে তারা পাগলপারা হয়ে যায়।
মুসলমানদের যে অংশটি সৌদি আরব কিংবা পাকিস্তানের সংস্কৃতি বলে কাল্পনিক কিছু একটা দাঁড় করিয়েছে; তারা বাংলাদেশের ভারতীয় মিডিয়া প্রভাবিত মিডিয়ার চোখে সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে দেখে; এমন এক কট্টর সংস্কৃতি পালন করে; যা আরব বা পাকিস্তানে প্রচলিত নয়। আরব ও পাকিস্তানে বর্তমানে যে সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে; তা প্রতিদিনই উদারপন্থার সন্ধান করছে। বিশ্ব-সংস্কৃতির প্রয়োজনীয় উপাদান সেখানে যুক্ত হচ্ছে তাদের ইংরেজিতে দক্ষতার কারণে। আর উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংস্কৃতির কোন পার্থক্যই নেই। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মেলবন্ধনেই গড়ে উঠেছে ভারত ও পাকিস্তানের সংস্কৃতি। প্রাচীনকালে তুরস্ক, ইরাক, ইরান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ঢুকে পড়া সুফি সংস্কৃতি; হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভারত ও পাকিস্তানে খুবই জনপ্রিয় একটি ধারা।
বাংলাদেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদী আওয়ামী লীগের মুখ নিঃসৃত পাকি গালিটি আর কট্টর ইসলামপন্থীদের দেয়া রেন্ডিয়া গালিটি আসলে; ইংরেজিতে দুর্বলতা ও বিশ্ব-সংস্কৃতি ধারায় পাকিস্তান ও ভারতের মতো যুক্ত হতে না পারার হীনমন্যতাজনিত। ইনফেরিয়রের সুপিরিয়র সাজার ব্যর্থ অস্ত্র হচ্ছে গালাগাল। ভারতের বিজেপির লোকজন আর পাকিস্তানের তেহেরিকে তালিবানদের চেহারা সুরত-আচার আচরণ দেখে; ভারত ও পাকিস্তানকে বিচার করলে মোদি জনতা ও তৌহিদি জনতার মতো বাতিল মাল নিয়ে কাটাতে হবে বাকি জীবন।
একজন পুলিশ কর্মীর ভিডিও দেখলাম, যে তার মায়ের স্নেহ ও উপদেশে গড়ে উঠেছে; তাই সে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে কারো গায়ে আঘাত না করে শূন্যে ও পায়ের কাছে লাঠি ঘুরাচ্ছে। এইরকম সংশোধনমূলক ও মায়াবি পুলিশের লাঠি প্রয়োজন মোদিজনতা ও তৌহিদি জনতাকে সভ্যতার জগতে ফিরিয়ে আনতে। এই উভয় গোষ্ঠীর মনোজগতের গভীর চিকিতসা প্রয়োজন।
আর যে কোন ঘটনায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার প্রতিক্রিয়া থেকে বেরিয়ে উদ্ভুত সমস্যা নিয়ে শান্তভাবে আলোচনা করা শিখতে হবে। অতীতের ট্রমা নিয়ে বসে থাকলে আগামীর দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপ নেয়া যায়না। প্রতিটি সংকট, প্রতিটি ইস্যু সমাজ সংস্কারের সুযোগ। হাসিনাতসির যুগে তো প্রাণখুলে কথা বলার অধিকার ছিলো না। চব্বিশের ৫ অগাস্টের পর মুক্ত আলোচনার পরিবেশ ফিরে এসেছে। সেটাকেই বরং কাজে লাগানো যাক।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।