মাসকাওয়াথ আহসান
হলিউডের মুলানরুশ ছবিটি যারা দেখেছেন; তারা আজকের প্যারিসে মুলানরুশ জায়গাটা দেখতে গেলে মনে হবে চলচ্চিত্রকার বায লুহরমান অযথা একে এতোটা গ্ল্যামারাস দেখিয়েছেন। কমার্শিয়াল মুভির কাজ ইলিউশানের জগত তৈরি করা। এই যে একটা ম্যাড়মেড়ে সমতল বোরিং একটা যাপিত জীবন; সিনেমার টিকেট কেটে কেউ হুবহু তা দেখতে সেখানে যায়না। দর্শক যায় স্বপ্নের ঘোরে দুই আড়াইঘন্টা সময় কাটাতে।
ফেসবুকের লোক ঐ ইলিউশনের জগতটা বাস্তবে সৃষ্টি করতে চায় বলে; রুপপুরের বালিশ বিক্রি করে ড্রইং রুম সাজায় চলচ্চিত্রের সেটের মতো করে। কিংবা ফেসবুকে আইফেল টাওয়ারের ছবি দেখে; তারপর অফিসের লিফট কেনার নামে আইফেল টাওয়ার দেখতে গিয়ে লোহা-লক্কড়ের টাওয়ার দেখে হতাশ হয়।
বলিউডের চলচ্চিত্রকার বানসালির নির্মিত হীরামাণ্ডি নেটফ্লিক্স সিরিয়াল দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আসলেই কী জায়গাটা এতোটা গ্ল্যামারাস! কিছুদিন আগে হীরামাণ্ডির প্রত্ন দালানগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। এর আগে পড়ে নিয়েছি লুই ব্রাউনের লেখা “দ্য ডান্সিং গার্লস অফ লাহোর” বইটি। এখন প্রত্ন দালানগুলো সংস্কার করে রেষ্টুরেন্ট বানানো হয়েছে। ঘুরে ঘুরে এগুলোর স্থাপত্য-নক্সা চিহ্ন-ভাস্কর্য-জলসাঘর-হাম্মাম (সুইমিং পুল) সবই দেখলাম। ধারণা করা যায় জায়গাটা কীরকম গ্ল্যামারাস ছিলো।
অনেক আগে লক্ষ্ণৌ গিয়ে সেখানে কোঠে ও নাচঘরের প্রত্ন চিহ্ন দেখেছিলাম; দিল্লিতেও এরকম প্রত্ন নিদর্শন আছে। উইলিয়াম ড্যালরিম্পলের গবেষণায় এ জায়গাগুলোর গ্ল্যামার ধরা পড়ে।
আমরা বৃটিশ আমলে তৈরি ইতিহাস ও সাহিত্যের ন্যারেটিভ পড়ে বড় হয়েছি। ফলে এটা ভাবতে শিখেছি, মুঘল ও দিল্লি সালতানাতের শাসকেরা বাঘের ছাল পরে থাকতো; কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেতো। নেহাত বৃটিশেরা এসেছিলো বলে, পূর্ব বঙ্গের প্রজা শোষণের টাকায় বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদারদের তৈরি কলকাতার সেকেন্ড হোম; আর গড়ের মাঠে ডিরোজিও-র এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে জ্বলে ওঠা জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবার নাহলে; আমরা আজো বাঘের ছাল পরে মুখে চুন মেখে কাঁচা মাংস খেতাম।
এই স্কুল অফ থটের লোকেদের কাছে মুলানরুশ হচ্ছে শৌর্যের শুরু এবং শেষ; ইউরোপীয় নারীই সৌন্দর্য্যের শেষ কথা। আমাদের মতো বাদামি হনুমানদের মনে এমনই সাহেব পুঁতে দিয়ে গেছে বৃটিশ উপনিবেশ আর তাদের ভাড়া করা বিদূষক বাঙালি লেখকেরা যে, এতো রেসিস্ট লোক আজ বাকিং হাম প্যালেসেও বসবাস করে না।
মির্জা গালিবকে নিয়ে নভেলা “নওয়াবজান” লিখতে গিয়ে দিল্লি ও লক্ষ্ণৌর তাওয়ায়েফদের সম্পর্কে গভীর পাঠ করতে হয়েছে। আমির খসরুকে নিয়ে নভেলা “ছাপ তিলক” লিখতে গিয়ে দিল্লির সিংগিং এণ্ড ডান্সিং গার্লসদের সম্পর্কে জানতে হয়েছে। লক্ষ্ণৌ ও লাহোর থেকে সংগীত ও নৃত্য শিল্পী সংগ্রহ করে সুলতান ফিরুজ শাহ’র কালচারাল ট্রুপে ভর্তি করা হতো; আমির খসরু ছিলেন তাদের মিউজিক টিচার।
প্যারিসে যেমন মুলানরুশ গায়ক- কবি-সাহিত্যিক-চিত্রকরদের অনুপ্রেরণার জায়গা ছিলো; লক্ষ্ণৌ-দিল্লির কোঠে কিংবা লাহোরের হীরামাণ্ডি ছিলো তেমন এক জায়গা।
আমরা যারা সোনাগাছি-বৌবাজার-রথখোলা-বানিয়াশান্তার দুর্নাম শুনে বড় হয়েছি; তাদের পক্ষে ধারণা করা কঠিন যে; লক্ষ্ণৌ-দিল্লি-লাহোরের কোঠেতে জৈবিক ব্যাপারগুলো হয়তো দশ শতাংশ আকর্ষণের বিষয় ছিলো। নব্বুই শতাংশ জুড়ে ছিলো এটিকেট-আচরণ-কার্টেসি-শিষ্টাচার শিক্ষা-সংগীত-নৃত্য-কবিতা-রোমান্টিসিজম। আমার মনে হয় গভীর অনুসন্ধান করলে জানা যাবে; সোনাগাছি-বৌবাজার-রথখোলা-বানিয়াশান্তাতেও মানুষ মূলত প্রেমের খোঁজে যায়। বাঙালি কালচারের জাত গেলো জাত গেলো স্বভাবের কারণে জায়গাগুলোকে দোজখ হিসেবে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে। এর পেছনে লুকিয়ে বিধবা সম্ভোগ করা, চার বিবাহ করা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে পেডোফিলিক হওয়া নৈতিকতার যাজক পেডাগগদের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে হয়।
বাঙালি মনের আরেকটি সংকট হচ্ছে আর্য ফ্যান্টাসি; দৈবচয়নে রক্তশূন্য ফর্সা মেয়ে বিয়ে করে; পাকা আমটি হাতে নিয়ে স্যুট পরা বাঙ্গি কাক ঘোষণা করে, আরে লক্ষ্ণৌ-হীরামাণ্ডিতে এতো সুন্দর মেয়ে কোথা থেকে আসবে!
দক্ষিণ এশিয়ার নারীর সৌন্দর্য্যের বৈচিত্র্য ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি। চোখ থেকে বৃটিশ উপনিবেশের লেন্স খুলে দেখতে হয় মানুষের সৌন্দর্য্য।
নিজের হীনমন্যতা সামষ্টিক সমাজে প্রয়োগ করতে গেলে ভ্রান্তি তৈরি হয় চিন্তায় ও বাক সক্রিয়তায়।
চলচ্চিত্রকার বানসালি প্রত্ন সময় ডিকন্সট্রাক্ট করার চেষ্টা করেন সিনেমাটোগ্রাফিতে। হলিউড তার ক্লিওপেট্রা কিংবা বেনহার ছবিতে একই কাজ করেছে। বানসালির শিল্প নির্দেশনায় ত্রুটি সামান্যই থাকে; বরং শিল্পিত উপস্থাপনের চেষ্টাটাই বেশি থাকে।
আসলে সংগীত ও মুজরার যে প্রত্ন সংস্কৃতি; এ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না থাকলে; তখন বানসুরিকে খারিজ করে দেয়ার ইচ্ছা হয়। ছোট বেলা থেকে যাপন করেছেন, সমাজের তৈরি করে দেয়া ছাঁচের পুতুল জীবন; দ্রোহ মানে লুকিয়ে রসময় গুপ্ত পাঠ বা আভাগার্দ ছবির দর্শন। পরে ভদ্রলোক হয়ে পশ্চিম আবিষ্কার করে নিজের ড্রইং রুমে স্যুট পরে লর্ড ব্রাউন হয়ে বসে থাকতে থাকতে; নিজের জানার বাইরের জগত নাকচ করে দেবার জিদ তৈরি হয়। লুতফর রহমানের উপদেশ গ্রন্থ “যুবক জীবন” লিখতে কেবল বাকি!
মুলানরুশ হোক, হীরামাণ্ডি হোক; এখানে নর্তকী হয়ে আসার পেছনে ট্র্যাজেডি সবার থাকে। একটা ম্যাড়মেড়ে গৃহস্থ জীবনেই কী কম ট্র্যাজেডি থাকে। কিন্তু মুলানরুশ কিংবা হীরামাণ্ডি থেকে যে কবিতা-সংগীত-নৃত্য-চিত্রকলা তৈরি হয়েছে; তা রয়ে গেছে ধ্রুপদী হয়ে।
আমি স্কুলে পড়ার সময়েই ঠিক করেছিলাম নিজের আনন্দের জন্য লিখবো। তাই জীবনকে উলটে পালটে দেখেছি। ক্লিশে ধারণাগুলোকে ফেলে দিয়ে সত্যানুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। সৌন্দর্য্যের পুনরাবিষ্কার জীবনের জন্য সবচেয়ে জরুরি মনে হয়েছে। মার্ক টুয়েন বলেছেন, মানুষ মারা যায় আসলে সাতাশ বছর বয়সে; আমরা তার বাহাত্তর বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি শেষকৃত্যের জন্য।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।