মাসকাওয়াথ আহসানঃ
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ মুজিব মাশালের লেখা অভিমত প্রতিবেদনটি পড়লাম। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় থেকে ভারতের মিডিয়া শেখ হাসিনার সমর্থনে ঐ আন্দোলনে যেভাবে মৌলবাদের অনুপ্রবেশের কাল্পনিক গল্প বলেছিলো; ৫ অগাস্টে ভারত সমর্থিত শাসক শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে যাবার পর থেকে যেভাবে ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশ মৌলবাদের খপ্পরে জাতীয় অপপ্রচার চালিয়েছিলো; মাশালের প্রতিবেদন ঐ একই মনস্তত্বের প্রতিফলন। যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকা মানেই জামায়াত ক্ষমতায় যাবে টাইপের কল্পকাহিনী প্রচার করা।
মুজিব মাশাল তারাগঞ্জে একটি নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ হওয়াকে উপজীব্য করে আফঘানিস্তানের ভয় হাজির করেছেন বাংলাদেশের মানচিত্রে। প্রাথমিকভাবে বাধাপাওয়া ঐ ফুটবল ম্যাচটি পরে ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। আর বাংলাদেশের অন্য কোথাও নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ হবার কোন খবর নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক লাইব্রেরিয়ান তরুণ এক তরুণীকে গিয়ে ওড়না ঠিক করে পরার অনধিকার চর্চা করলে; এই অভিযোগে তার চাকরি গেছে। ফেসবুক এক্টিভিস্টদের অনুরোধে তাকে গ্রেফতার করা হলে তার কিছু বন্ধু গিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে ছাড়িয়ে আনে। যে বন্ধুদের মাঝে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও ছিলো। আর ঐ লাইব্রেরিয়ান তরুণের ফেসবুক আইডি চেক করে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়। সে চাকরিও পেয়েছিলো হাসিনার শাসনামলে।
মুজিব মাশাল জানলে অবাক হবেন যে, যে মিছিল থেকে ইসলাম অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি তোলা হয়েছে; কিংবা কাল্পনিক ইসলামী শাসনের দাবি জানানো হয়েছে; ঐসব মিছিলে শেখ হাসিনার লোকেদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। ঐ একই লোকেরা হাসিনার শাসনামলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের প্রতিবাদে বের করা মিছিলে হামলা করেছিলো। একই ব্যক্তি যে আজ কট্টর ইসলামপন্থী মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছে; তাকেই কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভূমিকায় দেখা গেছে। এই রুপবদলের রাজনীতি আসলে শেখ হাসিনা করে গেছেন। তিনি একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ আর ইসলামপন্থার যত্ন আত্মি করেছেন। তিনি ইসলামপন্থী নাম দিয়ে যাদের নির্যাতন করেছিলেন; তারা আসলে ছিলো হাসিনার অপশাসনের সমালোচক। যে কোন ভিন্নমত পোষণকারীকে শেখ হাসিনা কখনো ইসলামপন্থী কখনো রাজাকার তকমা দিতেন। এই তকমার রাজনীতিই জুলাই আন্দোলনকে বিক্ষুব্ধ করেছিলো; যা তার পতন ঘটায়।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে ইসলামপন্থীরা কখনো ন্যুনতম জনসমর্থন পায়নি। নির্বাচনী ফলাফলে তারা গৌণ একটি শক্তি। মুজিব মার্শাল সেই গৌণ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির ইন্টারভিউ করতে এসেছিলেন ভারতের মুখ্য রাজনৈতিক শক্তি হিন্দুত্ববাদ শাসিত জনপদ থেকে। বেশ আইরনিক্যাল এই ব্যাপারটা অবশ্য তিনি মাত্র অর্ধেক বাক্যে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বেশ কয়েকটা বাক্য তার প্রয়োজন হয়েছে, ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের ইসলামপন্থা ও আফঘানিস্তানের তালিবান শাসনের বর্ণনায়। একে স্টেরিওটাইপিং ছাড়া আর কি বলবো!
জুলাই বিপ্লব কোন সাধারণ ঘটনা নয়। ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনে জেঁকে বসা ফ্যাসিস্ট শক্তির শেকড় উপড়ানোর ঘটনা। শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা হত্যায় লেলিয়ে দেয়ায়; বাহিনীটির ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেবার পর কেবল সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আইন-শৃংখলা রক্ষার কাজটি করতে হয়। এই সুযোগ নিয়েছিলো পরাজিত আওয়ামী লীগ। তারা পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে ডাকাতি-ছিনতাই-নৈরাজ্য সৃষ্টির সবরকম চেষ্টা করেছে। এখনো তারা ভারতীয় মিডিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালায়।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও ক্ষুদ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর একাংশ শেখ হাসিনার নির্যাতনে কারাগারে অবরুদ্ধ ছিলো। শেখ হাসিনার পতনের পর মুক্তি পেয়ে তাদের কারো কারো উদযাপন অপরিমিত ছিলো। শেখ হাসিনার সময় জনগণের দাবী আদায়ের সুযোগ ছিলো না। যে কারণে ড ইউনুসের কাছে সমস্ত অভাব-অভিযোগের কথা জানিয়েছে বিভিন্ন পেশাগোষ্ঠী।
অভ্যুত্থান বা বিপ্লব জন্মদিনের পার্টি নয় যে ভ্যাকুয়াম ক্লিনিং করলেই বৈঠকখানা ফিটফাট দেখাবে। আবার ভারতের মিডিয়ার কল্পিত ইরান ও মিশরের কথিত ইসলামপন্থী উত্থানের উপযোগী ভূমি বাংলাদেশ নয়; যে মিডিয়ার ইসলামোফোবিক নেসেসারি ইলিউশান দিয়ে একে কথিত জঙ্গীবাদের খেলাঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা জাতীয় বিমূর্ত শব্দ পরিবর্তন করে বহুত্ববাদ শব্দটি ব্যবহারের পরামর্শ এসেছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান ও অন্যান্য বিশ্বাসের মানুষের সমান অধিকার উপভোগের ও সামাজিক ঐক্য তৈরির প্রত্যয়ে।
মাথায় টুপি আর গালে দাড়ি দেখলেই ভারতের মিডিয়া তাকে ইসলামপন্থী বলে। অথচ এই ধর্মপ্রাণ মানুষেরাই গত দুর্গাপূজায় হিন্দুদের উতসব উদযাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে কিছু মাজারে স্থানীয় সাংসদ তাদের দলীয় কার্যক্রমের আখড়া করেছিলেন। এসব মাজারের ওরসের পোস্টারে আওয়ামী লীগের নেতাদের নাম জলজল করতো। এ কারণেই হাসিনার পতনের পর কিছু মাজার জনরোষে পড়েছে। আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা-কর্মী হিসেবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি অংশ আক্রান্ত হয়েছে। পুলিশ বাহিনী এর সামর্থ্য ফিরে পাওয়ায় ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়ার রাশ টেনে ধরা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সারাদেশে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বেগবান হয়েছে। সক্রিয় নাগরিক সমাজ হিসেবে বামদলগুলো তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করছে।
আর জুলাই বিপ্লবের মূল কারিগর যারা; সেই জেনজি পৃথিবীকে দেখে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারা আউটডেটেড ক্ল্যাশেস অফ সিভিলাইজেশনের চিন্তার ভোক্তা নয়। ফলে মুজিব মাশাল জেনেক্স বা মিলেনিয়ালের লেন্সে যে বিভাজিত পৃথিবী দেখেন, যেখানে প্যালেস্টাইনের মুসলিম গণহত্যা দেখে অনুশীলিত নির্লিপ্ততা অবলম্বন করতে হয়; আর বাংলাদেশে জোর করে ইসলামপন্থার জুজু দেখাতে হয়; ঐ চিন্তার অচলায়তনে তো খোদ এমেরিকার জেন জি’রাই আটকে নেই। জন লেননের অখণ্ড চিন্তার পৃথিবীই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সৃজন হতে চলেছে। ফলে নব্বুই দশক থেকে চলে আসা “ওয়ার অন টেরর”-এর পুনরাবৃত্তিকর থিয়েটারের দর্শক বেঁচে আছে কেবল বিংশ শতকের বিভাজনপ্রিয় অসুখী মানুষের মনে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।