মাসকাওয়াথ আহসানঃ
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জায়গার চেয়ে আতিথেয়তা, ঔদার্য্যে, সরলতা ও বন্ধুত্বে বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে থাকলেও এই একটি জায়গায় পিছিয়ে। তা হচ্ছে কারো ওপরে রেগে গিয়ে মুখে যা এলো তাই বলে দেয়া।
স্ল্যাং বা খিস্তির ব্যবহার সব সমাজেই আছে; বিশেষত গ্রামাঞ্চলের স্ল্যাং কৌতুক ও কবিতার মতো শোনায়। কিন্তু শহুরে কথিত শিক্ষিত লোকেরা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করলে তা অসহ্য শোনায়।
এই যে অনেক শিক্ষিত যুবক প্রেমের জন্য হাহাকার করে; কিন্তু কোন প্রেমিকাই আকৃষ্ট হয়না কিংবা এলেও বেশিদিন থাকে না; এই ট্র্যাজেডির পেছনে রয়েছে ছেলেদের মুখে যা এলো তা বলার অভ্যাস। ফেসবুকেই যারা খিস্তিবাজ বলে খ্যাত, তাদের জীবনেই এমন ট্র্যাজেডি ঘটেছে। ফেসবুকের প্রখ্যাত গ্যাং গুলোর লিডারেরা আজ কেউই ভালো নেই। এরকারণ হলো, নারীসমাজ স্ল্যাং ব্যাপারটা বিশেষ অপছন্দ করে। পুরুষ গ্যাং-এর পাশাপাশি যে নারীগুলো স্ল্যাং বলে খুব সাহসী হিসেবে জাহির করতে চেষ্টা করে; এরা নিজ নিজ জীবনের জন্য রেসিপি অফ ডিজাস্টার নিয়ে বসে আছে।
এই যে শেখ হাসিনার জীবনের ডিজাস্টার, তা রচিত হয়েছে গণভবনে “প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি”-র আসরে প্রতিপক্ষকে গালাগাল করার মাঝ দিয়ে। সবশেষে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রীদের গালাগাল করার ফলাফল হাসিনার পতন ও পলায়ন।
ফেসবুকে গালাগালের সূচনা করে আওয়ামী লীগের সিপি গাং। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ওপর নেতি তৈরি করেছে সিপি গ্যাং-এর গালাগাল। পরে বিজেপি সদস্যরা আওয়ামী লীগ সদস্যদের সঙ্গে মিলেমিশে ইসলাম ধর্মকে গালি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাইবার সৈনিকদের ব্যবহৃত গালাগাল বাংলাদেশে প্রচলন করেছে বাংলাদেশে তাদের অনুসারীরা। যে কোন অনুষঙ্গ বা ইস্যু পেলেই স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা ইতস্তত ১৯৭১ সালের অনেক পরে জন্ম নেয়া জেন জি প্রজন্মকে মুখে যা আসে তাই বলে। নিজেরা অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাদের পাকিস্তানপন্থী বলে দুয়ো দেয়। সাভারকার ও শ্যামাপ্রসাদের আদর্শে উত্তেজিত হয়ে তাদের জিন্নাহ প্রজন্ম বলে কটাক্ষ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপরে আওয়ামী লীগের যে অধিকার, তার চেয়ে বেশি অধিকার বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই বিপ্লবে ছাত্রজনহত্যার উস্কানি দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি এরা। শেখ হাসিনা যত্রতত্র “রাজাকার” তকমা দিয়ে দেশছাড়া হতে দেখেও এরা হাল ছাড়েনি, নির্লজ্জ হলে যা হয় আর কি। ২০০৯- ২০২৪-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থক এই মোদির ভারতের কোলাবরেটরেরা এখনো ফেসবুকে এসে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সনদ বিলি করে; আর মুড়িমুড়কির দরে রাজাকার তকমা দেয়। কট্টর হিন্দুদের এই কুঁচকুঁচানি স্বভাবের কারণে তারা বিপদে পড়ে।নিজেরাই লোকজনকে খিস্তি করে উস্কানি দিয়ে প্রহারেনু ধনঞ্জয়ের ব্যবস্থা করে। আর প্রহার হয়ে গেলেই ছবি তুলে আনন্দবাজার পত্রিকার কাছে পাঠিয়ে দেয়, ঐ দ্যাকো নির্যাতন হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিজেপির স্ল্যাং কার্যক্রমের পাশাপাশি এরা ভিন্নমতের ব্যক্তির চরিত্রহননের জন্য তার বেডরুমের কাল্পনিক গল্প তৈরি করে। এরা সব বিশিষ্ট বেডরুম বিশারদ। অবদমিত মনের কল্পনার রং মিশিয়ে এরা চরিত্রহনন করে। আর সেই ফেসবুক পোস্টের মন্তব্য ঘরগুলোকে আদিরসে সমৃদ্ধ করে তোলে রসময় গুপ্ত কালচারাল একাডেমি।
দেড় দশক ধরে এই অশ্লীল গ্যাং ও সাইবার বটগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে হাসিনার ফ্যাসিজম বিরোধী জনযুদ্ধের কতিপয় কমরেড হুবহু আওয়ামী লীগের ভাষারীতি ও চরিত্রহনন কৌশল আয়ত্ব করেছে। রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে রাক্ষস হতে মানা করেছেন অনেক মনীষী।
এটা মনে রাখতে হবে, যে ব্যক্তি বছরের পর বছর হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন; জনমানুষের অধিকারের পক্ষে লড়াই করেছেন; তাকে সাধারণ মানুষ তার কথা ও কাজের মাঝ দিয়েই তাকে চেনে। হাতের কংকন কেউ আর্শীতে দেখেনা। ইউটিউবে বা ফেসবুকে ঐ ব্যক্তির চরিত্রহনন করলে, তার একমাত্র ভোক্তা হবে রসময়গুপ্ত কালচারাল একাডেমি। ঐ জনস্বার্থে সক্রিয় ব্যক্তি সম্পর্কে ইতিপূর্বে যেসব আজে বাজে কথা আওয়ামী লীগ ও বিজেপির লোকেরা বলেছে; ঠিক সেসব কথাই যদি হাসিনার অপশাসন বিরোধী আন্দোলনের কোন কমরেড বলেন, তিনি নিজেই তার ক্রেডিবিলিটি হারাবেন। এতোদিন ইউটিউব ও ফেসবুকে যে জন আস্থা তৈরি করেছেন তারা; অন্যের চরিত্রহনন করে সেই আস্থা হারাবেন নিশ্চিতভাবেই।
আওয়ামী লীগ ও বিজেপির লোকেরা যত্রতত্র লোকজনকে সি আই এ ও আই এস আই-এর এজেন্টের তকমা দিয়ে বেড়াতো। নিজেরা যেহেতু ফেসবুকে দলীয় পেইড এজেন্ট ছিলো; শীর্ণকায়া ক্ষীণাঙ্গী শরীরগুলোতে চর্বি লেগেছে হাসিনার দেশলুন্ঠনের টাকার দান ও অনুদান খেয়ে; তাই তারা নিজের জীবনের আয়নায় পেইড এজেন্ট ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়না। ঠিক সেই দরিদ্র মনের কল্পনাপ্রবণ লীগ-বিজেপি সাইবার সৈনিকদের অনুকরণে লোকজনকে ইতস্তত “র” এজেন্ট বানিয়ে দেবার কাজটি একই রকম দরিদ্র ও কল্পনাপ্রবণ মনের পরিচয়। যাদের মেধা ও যোগ্যতা আছে, সৎ পথে জীবন যাপনের সক্ষমতা আছে; তাদের এফলুয়েন্ট জীবন যাপন করতে কারো এজেন্ট হতে হয়না।
ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র বানিয়ে বেড়ায়; ফিল্ম কোম্পানির বেশি কিছু নয়। বড় জোর মিডিয়ায় ফোন করে অনুরোধ করে পরস্পরের বিরুদ্ধে গুজব প্রচার করতে। ভারতে মোদীর টলটলায়মান ক্ষমতা আর পাকিস্তানে শাহবাজ শরিফের কচুর পাতার পানি মার্কা ক্ষমতা ধরে রাখতেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিদিন। নিরীহ লোককে গুম করা, আয়নাঘরে আটকে রাখা ছাড়া অন্য কোন কাজ এদের দিয়ে আদৌ হয় বলে মনে হয়না। কাজেই এদের সামর্থ্যকে কল্পনা দিয়ে বড় করে তোলা অনুচিত হবে।
শৈশবে যারা জ্বীন-ভুত-প্রেত ও ব্ল্যাক ম্যাজিকের গপ্পো শুনে শিহরিত হতো; তারাই আকাশ কুসুম কল্পনার গপ্পো চাঁড়ে ফেসবুকে। কন্সপিরেসি থিওরির গল্পগুলোও একইরকম। জুলাই অগাস্ট মাসে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে ফ্যাসিস্ট বিদায় করা গেলে পৃথিবীতে এমন কোন কাজ নেই যা ছাত্র-জনতার ঐক্যে অসম্ভব। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ সামর্থ্যের ওপর আস্থা রেখে যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করলে নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রতিটি মানুষের জীবনে অনুদিত হবে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।