আরিফ রহমান
১৯৭১ সালের একটা ঘটনা বলে আপনাদের একটু বিরক্ত করি। মুক্তিযুদ্ধ তখন চলছে। ১৯৭১ সালের ১৩ মে রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বড়াল নদী দিয়ে এসে বাঁশগাড়ি ও রূপসী গ্রাম ঘেরাও করে।
সেদিন রাতে হানাদার ও রাজাকারেরা গ্রামের পুরুষদের তাদের বাড়ি থেকে টেনে এনে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করায়। পাকিস্তানি হানাদারেরা তাদের সামনেই উম্মুক্ত স্থানে নারীদের ধর্ষণ করে। তারপর পুরুষ সবাইকে গুলি করে হত্যা করে গান পাউডার দিয়ে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। হানাদারদের নির্মম গণহত্যায় সেদিন শহীদ হন প্রায় ৩৫০ সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ।
এবারে একটু স্টপ দেই। ৩৫০ সনাতন ধর্মালম্বী পুরুষ ১৯৭১ সালের ১৩ মে নিহত হলেন। তো বিদ্যমান কোটা ব্যাবস্থায় তাদের সন্তানেরা কি কোটা সুবিধা পান?
উত্তর হচ্ছে: না।
কারণ আমাদের দেশের কোন সরকারই মুক্তিযুদ্ধ কি জিনিস সেটাকে বোঝার পেছনে সময় দেন নাই। এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ কারা সেটাকে আমলে নেওয়ার কথা ভাবেন নাই।
একাত্তরে শহীদ পরিবার, ঘর পুড়ে যাওয়া পরিবার, শরণার্থী হয়ে যাওয়া পরিবার, সর্বস্ব হারিয়ে ফেলা পরিবার, বীরাঙ্গনাদের পরিবার কেউই কোটা সুবিধা পান না। কোটা সুবিধা পান কেবল খুবই কোশ্নেচেনেবল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কিছু মানুষ, যেখানে আট বছরের শিশুদের নামও আছে।
সত্যি বলতে একাত্তরের ক্ষতিকে আমলে নেওয়ার ইচ্ছে যদি কোন সরকারের থেকে থাকতো তাহলে কোটা দেওয়ার কথা তাদের মাথায় আসতো না, কারণ মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন এই দেশের নব্বুইভাগ মানুষ।
আপনি কাকে বাদ দেবেন?
কে ক্ষতির শিকার হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়?
কেউ যদি প্রকৃতই একাত্তরের যুদ্ধ আর জেনসাইডকে আমলে নিয়ে কোটা প্রথার কথা ভাবতো তাহলে সবার আগে কোটা পাওয়ার কথা একাত্তরের জেনসাইডের ভিকটিম পরিবারগুলোর, একটু সুস্থভাবে কোটা বিষয়টা ভাবলে কিন্তু এইটাই প্রথমে আসে।
আর কিছু না, কেবল জেনসাইডের সংজ্ঞাটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের ৯০% মানুষ জেনসাইডের ভিকটিম। হ্যা সত্যিই তাই। একাত্তরের জেনসাইডের ভিকটিম মোটা দাগে ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাত কোটি মানুষ। আমরা সবাই কোন না কোন ফর্মে জেনসাইডের শিকার হয়েছি, সবাই মানে সব্বাই।
গণহত্যার সংজ্ঞাটা একটু গুগল করে পড়লে বুঝতে পারবেন কথাটার মানে কি। জাতিসংঘ বলছে একটা জাতিকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ইলিমিনেট করতে যা কিছু করা হবে সবই জেনসাইড। শুধু কিলিং জেনসাইড না। রেইপ, মাইগ্রেশন, লুট, ফোর্সফুল কনভার্সন- সবকিছু জেনসাইডের অংশ।
আপনি আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছেন না, ভয় পাচ্ছেন- এর মানেই আপনি জেনসাইডের ভিক্টিম।
আচ্ছা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতের রিফিউজি ক্যাম্পে যে এক কোটি বিশ লাখ মানুষ গিয়েছিলেন তারা কি জেনসাইড ভিকটিম নন? বিভিন্ন শহর থেকে যেই তিন কোটি মানুষ গ্রামে গিয়েছিলেন জীবন বাঁচাতে তারা জেনসাইড ভিকটিম নন?
ত্রিশ লাখ মানুষ মারা গিয়ে থাকলে আহত কত লাখ হয়েছিলেন? নিশ্চয়ই নিহতের চেয়ে কম নয়? তারা কি জেনসাইড ভিকটিম নন?
জেনসাইডের সময় স্কুল বন্ধ ছিল, যারা স্কুলে যেতে পারে নাই তারা জেনসাইডের ভিকটিম। অফিস বন্ধ ছিল, বাজার বন্ধ ছিল, ব্যাবসা বন্ধ ছিল। সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন জেনসাইডের কারণে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথের প্রফেসর রিচার্ড ক্যাশ বলেছিলেন একাত্তরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে খাদ্য পরিবহণ করতে না পারার কারণে মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, এতে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেছেন এই যুদ্ধের পরবর্তী এক দশকে অপুষ্টিজনিত কারণে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এবারে ১৯৭১ শেষ হয়ে গেছে দেখে কি এই মানুষদের জেনসাইডের ভিকটিম বলবেন না?
বরং একাডেমিয়া এখন বলে, এসবের কারণে এক টাকার জন্যও যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারা সবাই জেনসাইডের ভিকটিম। কেউ যদি একাত্তরের কারণে একটা রং পেন্সিল হারিয়ে থাকেন তিনিও জেনসাইডের ভিক্টিম। গবেষক লিও কুপার বলেন, একটা বড় জেনসাইড জনজাতির জীবনের গতি প্রবাহকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে যে যারা সরাসরি বন্দুকের মুখে পড়ে না তারাও কোন না কোন ভাবে এতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
দেড় কোটির ওপরে শুধু ঘর পুড়েছে একাত্তরে, এসবই জেনসাইডের অংশ। দেড় কোটি ঘরে কয় কোটি মানুষ বাস করতেন?
একাত্তরে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা পুড়েছে, এইসব প্রার্থনালয়ে যারা প্রার্থনা করতেন এবং পুড়িয়ে ফেলার ফলে আর সেখানে প্রার্থনা করতে পারেন নাই তারা কি জেনসাইডের ভিকটিম নন?
একমাত্র দেশদ্রোহী জামাত-রাজাকার-আলবদর আর তাদের সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ কোন না কোন ফর্মে জেনসাইডের ভিকটিম।
সত্যিই যদি মুক্তিযুদ্ধকে একনলেজ করতে চান, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় এই বিষয়গুলো একনলেজ করতে হবে। হাওয়ায় হাওয়ায় চেতনার কথা বলে লাভ নাই।
মুক্তিযুদ্ধ কোটা বহাল থাকুক, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞাটাকে এনলার্জ করে রিথিংক করা হোক। মুক্তিযুদ্ধ কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মধ্যে আটকে রাখা চলবে না। প্রতিটা ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে এতে জায়গা দিতে হবে।
আপনাদের সংজ্ঞায় যুদ্ধে অংশ নেওয়া সুস্থ মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম সুযোগ পেয়ে যাবে কিন্তু যুদ্ধে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ যিনি করেছেন তার পরিবারের জন্য কোন জায়গা আপনি রাখলেন না, এটা কোন ধরণের কোটা? যার দরকার সে কিছু পেলো না আর যিনি সুস্থ থাকলেন তিনি পেয়েই গেলেন এটা কেমন বিচার?
জার্মানি, বসনিয়া, রুয়ান্ডার মতো দেশেও কোটা ছিলো। কিন্তু তারা কোটাকে কেবল যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা একে বিস্তৃত করেছে জেনসাইড সারভাইভার পর্যন্ত। যাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের প্রজন্ম ক্ষতিটা কাটিয়ে উঠতে পারে। যেমনটা ঘটে প্রতিবন্ধী কিংবা আদিবাসীদের ক্ষেত্রে।
সেই হিসাবে একাত্তরের ক্ষতির স্বীকার আমাদের দেশের ৯০% মানুষ। এবং এই মানুষদের সবার কোটা সুবিধা পওয়া উচিত।
আপনারা ভেবে দেখেন ৭১ সালে যে যুদ্ধে গেছেন এবং অক্ষত ফিরে এসেছেন তিনি বেশি সংকটে আছেন, নাকি যিনি যুদ্ধে হত্যার স্বীকার হয়েছেন, রেইপের স্বীকার হয়েছেন, যার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তিনি বেশি সংকটে আছেন?
তাহলে কোটার আসল দাবীদার কে হয়?
দেখেন বীরের সম্মাননা প্রদান এক জিনিস আর কোটা ভিন্ন জিনিস। বীরদের জন্য অনেক কিছু রিজার্ভ থাকবে, সুবিধা থাকবে, বছর বছর সম্মাননা দেওয়া হবে। বীরদের নিশ্চয়ই আপনি পিছিয়ে পড়া মানুষ বলে অসম্মান করতে পারেন না। পিছিয়ে পড়া মানুষ হচ্ছেন তারা যাদের উপর দিয়ে জেনসাইডের ধাক্কাটা গেছে। কোটা থাকবে এই সিরিজ ইভেন্টস অফ জেনসাইডে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের জন্য।
ক্ষতি হলেই, অসাম্য হলেই, মানুষ পিছিয়ে পড়ে,
তখন তাকে কোটা দিয়ে অগ্রসর করাতে হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সবসময় প্রমাণ করতে চায় একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্টেইক নাই। সব তারাই করেছে। কিন্তু আমাদের সংবিধান একাত্তরের সংগ্রামকে গণ-মানুষের সংগ্রাম হিসেবেই একনলেজ করে।
আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা দিয়ে গলা ফাটায়, বলে যারা রান্না করেছে, যারা থাকতে দিয়েছে, যারা ধর্ষিত হয়েছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা- কিন্তু কাজের বেলায় তার প্রকাশ আমরা দেখি না। রান্না করা মানুষদের, ঘরে আশ্রয় দেওয়া কৃষকদের মুক্তিযোদ্ধা মনে করলে তাদের জন্য কোটা কেন রাখেন নাই? তাদের নেওয়া রিস্কের কারণে কি তাদের জীবন দিতে হয়নি? তাদের ঘর পোড়ানো হয়নি?
সেই বিপন্ন গৃহিণী, ভূমিহীন খড়ের ঘরের কৃষক নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে খাওয়ালেন একটা সাম্যের রাষ্ট্রের আশায় এবং পরদিন রাজাকার বাহিনীর হাতে জীবন দিলেন, সেই কৃষকের সন্তান কেন বঞ্চিত হবে আজ? কেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় জায়গা পেলেন না?
কোটা যদি বহাল থাকতে হয় সেই কোটার নাম “মুক্তিযোদ্ধা কোটা” হতে পারে না, এখন এর নাম হতে হবে “মুক্তিযুদ্ধ কোটা”, আর এই কোটার ভাগিদার হবে একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দেওয়া এবং সেই সমর্থন দেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এই দেশের ৯০% মানুষের সবাই।
কোটা পাবে না শুধুমাত্র তারা যারা এই দেশটা নির্মাণের বিরোধিতা করেছে সেই ১০% মানুষ। তাই বলে তাদের বংশধরদের আমরা ঘৃণা করবো না। আমরা তাদেরকে আমাদের দেশে মেধার জোরে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে বলবো।
এই নিয়ম মেনে কোটা ৫০% করলেও বাংলাদেশের মানুষের কোন আপত্তি কারবে না। কারণ ঠিকুজি বের করে দেখলে খুঁজে পাবেন আমাদের প্রতিটা মানুষের পূর্বপুরুষদের অংশগ্রহণ সেই সংগ্রামে ছিলো।
এই দেশটা গনমানুষের রক্তের উপরেই স্বাধীন হয়েছে।
আরিফ রহমান, লেখক, এক্টিভিস্ট