মাসকাওয়াথ আহসান
বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত রসঘন জনপদ। এখানে বয়স পঞ্চাশ পেরোলেই বায়ুচড়া রোগ হয়। পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে মানুষের মানসিক পরিপক্কতা আবার পেছন দিকে হাঁটতে থাকে। তখন সে শিশুর মতো বালখিল্য আচরণ করে। ফলে বাংলাদেশের পলিসি মেকিং-এর জগতটি খেলিছো এ দেশ লয়ে; আনমনে খেলিছোতে পরিণত হয়।
মিয়ান আরাফ বাঙালি চরিত্রের বায়ুচড়া রোগটিকে বুঝতে খুব সহায়তা করে। দেশের বাইরে অসংখ্য মিয়ান আরাফের সঙ্গে দেখা হয়েছে। পশ্চিমের জীবনে কেউ গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের গাড়ি বহরটিও বড় জোর দশ সেকেন্ড সময় চেয়ে নেয় পথচারীদের কাছে। কিন্তু বাংলাদেশ মানেই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরের ভি আই পি প্রটোকল।
এ কারণে পশ্চিমা জীবনে বড্ড অসুখী হন মিয়ান আরিফেরা। কারণ দেশে অবিকল তার মতো বায়ুচড়া রোগীরাই ভি আই পি। আমি দু’চারজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার সব কিছুই আছে; তবু কেন এমন বিষণ্ণ! উত্তর ছিলো, এইখানে রেসপেক্ট নাই। বাঙালি রেসপেক্টের কাঙ্গাল। আর এই সুযোগটাই সমাজের সবাই নেয়।
ফেসবুকে সিপি গ্যাং কাজ করেছে “বাঙ্গালি”র রেসপেক্ট পাবার দুর্বলতাকে পুঁজি করে। সিপি গ্যাং মনে করে আলফাডাঙ্গা কলেজের ছাএলীগের সহসভাপতি ফেসবুকে কোন প্রবীণের পোস্টে গিয়ে “রাজাকার” বলে গালি দিয়ে দিলেই আলফাডাঙ্গাটি বড্ড বীর বাং গালি হয়ে যায়।
গ্লোবাল ভিলেজে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে সত্যিকারের এলিট পদ্ধতিতে। সেইখানে ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা নানাভাবে অপদার্থ প্রমাণিত হবার পর এখন দুর্বল প্রোপাগান্ডা ফিল্ম কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আর গোপালভিলেজের সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স (ক্রাই) কাজ করে বোয়ালমারীর যাত্রা ও সং নৃত্য মডেলে। এরা ফেসবুকে তিন-চারশো টাকা দিয়ে কিছু ছাএলীগের সহসভাপতি নিয়োগ করে। তাদের কাজ গালিতে বাংময় হওয়া। রগড় আর খিস্তির পাটগাঁতি মডেলটিকে সাধারণ মানুষ খুব ভয় পায়। সেই ভয়কে কাজে লাগিয়ে কাজ করে ক্রাইয়ের ছোট চুল ও সুঠাম দেহীরা।
গোয়েন্দা সংস্থার কাজ হচ্ছে আসল ইস্যু থেকে জনগণের ফোকাস অন্যত্র নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে এই কাজে খুব বেগ পেতে হয় না। কারণ বাঙালি মনোযোগ বিচ্যুতিকে প্রিয় বিনোদন বলে মনে করে। তবু হারুনের ভাতের হোটেল খুলে; সেখানে হিরো আলম বা অপু বিশ্বাসকে নিয়ে গিয়ে বানর ও সাপখেলা দেখায় ক্রাই। মাঝে মাঝে দেখবেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুকে গালি দেবার কলতলা জমিয়ে দেয় ক্রাই। সবাই কিছুটা সময় ব্যস্ত থাকে এসব শাখা গল্প নিয়ে। আর চাঁদের বুড়িটা চরকা কাটতে থাকে মনের সুখে।
চাঁদের বুড়ির যে বায়ুচড়া রোগ তাকে কেন্দ্র করে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় জোয়ার ভাটা আসে।
বোয়ালমারীতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর; তার মাথার চুল ন্যাড়া করে দেবার, মুখে চুনকালি মাখিয়ে পয়সার হাটে ঘুরানোর হাজার বছরের ভিলেজ পলিটিক্স প্রচলিত।
গ্লোবাল ভিলেজে তো এক সাঁঝে একটু ডাইনি সেজে হ্যালোউইন ফেস্ট হয়। আর গোপাল ভিলেজে ডাইনি সাজতে হয়না। চিরস্থায়ী ডাইনির চেহারা নিয়ে জন্মেছে অনেক বায়ুচড়া রোগী। ফলে এইখানে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় হ্যালোউইন উতসব। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাশের রাম ভিলেজের তন্ত্র-মন্ত্র খেলা; উলঙ্গ সাধুর নৃত্য। ভিলেজ ফ্যাসিজমের লোকজ সব উপাদান এইখানে উপস্থিত শেকড়সঞ্জাত নিবিড়তায়।
এই প্রথম গ্লোবাল ভিলেজের লোকেদের চোখ পড়েছে এই আদিম জনপদটির দিকে। গ্লোবাল ভিলেজে মিয়ান আরাফদের পাঠিয়ে অধিক রেমিটেন্স আনয়ন, আর বস্ত্র বয়ন করে বিক্রি করতে গিয়ে চোখে পড়ে গেছে এই গোপাল ভিলেজটি। তাছাড়া গ্রামের এক দঙ্গল লোক নিয়ে পশ্চিমে রোড শো করে; বানায়ে ছানায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রুপকথার গল্প বলে; গ্রামটি নিজেই এগিয়ে গিয়ে বলেছে, আমাকে চেনো; আমি বিরাট তালেবর হইছি।
আর চাঁদের বুড়ির পুজো-আর্চা করে স্লামডগ বিলিওনিয়াররা পশ্চিমে গিয়ে সেকেন্ড হোম কিনেছে। দিনের বেলা ফ্রিজের পচা মাছ রান্নার বোঁটকা গন্ধ, রাতে বউ সোয়ামির ঝগড়া শুনে যথেষ্ট বিজ্ঞাপন হয়েছে গোপাল ভিলেজের। স্যাম দেশ অবাক হয়ে দেখেছে; এরা যে রবার্ট মুগাবের দেশের ওপর দিয়ে। তখন তারা ক্যাঁক করে ধরেছে।
এতোদিন দেশের এতো ইংরেজি জানা শিক্ষিত প্রবীণদের গাল দিয়ে ভূত ছুটিয়ে দেবার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ক্রাই ও দপ্তর এবার পশ্চিমাদের নিয়ে একইরকম খিস্তি ও কলতলা লাস্য করে চলেছে।
খালেদাকে গান্ধা করতে কত মুখরোচক গল্প বলে ঠাকুরমার ঝুলি; মুখরোচকতার প্রশিক্ষণ চলে রীতিমতো সাংবাদিক চাকর বাকরদের নিয়ে পান সুপোরি আর উকুন তোলার আসরে। এই উকুন সভ্যতায় যে যতটা উকুন তুলে দেবে সে পাবে ততটা প্লট-পদবী ও পদক।
সুতরাং জো বাইডেনকে গান্ধা কইরা দেয়া হরিদাসপুরের জন্য ওয়ান টু’র ব্যাপার। মধুমতী পাড়ে বালিয়াড়িতে কুস্তি করে বলীবর্দ হয়ে ওঠা ছোট চুল সুঠাম দেহীরা মনে করে, জো বাইডেনকে টাইট দেয়া তো ওয়ান টু’র ব্যাপার।
এমেরিকা থেকে দেশে রেসপেক্ট নিতে আসা মিয়ান আরিফ; যে আর কিছুই নয় একটু গুরুত্বপূর্ণ হতে চায়; তাকে দিয়ে একটা “বাইডেনের উপদেষ্টা” পালা মঞ্চস্থ করেই বগল বাজায় ছাতা সারাইওয়ালার নাতিরা।
ব্যাস গরম পিঠায় ফুঁ দেবার মতো ঠোঁট করে ভাতের হোটেলেরা মিয়ান আরাফের বেড রুমের গল্প বলে। এটা জেনেটিক সংশ্লেষ। নানী-দাদী যেহেতু ঠোঁঠা বাজারে অন্যের বাড়িতে ফুচকি দিয়ে পুকুর পাড়ে “কইয়া দিমু”র আসর বসাতো; নাতিকে তো সেই ঐতিহ্যের মান রাখতে হবে।
রানাপ্লাজার ট্র্যাজেডিতে ফ্যাসিজমের রেশমাকে বাঁচিয়ে রাখা নাটকের কথিত উদ্ধার কর্মকর্তা এখন পক্ক থিকা বিপক্কে চইলা গেছে; সুতরাং তাকে আবার মিয়ান আরিফ যাত্রাপালায় কাস্ট করে কাস্টিং কাউচে শুয়ে নাকের ময়লার বল বানায় বাইগার নদীতে জাল ফেলে মাছ তোলা বড্ড কামেলের পোলা। বাপের পদ্ধতিতে জাল ফেলে মাছ তুলতে এসেছে একবিংশ শতকে।
পশ্চিমে থেকে টেকাটুকা ও প্রতিষ্ঠা পেয়ে বায়ু চড়েছে মিয়ান আরাফের; আর বায়ু চড়া কোটায় গোপাল ভিলেজের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে বায়ুচড়েছে স্লামডগ বিলিওনিয়ারদের। ফলে চেবানো চুইংগাম তেতো হয়ে গেলেও চেবাতেই থাকে পানের বরজের মতো। এতোগুলি ভাঁড় দেশে ক্ষমতা নাটকে ভাঁড়ামি করছে তারা যেন পোকিত উপদেষ্টা; আর মিয়ান আরাফের নিজেকে উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়াতে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে গওহরডাঙ্গায়!
ওদিকে “প্রশ্ন করতে নয়, ভাটের আলাপ শুনতে এসেছি” অনুষ্ঠান থেকে চুপচাপ উঠে যায় পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতেরা। জাতিসংঘ ধরে ফেলে গোপাল ভিলেজের মুখে গামছা বেঁধে নিজেরাই নিজেদের মাথা ফাটিয়ে প্রতিপক্ষের নামে মামলা দেবার বৈপ্লবিক কুমার পালার খেমটা নাচ।
হরতাল-অবরোধ পালিত হতে থাকে পিকেটার ছাড়াই। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক মারা গেলে; ছাতা সারাইয়ের আওলাদ ছদ্ম পুলিশের সাজে রাইফেল হাতে ক্যামেরায় ধরা পড়লেও; বায়ু চড়া এলিট তাতে কিছু মনে করে না। আমার পোলাডা বিদেশে আরামে আছে; এই আত্মকেন্দ্রিক হীনমন্যতার ভিড়ে আরো তুচ্ছ হয়ে ওঠে উপায়হীন শ্রমিকের জীবন। চোখ মুখ লাল করে শহরময় ঘুরতে থাকে ৪০ সদস্যের ইঁদুর বাহিনী। তার হাতে উদগ্র প্ল্যাকার্ড, আমাদের নিষেধাজ্ঞা দাও।
পুরো মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পরিষদের চেহারা ক্রমশ যেন মিয়ান আরাফের মতো দেখায়। প্রবীণ সাংবাদিকগুলোকে যেন মিয়ান আরিফের মতো দেখায়। ফেসবুকে গা বাঁচিয়ে চলা প্রবীণদের চেহারা যেন মিয়ান আরিফের মতো হয়ে যায়। সবাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; কিন্তু ঠিক কিসের জন্য তা কেউ জানে না।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।