মাসকাওয়াথ আহসানঃ
মেয়েরা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে; ফেসবুকে সিপি গ্যাং ও বাঁশের কেল্লা (বিকে) গ্যাং একই ভাষায় তাদের গালাগাল করে থাকে। ২০১৪ সাল থেকে নারী প্রশ্নে সিপি গ্যাং ও বিকে গ্যাং-এর এই কালচারাল ইউনিটি লক্ষ্য করছি।
মানুষ নিজে যে পরিবেশে বড় হয়; সেইখানে নারীর যে অবস্থান সে লক্ষ্য করে; রেগে গেলে বাপ-দাদা যে ভাষায় মা ও দাদিকে গালাগাল করে; শিশুর অবচেতনে সেই বিষয়গুলো ঢুকে যায়। ব্যর্থ পুরুষেরা জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়ার জন্য দায়ী করে নারীকে। ব্যক্তিগত হতাশা প্রকাশে নারীকে গালাগাল করে। ব্যর্থ পরিবারের সন্তানেরা জীবনে সফল হতে সিপি গ্যাং ও বাঁশের কেল্লা গ্যাংগুলোতে যোগ দেয়। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তাদের সাইবার বট হিসেবে নিয়োগ দেয়; ব্যর্থ পরিবারে প্রায় এতিমের মতো বেড়ে ওঠা গালাগালিতে পটু ছেলেদের। ইদানিং কিছু মেয়েও এর সদস্য যারা পুরুষের ভাষায় চ-বর্গীয় গালাগাল দিতে সক্ষম।
সম্প্রতি এক মাঝবয়েসী লোক দু’জন তরুণীকে ধূমপানে বাধা দেয়া ও সমমনা লোকদের নিয়ে তরুণীদের মারধোর করাকে কেন্দ্র করে কিছু তরুণ-তরুণী প্রতিবাদ মিছিল করেছে। অমনি ফেসবুকে সিপি গ্যাং ও বিকে গ্যাং জমজ ভাইয়ের মতো করে তাদের গালাগালে সক্রিয় হয়েছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ করা তরুণীরা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে তাদের ওপর ক্ষুব্ধ সিপি গ্যাং। আর বিকে গ্যাং কল্পনায় নিজেকে সামাজিক পুলিশ বলে মনে করছে; তাই সে প্রতিবাদী তরুণীদের ওপর বিক্ষুব্ধ।
যার আর কোন গর্ব নাই; তার আছে লিঙ্গ গর্ব। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে শিক্ষা-দীক্ষায় নারীরা এগিয়ে। পরীক্ষার ফলাফলে তারা পুরুষের চেয়ে উজ্জ্বল। কর্মক্ষেত্রে তারা দক্ষতা ও আন্তরিকতার কারণে আদৃত। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড গার্মেন্টস সেক্টরে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানে ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজমকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ মূল ভূমিকা রেখেছে। এই যে যারা নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে মিছিল করলো; সে-ই তরুণীরা সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলো জুলাই অভ্যুত্থানে।
আওয়ামী ফ্যাসিজমকালে আমরা দেখেছি ইডেন কলেজের ছাত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী নেতাদের এক্সপ্লয়েটেশনের প্রতিবাদ করেছিলো। লীগের সাবেক মন্ত্রী মুরাদকে আমরা দেখেছি নারী মডেলের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলেছে। দেশলুন্ঠনে রাতারাতি ধনী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা কমফর্ট উইমেন খুঁজেছে; গাজিপুরের বাগান বাড়িকে হোটেল ওয়েস্টার্ন ইন-এ এনে ঢুকিয়েছে। লালসার লালামাখা ফইন্নি রুলিং এলিট নারীকে বাধ্য করেছে হারুনের অসাম্প্রদায়িক ভাতের হোটেলে হাজিরা দিতে। পুলিশ লীগেরও নেশা হয়েছিলো কারণে অকারণে ফেসবুকে একটি সরকার বিরোধী পোস্টের সূত্র ধরে নারীকে ইন্টেরোগেশনের ছলে হ্যারাস করার। সেই আদিম গোষ্ঠী দেশ ছেড়ে পালালে; আমরা ভেবেছিলাম নারীর জন্য সুন্দর একটি পরিবেশ দিতে পারবো আমরা।
কিন্তু ঐ যে লিঙ্গ গর্ব। আওয়ামী যুগে যারা মালয় দ্বীপের এক যে বোকা শেয়ালে হয়ে মুরগী এঁকে দেয়ালে চাটতেছিলো আপন মনে খেয়ালে; তারা ৫ অগাস্টের পর জনপদে নেমে এসেছে নারী নিগ্রহে। সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনাগুলো সেই শেয়ালগুলোর সংঘটিত অপরাধ। আরব বিশ্বে যাদের মিসকিন বলে ডাকে; তারাই সমাজ-পুলিশ হয়ে নারীকে ফতোয়া দিতে এসেছে। ভেবে দেখুন তো, যে লোকটি দুজন তরুণীকে ধূমপান করতে দেখে সিগেরেট পুলিশি করতে গেছে; সে আরব বিশ্বের কোন দেশে আরবি নারীকে ধুমপান করতে নিষেধ করতে কি পারতো! কিংবা ইটালিতে দুজন তরুণীকে গিয়ে সিগেরেট পুলিশ হয়ে চোখ রাঙ্গাতে পারতো! আরব বিশ্বে কিংবা ইটালিতে সে তার মিসকিন আওকাত সম্পর্কে জানে। তাই নিজের দেশে মিসকিন বিরাট সমাজপতি হয়ে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ সমাজের বড় সমস্যা হচ্ছে; নিজের অভিজ্ঞতার বাইরের জগতকে জানতে না চাওয়া; আর নিজের দুই ইঞ্চি গজফিতা দিয়ে সব মানুষকে মাপতে চেষ্টা করা। তাই তো আওয়ামী লীগ আমলে কোন প্রতিবাদ করলে; গলির ধারের সিপি গ্যাং এসে প্রতিবাদকারীকে “পাকিস্তানের দালাল” বলতো; আর আজকাল দেখছি কেউ কোন প্রতিবাদ করলে তাকে “ভারতের দালাল” বলছে। আসলে নিজের বাপ-দাদাকে গরুর হাটে কিংবা টেম্পুস্ট্যান্ডে দালালি করে খেতে দেখেছে বলে; এই হীন মানুষদের জিভের আগায় “দালাল” শব্দটি লম্ফঝম্ফ করে। পার্টির দালালি না করেও যে দুটো ভাত-কাপড়ের সংস্থান মানুষ করতে পারে; এই ধারণা এই দালালস্য দালালদের নেই।
এদের বড় সমস্যা হলো, নিজের পরিবারের মেয়েদের যেরকম দেখে; এর বাইরে অন্যরকম কোন নারী দেখলেই ফতোয়া দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এই পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেণী বিভাগতো রয়েছে। একই সমাজে নানারকম লাইফ স্টাইলের লোক রয়েছে। কাজেই তাদের একেকজনের জীবন যাপন তো একেকরকম তো হবেই। সেই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করার অর্থ অচল মানুষ হয়ে যাওয়া।
যে কোন রকম নারী অধিকার আন্দোলনের মধ্যে দয়া করে আওয়ামী নারীবাদী খুঁজে পাবার বাতিক বাদ দিতে হবে। আওয়ামী নারীবাদীরা আসলে পুরুষবাদী; ওরা ওবায়দুল কাদের অথবা আরাফাতের চোখে নারীকে দেখেছে। এইসব হাফ এডুকেটেড বলতেসি খাইতেসি বলে কপালে একটা উষা উত্থাপ টাইপের পিতজা এঁকে স্মার্ট হতে চেষ্টা করা ললিতাদি কিংবা বদনা আপা দেখে জেনজি তরুণীদের বিচার করলে হবে না। জেন জি তরুণ-তরুণীরা পরিবার থেকে নারী-পুরুষ সমান অধিকারের চর্চা দেখে বড় হয়েছে। আর সেটা সব অর্থনৈতিক বৃত্তেই ঘটেছে। ফলে এটা একটা নতুন সময়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের আউটডেটেড চিন্তাভাবনা দিয়ে একবিংশকে বিচার করতে গেলে তা হবে কৌতুক প্রদ চেষ্টা।
যে ছেলেরা অচল বৃদ্ধদের চিন্তা নিয়ে নবীন শরীরে ঘুরছে; তাদের প্রতি অনুরোধ; মন দিয়ে পড়ালেখা করার। সারাক্ষণ নারী কি করলো, নারী কি পরলো, নারী কি সিগেরেট পান করলো; এইসব চিন্তা করতে করতে দেখা যাচ্ছে; সমবয়েসী নারীরা ঠিকই মন দিয়ে পড়ালেখা করে; কর্মক্ষেত্রে ও জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাবে। তারপর ব্যর্থ জীবনে বিবাহ ও সন্তানাদি হলে তখন নিজের মেয়েটিকে নিয়ে প্রাইভেট টিউটরের বাসায় দৌড়াদৌড়ি করতে হবে; আর স্বপ্ন দেখতে হবে, আমার মেয়েটি যেন তার সাফল্য দিয়ে পরিবারের সমস্ত বেদনা ও গ্লানি মুছে দিতে পারে।
(ছবিতে জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ নারী)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।