মাসকাওয়াথ আহসান
শোকে বিক্ষুব্ধ হয়ে তরুণ লেখক সুদীপ্ত বিভু না লিখলে জানতেও পারতাম না; মধুখালিতে কী হয়েছে! কারণ সুদীপ্তের মতো করে সত্য কথা বলার সাহস অর্জন করতে পারেনি মায়ানগরের বেশিরভাগ মানুষ।
ঋষি দরবেশের গড়া মায়ানগরে প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে মোদি ও এরদোয়ান ঘোরাঘুরি করেন সংস্কৃতি অঞ্চল জুড়ে। সেখানে মৃতদেহের ধর্ম থাকে, রাজনৈতিক দল থাকে। মৃতদেহ কেবলই একটি মৃতদেহ হতে পারেনা।
মায়ানগরে লাশগুলো ভাগ করে নিয়ে কাঁদে শহীদ মিনার ও বায়তুল মোকাররম সংহতি।
সিনিয়র সাংবাদিক মিলন ইমাম না লিখলে জানতে পারতাম না; কী করে ফরিদপুরের পঞ্চগ্রাম বিভাজিত হয়েছে ধর্ম ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে। প্রশাসনের লোকেরা পৌঁছাতে আরেকটু দেরি করলে নির্মাণ শ্রমিক দুটির লাশ পুড়িয়ে ফেলার আয়োজন চলছিলো। আর পুলিশ সচেতন না থাকলে এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে জড়ো হচ্ছিলো জানাজার নামাজিরা।
মন্দিরের প্রতিমার শাড়ি পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ এনে দুটি তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে মোদিভক্তরা। এরদোয়ানভক্তরা এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে হাত মুঠি করে ঘুরতে থাকে। শান্তির আহবান জানান মিলন।
কিন্তু মায়ানগরের কোন হেলদোল নেই। লালনের গানের দুটি লাইন লিখে কারাগারে যাওয়া তরুণের মুক্তির জন্য নাগরিক সমাজ উত্তাল হয়ে ওঠে। তার আগে আম্পায়ার জেসিকে দাড়ি ও নামাজের দায়ে অভিযুক্ত ক্রিকেটাররা মেল শভিনিজম দেখিয়েছেন কীনা তা নিয়ে ফুঁসে উঠেছিলো সানন্দা আপারা। অনেক ট্রেন্ডি আর সেক্সি এইসব ইস্যু। ইস্যু নিয়ে ঘর করি; ইস্যুর বসত গড়ি। এবারে যে তীব্র গরম পড়েছে তাকে দাবদাহ নাকি তাপদাহ বললে তা ব্যাকরণ সম্মত হবে; এই বিতর্কে ব্যস্ত মায়ানগরীর পণ্ডিতেরা। কেউ কেউ বলে এটা গরমের বাপ বলে বাপদাহ হতে পারে; কিংবা পরিবেশের ওপর পোদ্দারিজনিত দাহ বলে একে পোদ্দাহ-ও বলা যায়।
মায়ানগর ক্রমাগত সংস্কৃতি মামা ও খালাদের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি যেন। এইখানে অমিত আর লাবণ্যের গল্প, বিমলা আর সন্দ্বীপের গল্প, আলুথালু চারুলতার গল্প। কিন্তু এইখানে বিভূতিভূষণের অপু-দুর্গা নেই; ম্লেচ্ছ নির্মাণ শ্রমিকের গল্প নেই; মায়ানগরী অত্যন্ত নন্দনতত্ত্ব সচেতন উচ্চ নগরী। এইখানে নিম্ন নগরীর বিষাদের গল্প নেই; বরং নিম্ননগরীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সামান্য একটু চুক চুক করে, তারপর পোড়া নিম্ননগরীতে মায়ানগরীর ডেভেলপারদের বুলডোজার আর সিমেন্ট-বালু মেশানোর ঘড় ঘড় শব্দ।
গতকাল সিলেটের শাহপরান এলাকার এক মুয়াজ্জিন আত্মহত্যা করে, চিরকুটে লিখে গেছে, আমার মৃত্যুর জন্য কতৃপক্ষ দায়ী নয়। এই মৃত্যুটা এক্কেবারেই গ্ল্যামারাস নয়। রিক্সাওয়ালা শাকিলকে মিথ্যা চুরির অভিযোগে ছাদ থেকে ফেলে মেরেছে নতুন ধনিক পুত্র। ম্যাড়মেড়ে একটা হত্যাকাণ্ড। মায়ানগর এসব হ্যাভস নটের উপকথা একপাশে সরিয়ে রাখে। বরং অভিমানী সিন্থিয়া প্যারাসিটামল খেয়ে আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করলে, সানন্দা খালামুনিরা নেমে আসে অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে, উই আর উইথ সিন্থিয়া।
এইভাবে মধুখালির সঙ্গে মায়ানগরের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে দুটো আলাদা গ্যালাক্সি হয়ে যায়। হারুনের ভাতের হোটেলে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় লালনের গান লিখে গ্রেফতার হওয়া যুবককে। তখন সংস্কৃতি মামারা আসে এই মুক্তি আন্দোলনে কারা কারা নীরব ছিলো তাদের ঠিকুজি নিয়ে। এরা নিশ্চয়ই মৌলবাদী।
কিন্তু মধুখালির দুই তরুণের হত্যাকাণ্ডে স্পিকটি নট হয়ে থাকা কালচারাল কাজিনেরা মৌলবাদি নন; ভীষণ প্রোগ্রেসিভ ও পজেসিভ; এই প্রোগ্রেস জিডিপি গ্রোথ ও ব্যাংক রিজার্ভের অনঙ্গ উন্নয়নের সূচকের মতো।
মায়ানগর বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ হয়ে যেতে থাকে। নিম্ননগরীতে জয়নুল আবেদীনের বুভুক্ষু মানুষ এস এম সুলতানের পেশীবহুল মানুষের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ফসল ফলায়, অনাবাসে উদয়াস্ত কাজে যায়, সেলাই কারখানায় কাটা পায়ে নুপুর পরে সূচের শিল্প করে।
মায়ানগর মাঝে মাঝে মাথার হেলমেট খুলে হাতে মেহেদি দিয়ে কাস্তে হাতে ধান কাটতে গিয়ে পঞ্চগ্রামের কৃষককে সারপ্রাইজ দেয়। এমপ্যাথি শব্দটি সকাল বেলা অভিধানে দেখে রিক্সাওয়ালাকে এক বোতল ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিলে, রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করে, ছবি তুইলা ফেসবুকে দিবেন না মামা!
প্যালেস্টাইনে চলমান ইজরায়েলি গণহত্যা নাগবার প্রতিবাদে এমেরিকা ও ক্যানাডার এলিট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকেরা আন্দোলনে উত্তাল হলে; মায়ানগরের ফক্সফোর্ড মগ্ন থাকে হনুমান চল্লিশায়; নর্থ ডোয়ার্ফে ছাগনৃত্যের ভ্যারাইটি শো চলে।
মায়ানগর গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। দূরে আরো দূরে সরে যায় মধুখালি; মধুখালির ছোটখাট মানুষ বুঝতে পারে; পৃথিবীতে ধর্ম আছে দুটো- ধনীর ধর্ম আর গরীবের ধর্ম; বাকিসব অযথা চক দিয়ে মানুষকে বিদ্বেষে বিভাজিত করার খেলা। যেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে হ্যাভস নটেরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। এই বোধোদয়ে শান্ত হয় পঞ্চগ্রাম।
বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মায়ানগরীর রাণী মৌমাছি লক্ষ্য করেন; উন্নয়নের মৌচাক শুকনো ফসিল হয়ে ড্রইং রুম সজ্জা আজ মায়ানগরীর রুপের রাণী চোরের রাজাদের।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।