মাসকাওয়াথ আহসান
২০০৮ সাল পর্যন্ত বিশিষ্ট নাগরিক শব্দটি আমার মনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষায় বয়সে যারা বড় তাদের একটা সহজাত সম্মান জানানোর অনুশীলন ছিলো। এরপর বিতর্ক আন্দোলন, সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সূত্র ধরে সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেখার ও কথা বলার সুযোগ পেয়েছি।
অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়েছে। তাদের কারো কারো অনলাইন অপমান দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। কারণ এদের অধিকাংশের স্নেহ পেয়েছি; ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই কৃতজ্ঞতাবোধ আমৃত্যু ধরে রাখবো। আমার অনেক লেখাতেই আমি দাবী করেছি, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে অশিষ্ট কথা বলা অনুচিত।
আমি আজো বিশ্বাস করি, কোন ব্যক্তি সম্পর্কেই অশিষ্ট সাইবার কথন বড্ড অশালীন আচরণ। জীবনকে সাদা-কালোয় না দেখে ধূসরতায় আবিষ্কার করলে; সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে এদের প্রতিভার অপমৃত্যু দেখে আমি বেদনা অনুভব করি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একটু নির্ভার জীবন যাপনের সুযোগ পান। বাংলাদেশে ধর্মের নামে বহুত্ববাদী মানুষদের উইচহান্টিং চলেছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বহুত্ববাদী চিন্তার দল হিসেবে আদৃত ছিলো। ফলে বাংলাদেশের লেখক-কবি-সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষক-সাংবাদিকদের বড় অংশটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আদর্শিক নৈকট্য খুঁজে পেয়েছিলো।
আওয়ামী লীগ এরশাদের ১৯৮৬-র নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রের সঙ্গে শঠতা করলেও; বঙ্গবন্ধুর ইমেজের কারণে তারা ভুল শুধরে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আসে। আর শেখ হাসিনা সামাজিক মানুষ বলে বহুত্ববাদী লোকেরা তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে থাকে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী করলে, শেখ হাসিনা তাকে সমর্থন দেন। এরফলে বহুত্ববাদী সমাজের প্রিয় বুবু হয়ে পড়েন তিনি।
ঢাকার এই বুবুর মধ্যে তার পিতার রসবোধ, আতিথেয়তা, আন্তরিকভাবে মেশার গুন থাকায় বহুত্ববাদীরা সুধা সদনকে হাসুবুর বাড়ি হিসেবে এক আন্তরিক আড্ডার জায়গা হিসেবে পেয়ে যান।
আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন করলেও; ঠিক সময়ে এদের ছুঁড়ে দিতে পারে টিস্যু পেপারের মতো। আর এই কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের ভেতরের কট্টর হিন্দুত্ববাদী অংশেরও। তারা বুবুকে নিয়মিত চাপ দিয়েছে কট্টর ইসলামপন্থীদের ছেড়ে দিতে।
এরফলে হাসিনা বিপদেও পড়েছেন। তার প্রতিপক্ষ চট করে তাকে ইসলামহীনের তকমাও দিয়েছে। তাইতো মাথায় ইসলামি কালো ফেটি পরে তাকে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে হয়েছে। কৃতিত্বের সঙ্গে একহাতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী আর এক হাতে কট্টর ইসলামপন্থী নিয়ে বাংলাদেশের ভিলেজ পলিটিক্সে সফল হয়েছেন।
খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের হাউজ ওয়াইফ থেকে রাজনৈতিক নেতা হওয়ায়, তার ঐ যে সোফায় বসে থাকা, অল্প হাসা, অল্প কথা বলা, শিফনের শাড়ি পরে রাজহংসী হয়ে বসে থাকা; বহুত্ববাদী সমাজকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। “ম্যাডাম” ডাকটি খালেদাকে “বুবু” হাসিনার চেয়ে কম জনপ্রিয় করেছে। বিএনপির রাজনীতির উপাদান ছিলো মুজিব বিরোধিতা; এন্টি আওয়ামী লীগ পলিটিকস তাই হবার কথা। কিন্তু বিএনপির ভিলেজ পলিটিক্সের লোকেরা সেইখানে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। জিয়া যেমন এন্টি মুজিব পলিটিকস করলেও কখনো মুজিব সম্পর্কে কোন অশালীন কথা বলেননি। এন্টি মুজিব রাজনীতি করতে গেলে জামায়াতকে লাগে। তাই বিএনপির সঙ্গে জামায়াত তামাক আর ফিলটার হয়ে পড়ে। ভারতে মোদী ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিজেপিকে যেমন তামাক আর ফিল্টার হিসেবে আবিষ্কার করলাম আমরা।
জিয়া ও খালেদা সম্পর্কে অশালীন কথা শেখ হাসিনা অনেক বেশি বলেছেন; কারণ তিনি গোপালগঞ্জের মেয়ে। ওখানে মানুষ খুব ভালো, কিন্তু লোকজ রসবোধ তাদের প্রবল। খালেদা জলপাইগুড়ির মেয়ে, ঝগড়া করতে জানেন না তেমন। একদিন একটু রেগে টেলিফোনে ঝগড়া করলে হাসিনা তা গোপনে রেকর্ড করে শুনিয়ে দেন। অবশ্য প্রত্যেক বৃহস্পতিবার হাসিনা গণভবনে সাংবাদিক ডেকে খালেদা নিয়ে রগড় করে উইক এন্ড পার্টি করেছেন।
বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের বহুত্ববাদী মানুষগুলো কষ্টে ছিলেন। প্লট পদবী পদক তো দূরের কথা অনেকে জেলে গেছেন। ফলে তারা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বিএনপি তোকে বাগে পেয়ে নিই আগে।
আগে ভাবতাম বহুত্ববাদ বুঝি এদের আদর্শ, এরা হয়তো সত্যিই দেশপ্রেমিক; মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার- গণতন্ত্র, সাম্য, বহুত্ববাদ, সামাজিক সুবিচারে গভীরভাবে বিশ্বাসী। ভারতের প্রণব মুখার্জিকে প্রথমে বাম আদর্শ ও পরে কংগ্রেসে দেখে যেমন ভেবেছিলাম খাঁটি প্রগতিশীল। পরে মোদী ক্ষমতায় এলে শিবসেনা মন্দিরে গিয়ে তিনি যখন আবেগে আলুথালু হলেন, নিজের মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে বিজেপির টিকেটে সাংসদ হতে অনুরোধ করলেন, বুঝলাম ভদ্রলোক সারাজীবন আমাদের বোকা বানিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি তার আধিপত্যবাদী মনোভাব তার “কোয়ালিশন ইয়ারস” বইতে তিনি নিজেই প্রকাশ করে গেছেন।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা যখন ব্যাংকের ডিরেক্টর হয়ে তা খেয়ে দিলেন, বিমানবন্দর রুপসজ্জার ঠিকাদারি নিলেন, রেলস্টেশনে বন্দরে কন্টেইনারের ব্যাপারী হলেন, প্লট সাংবাদিক, পদক বুদ্ধিজীবী হলেন, পদবীর জন্য লালায়িত হয়ে মাজার ধরে কাঁদাকাটি শুরু করলেন, তখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লার উপন্যাস লালসালুর মজিদ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস-আশ্রয়ী সত্যজিত রায়ের চলচ্চিত্র ঘরে বাইরের সন্দ্বীপের মতো তাদের স্বরুপ উন্মোচিত হলো। মানে স্বার্থ ছাড়া এক পা হাঁটেননি ওরা। হাসুবুর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। টেকাটুকার অংকে তাদের আনুগত্য কিনতে হয়েছে।
এই বিশিষ্ট নাগরিকদের কাছে মানবতাবিরোধী অপরাধ কেবল ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয়ে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেই সংঘটিত হয়ে তারপর থেমে গেছে। আওয়ামী লীগের গত পনেরো বছরের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম-খুন, বিরোধী দল নির্মূলে মানবাধিকার হরণ, সর্বব্যাপী লুন্ঠন এসব মানবতা বিরোধী অপরাধকে তারা স্বাগত জানিয়েছেন নানা লাস্যে। মানে যে কোন কিছু বিএনপি করলে হারাম, আওয়ামী লীগ করলে আরাম।
বিশিষ্ট নাগরিকেরা “কাঁদো বাঙালি কাঁদো” বলে রুদালি ক্লাব গড়ে তুলেছেন ১৫ আগস্ট ও ২১ শে আগস্ট কান্নাকাটি করার জন্য। এই অশ্রুর মূল্য কিন্তু আওয়ামী লীগকে চুকাতে হয় ক্যাশ ও কাইন্ডে।
কক্সবাজারে ক্রসফায়ারে খুন হওয়া কাউন্সিলর একরামের মেয়ের “আব্বু তুমি কী কান্না করতেছো” কিংবা গুম হয়ে যাওয়া বিএনপি নেতার মেয়ে সাফার অসহায় অশ্রুজল ও অসহায় কান্না কক্ষণো এই বিশিষ্ট নাগরিকদের আন্দোলিত করেনি। কারণ তাদের হৃদয় আওয়ামী লীগ মোহর দিয়ে বাঁধাই করে দিয়েছে।
এরা এমন এক দম দেয়া পুতুল যে হাসু বু যে কোন বক্তৃতায় এক লক্ষ তমবারের মতো অশ্রুসিক্ত হলেই, তাদের চোখের একোয়াস ও ভিট্রিয়াস হিউমারে টান লেগে ঝরঝর করে পানি পড়ে।
বিশিষ্ট নাগরিকেরা এক কোটি তমবার “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” শব্দ বন্ধ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই চেতনার প্রথম শর্ত গণতন্ত্র, যা রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো; সে ব্যাপারে তাদের অনুশীলিত নির্লিপ্ততা। রাতের নির্বাচনের ফলাফলকে ফুল দিয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন এরা।
এরা নিজেরা ব্যাংক খেয়েছেন, ব্যাংকের মানি হাইস্টের সহযোগী হয়েছেন, অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে কথা বলার সময় সন্ন্যাসী সেজেছেন। শ্রদ্ধেয় বারাকাত স্যার প্রশ্ন রেখেছেন, ইউনুস শহীদ মিনার কিংবা স্মৃতিসৌধে যাননি কেন! বারাকাত স্যারের প্রশ্নটি, আপনি মসজিদে যাননি কেন, সুতরাং কাফফারা দিতে হবে গোছের। স্যার জনতা ব্যাংকের দায়িত্বে থাকার সময় যে জনগণের টাকা ডাকাতি হয়ে গেলো, উনি রক্ষা করতে পারলেন না, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে নিয়মিত যাবার পূণ্য দিয়ে কী ঐ জন আমানত খিয়ানতের গুনাহ কমবে কোন ভাবেই।
এস আলমের টাকা পাচারের খবরে জনগণ বিক্ষুব্ধ হলে, আদালত সুয়োমটো দিয়ে সে ক্ষোভ চাপা দেয়। বিশিষ্ট নাগরিকেরা স্পিকটি নট। অথচ ইউনুস কী কী ভুল করিয়াছিলো এ নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশের উপক্রম করেছেন তারা। তুমি সহমত সাধু হলে আজ বুবুর গ্লাডিয়েটরে!
আসল ব্যাপার হচ্ছে ইউনুস বিশ্বতারকা হতে পেরেছেন। অন্যদিকে বিশিষ্ট নাগরিকেরা শাহবাগ থেকে বইমেলা, ঢাকা টু কলকাতা, বিদেশে সরকারি মনোনয়নে সেমিনার, পশ্চিমে প্রবাসীদের আয়োজিত সাংস্কৃতিক ওরস মেহেফিল, আওয়ামী লীগের বদান্যতায় দুটি পদক আর সরকার কিনে নেবে এই শর্তে দুটি মুজিব বন্দনা বা বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে দুটি ফাঁকিবাজি গবেষণা গ্রন্থ, জোড়াতালি দেয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ, অপাঠ্য উপসম্পাদকীয়, সাহিত্য পাতায় ক্লিশে আলোচনা। দ্যাটস অল। সংস্কৃতি চর্চায় থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়। সামান্য যে ট্যালেন্ট ছিলো তা বহু ব্যবহারে জীর্ণ। ইন্টারনেট মিডিয়ায় পৃথিবীর জানালা খুলে নতুন প্রজন্ম বিশ্বের সৃজনশীল কাজের সেরা দৃষ্টান্ত দেখে ফেলার পর; এরা ক্ষয়িষ্ণু আলকাপ নৃত্য বা যাত্রাপালা যেন। মায়া করে দেখি এদের কাজ, এমন একটা ব্যাপার।
কিন্তু বিশিষ্ট শব্দটি হচ্ছে ব্রাহ্মণ বা আশরাফ তকমার মতো। আপনার কোন স্কিল নাই, কাজ করে খাওয়ার মুরোদ নাই, তাই কল্পনার জগতে নিজেকে অযথা সুপিরিয়র প্রমাণের জন্য “বিশিষ্ট” শব্দটি লাগিয়ে মনের খুব গভীরের অক্ষম হীনমন্যতায় প্রলেপ দেয়া। এদের মুখমণ্ডল থেকে বহুত্ববাদীর মেক আপ খসে গিয়ে একদলীয় ফ্যাসিজমের বলিরেখা দৃশ্যমান দিনের আলোয়, এমনকী রাতের অন্ধকারে!
এর চেয়ে সৃজনশীল কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক, সেলাই শ্রমিক, কলকারখানার শ্রমিক, বাদামওয়ালার কন্ঠে কাঁচা বাদাম গানের বিশ্ববিস্তার, কিছু করে খাওয়ার যোগ্যতার মধ্যে সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের উপস্থিতি।
রঙ্গভবনে তেলাঞ্জলি দেয়া বিদূষক, বাতাবি টিভিতে বঙ্গপাঞ্জাবি সেজে দিবসগুলোতে মুখে সুপোরি পুরে ভসভস, আর ভুল বানানের গ্যাং প্রেস রিলিজ; এও আবার জীবন! এমনি করে গড়েছো ভাই জীবন, মরণে কাঁদবে তুমি হাসবে ভুবন।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া