মাসকাওয়াথ আহসান
“How easy it is to make people believe a lie, and [how] hard it is to undo that work again!” — Mark Twain
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারা-অন্তরীণ রেখে; আবার একটি ওয়াক-ওভার ভোটের আয়োজন চলছে। ভোটসমনিয়ার তফশিল সম্প্রদায় পার্টি অফিসে কাচ্চি রেঁধে খাচ্ছে। মধুমতী নদীর বালিহাঁসেরা এরোপ্লেনের বিজনেস ক্লাসে চড়ার স্বপ্নে মশগুল।
এই সময় “এই উন্নত কারাগার, বারবার দরকার” গেয়ে ভোটসমনিক তফশিল সম্প্রদায়ের যারা একটু শিল্প-সংস্কৃতির পুজো-আর্চা করতে শিখেছে; একটু কোবতে-সংগীতের মাজারে কপাল ঠুকতে শিখেছে; সেই লুতুপুতু সমাজ বেশ ভোটের আগে ভাটের আলাপের গতি বাড়িয়ে দেয়।
শতবর্ষে কপি পেস্ট ভাটের গ্রন্থ সরকারের কাছে বেচে; অথবা স্মরণ অনুষ্ঠানের বাজেট খেয়ে ফেলে যাদের বিশাল বপু ও নধর তনু হয়েছে; তারা বেশ সপ্তাহান্তে ছুটির দিনটি এলেই ফেসবুকে সংস্কৃতি করে।
নজরুলের গীতিকবিতার কবাট শব্দটি কেন কপাট হলো! এই আলোচনায় চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হয় সাহিত্য মামা। সাহিত্য খালার সঙ্গে বিরাট বচসা তার এই কবাট ও কপাট নিয়ে।
–কে একজন বেরসিক এসে বলে, কারান্তরীণ বিরোধী দল; আর সরকারি দল আবার একটি লাইলাতুল ইলেকশন করতে উদ্যত! গণতন্ত্র এই যে কারাগারে নিক্ষিপ্ত! সেই কারার কবাট বা কপাট নিয়ে কিছু বলুন।
কিন্তু সাহিত্য মামা ও খালার ঠোঁটের আলাপ কেবল শব্দ নিয়ে সুর নিয়ে; যাতে বিদগ্ধ আলোচনা দেখে দেখে বাংলা একাডেমি তাদের ফেলোশিপ দেয়। তখন বেশ শান্তিপুরী শাল কাঁধে চাপিয়ে একটা শৈল্পিক ঝোলা নিয়ে আকর্ণ হাসিতে নজরুল মঞ্চে উঠে ফেলোশিপের উত্তরীয় পরে নেয়া যাবে। অথবা একটা বর্ণমালা ছাপা শাড়ি পরে; কপালে একটা ড্যাপসা করে টিপ দিয়ে সামনের সারিতে বসে; খিলখিল করে হেসে কাজী হয়ে ওঠা যাবে নজরুল আলোচনায়।
হঠাতই ফেসবুকে কাফকার আলোচনাটা হাজির করে মোহাব্বত মিয়া; ফেসবুক আইডিতে সে এম সারথি নাম ধারণ করেছে। সবাই কাফকার মেটামরফসিস গ্রন্থের নাম জেনে গেছে; তাই এম সারথি দ্য ট্রায়াল উপন্যাস নিয়ে গল্প চাঁড়ে। কীভাবে জোসেফ কে নামে এক ইনসুরেন্স এজেন্ট এক মামলার প্যাঁচে বিচার বিভাগের ল্যাবিরিন্থে অসহায়ভাবে ঘুরপাক খেতে থাকে; সেই গল্পটা নিয়ে আকুল হয়।
এক তেতো মন্তব্যকারী এসে বলে, ঐ যে কুবরা মেয়েটা অপ্রাপ্তবয়ষ্ক একটি কিশোরী একটি ওয়েবিনার হোস্ট করলে; সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স তার পিছে লেগে গেলো; কুবরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে অপ্রাপ্ত বয়সে করা কথিত অপরাধের দোহাই দিয়ে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো; বিচার বিভাগের প্যাঁচে তার মা ও বোন অনিশ্চয়তার ল্যাবিরিন্থে ঘুরপাক খেলো। অবশেষে সেদিন জামিন পেলো সে। কুবরার ট্র্যাজেডিতো জোসেফ কে-র ট্র্যাজেডির চেয়ে কম কিছু নয়।
এক আধুনিকা আলোছায়া মলি আপা এসে মন্তব্য করে, ঐ যে, যে মেয়েটা মাথায় স্কার্ফ বাঁধে, ঐ মৌলবাদি মেয়েটির কথা বলছেন! মলি আপার পরিচিত বিজেপি-প্রগতিশীল অপলক সঞ্জয় বলে, মলিদি ঠিকই ধরেছেন; মেয়েটি নিশ্চয়ই জামাতি। এরপর সেই ভাটের আলাপ সম্প্রসারিত হয়ে কলতলাসুরে ভট ভট করতে থাকে।
বিজয় বাবু সাক্ষাত রোবনাথ হয়ে ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের গোমস্তা হয়ে উঠেছেন। তিনি আলতো করে লেখেন, রবীন্দ্রনাথ একটি সম্পূর্ণ জীবন চর্যা। আজ তার ছোট গল্প পড়ছিলাম আরেকবার। কী ফর্ম-ন্যারেশন-থিম! একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব।
কে একজন মন্তব্যে এসে বলে, রবীন্দ্রনাথের “ঘরে বাইরে” উপন্যাসে বর্তমানকে খুঁজে পাওয়া যায়। এই যে দেশপ্রেম করে খাওয়ার যে রাজনীতি ব্যবসার ধান্দা; সে সম্পর্কে তিনি সাবধান করে গেছেন অনেক আগেই।
বিজয় বাবু একটু বিব্রত বোধ করেন। তারপর গালে সুপোরি পুরে বলে, আপনার টাইম লাইন ভর্তি সরকার সমালোচনা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহন করছেন। কী লজ্জা কী লজ্জা! পিতর হাসের ভক্ত নাকি!
–না দাদা আমি মোদীভক্ত। আশায় আছি; আবার একটি রাতের ভোট করে দিয়ে যাবে!
বিজয় বাবু এইবার অভ্যাস বশত তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলাপে চলে যান, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে চেয়েছিলো এমেরিকা। এতোসহজেই ভুলে গেলেন, তখন ভারত উদ্ধার না করলে ফিলিস্তিনিদের মতো হয়ে থেকে যেতেন।
–এখন কী কম ফিলিস্তিনি কিছু! আসলে দাদা এ আমাদের ভাগ্য; জমিদারের তালুক, বৃটিশের তালুক, পাকিস্তানের তালুক হয়ে তারপর ভারতের তালুক। সার্বভৌমত্বটা যে ঠিক কোথায় বুঝতে পারিনা। নিজের সরকার নিজে ভোট দিয়ে ঠিক করার অধিকার নাই যেখানে; সেটাকে আর স্বাধীন দেশ বলি কী করে!
বিজয় বাবু রবীন্দ্রনাথের “যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ্র মন্থরে, সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া”, আবৃত্তি করে বলেন, সব কথা মুখ ফুটে বলতে পারিনা। শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভুঁই আর সবি গেছে ঋণে।
কমেন্টের লোকটা ঝিনুক নীরবে সহো বলে বিজয় বাবুর গলা ধরে মধ্যবিত্তের কান্না জুড়ে দেয়।
মুক্তির আকাংক্ষা হয়তো সবারই আছে; কিন্তু সাহসটা নেই; তাইতো যখন যে বহিঃশক্তি এই শ্রীখণ্ডে দখলদার হয়েছে ,তারই কোলাবরেটর হয়ে কাটছে এইসব তুচ্ছ জীবন। এও আবার জীবনরে!
কোলাবরেটর গাতকও খুনি হয়; সারাদিন “অস্ত্র উদ্ধারে চলো”; বিরোধী শক্তিকে পিষে ফেলো বিপ্লব; বলেই থিকথিকে রিরংসা শেষে সস্তা সিগেরেটে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলা রবার্ট মুগাবে ফেসবুক লাইভে হারমোনিয়াম খেলিয়ে গান ধরে, “মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোপায় তারার ভোট!”
পিএইচডি স্টুডেন্ট এমেরিকায় বসে আলাপ করে ওখানকার গণতন্ত্রের ত্রুটি নিয়ে। কমেন্টে সারি সারি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সারিন্দা, ভিয়েতনাম, ইরাক, প্যালেস্টাইন নিয়ে সেকি বিদগ্ধ আলোচনা। শুধু আলাপ নেই “ভাতার” ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে। গার্মেন্ট মালিকেরা লেন্দুপ দর্জির বংশবিস্তার করে শোষণ নিপীড়নের সিকিমে বড্ড খুশি আজ।
শিশুকালে “জীবনের লক্ষ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার” করতে গিয়ে ক্রিয়েটিভ কোন কাজ শেখা হয়নি। অবশেষে ফেসবুক এসে প্রাক-বৃদ্ধ বয়সের লেট ইয়ুথে ক্রিয়েটিভিটির বড্ড চাপ বেড়েছে। সবাইকেই শুক্রবার এলে সাহিত্যিক-চিত্রকর-সংস্কৃতি বোদ্ধা হতে হয়। এই কাজগুলো করে মানেই যে নৈতিকতার বোধ জন্মেছে কিংবা সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের মন তার; তা কিন্তু নয়; মনটা সবসময় আঁকুপাঁকু করে তেলাঞ্জলি দিতে। আই বাই সাঁই এটা ওটা ভাটের আলাপ করতে করতে, হঠাতই “মেট্রোরেলে চড়ে আনন্দ অপার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মাত্র দশমিনিটে উত্তরা থেকে ঢাকায় এলাম” বলে উহ্য রাখে সেই পুলক, এই নান্দনিক কারাগার, বারবার দরকার।
যে কোন একফাঁকে আল্লাহ ও ভগবানের প্রশংসা করে পরকালের বেহেশতের ইচ্ছা প্রকাশ করে যেমন কিছু লোক; ঠিক তেমনি ক্ষমতাল্লাহ বা ঈশ্বরের মাজারে কপাল ঠুকে ইহকালের বেহেশতের ইচ্ছা জড়ো করে ভাটের আলাপ বৃন্দ।
পরপর তিনটা ইলেকশনে “ভোট” দিতে পারেনা; উত্তর কোরিয়া-কম্বোডিয়া-বেলারুশের পাগলা হাওয়া মৌ মৌ; পথে পথে সশস্ত্র কোটাল পুত্রের টহল; ফেসবুকে কোলাবরেটর কুমিরের সাঁতার, আর বিমূর্ত আর্ট এক্সিবিশান কিংবা পেলব থিয়েটার দেখে; আহাউহুর সে কী বিস্তার। ফাঁকে ফাঁকে আবার বায়োপিক দেখে কেন্দে দিয়ে ইহকালের বেহেশত ঠিক রাখতে হয়।
অথৈ কুলসুম আপা সবাইকে লাইফ স্টাইল শেখায়, স্বামী ও বাচ্চা মানুষ করতে শেখায়। আকলিমা নদী আপা শেখায় কী করে দুস্থদের সাহায্য করে এওয়ার্ড জিততে হয়; কী করে রাজজয়িতা হয়ে রণভবনে গিয়ে কাঁচুমাঁচু করা যায়।
কেউ কেউ মূল্যবোধের আলাপটা তোলে, ছাত্রলীগের নেতা আসাতে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে তুলে দিয়ে চেয়ার সাধা হয়েছে! ভোটের আগে ভাটের আলাপের বিবৃতি লীগ আর ছাত্রলীগের মধ্যে পার্থক্য তো নেই। কীসের হা-হুতাশ!
বৃটিশেরা যে “চেয়ারে” বসতে শিখিয়েছে; সেইখানে বসার জন্য ভোটসমনিক তফশিল সম্প্রদায় মরণপণ বাজি ধরে। পিছনে একটা ব্যানার টাঙ্গিয়ে পাঁচটা নতুন লোক মঞ্চের চেয়ারে উপবিষ্ট, সামনের সারিতে চেয়ারে বসা পিঁপড়াবিদ্যার নতুন সুধী; সরকারি অফিসে চেয়ারের সঙ্গে সুপারগ্লু দিয়ে পশ্চাদদেশ আটকে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে নতুন নতুন স্যার! এই সমস্ত ছোট ছোট চেয়ার বড় একটি চেয়ারের পাহারাদার হয়ে রব তোলে, এইরকম চেয়ার, বারবার দরকার!
মানবিক চেয়ার সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে ভোটেরকলি, সকলি ফুটিল।।
হারুন গরুর পাল, ল’য়ে যায় মাঠে।
বিদূষকগণ দেয় জ্ঞান নিজ নিজ ঠোঁটে।।
ফুটিল ক্ষমতা ফুল, টেকাটুকা ছুটিল।
দলবল লোভে অলি, আসিয়া জুটিল।।
গগনে উঠিল কবি, রক্ত বরণ।
আঁধার পাইয়া লোক, পুলকিত মন।।
উন্নয়ন বাতাস বয়, জুড়ায় শরীর।
ডলারে ডলারে পড়ে, নিশি ভোটের শিশির।।
উঠ সহমত মুখ ধোও, পর খাদেমের বেশ।
আপন তেলেতে মন, করহ নিবেশ।।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ঘরে বাইরে” উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিত রায়ের চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।