মাসকাওয়াথ আহসান
এমপি সাহেব এককালে বেশ রঙ বাহারের লোক ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার খ্যাতি ছিলো তার। হলে নতুন ছবি মুক্তি পেলে ফার্স্ট শো দেখে ফেলতেন। ভোরবেলায় রেডিওতে গান শুনতেন। শখের লংপ্লে রেকর্ড ছিলো। তাতেও গান বাজতো। ফ্রিডরিশে নিটশের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, সংগীত ছাড়া জীবন অর্থহীন। আর শচীন কর্তার এলাকার ছেলেদের সুরের প্রতি ভালোবাসা জন্মগত। বন্ধুদের খুশিজলে আড্ডায় অমিতাভ বচ্চনের মতো দেখতে বলে তার খ্যাতি ছিলো। তিনি গুন গুন করে গাইতেন, শোন গো দখিণো হাওয়া; প্রেম করেছি আমি।
কিন্তু বয়স এসে বাগড়া দেয়াতেই পরকালের চিন্তায় বড্ড বেরসিক হয়ে পড়লেন তিনি। বাসায় মেয়েরা জোরে জোরে হিন্দি গান শুনলে উশখুশ করেন। ব্যান্ডের গান শুনলে ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ফোন সবই আছাড় দিতে ইচ্ছা করে আজকাল। বেহেশতে একটা ঘর বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন। যে তিনি আগে বন্ধুদের পূজার দাওয়াতে গিয়ে লুচি বুন্দিয়া আর পাঁচফোড়ন দেয়া সবজি খেতেন, বন্ধুর মায়েদের বানানো নাড়ু বাসায় নিয়ে আসতেন মুড়ি দিয়ে খেতে; সেই তিনি ধীরে ধীরে কেমন যেন একধর্মী হয়ে গেলেন। ওমরাহ করতে গিয়ে মনের অলক্ষ্যে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের বোধও কী দোলা দেয়নি মনে!
তাই এবার এলাকার পূজার আগে ঘোষণা দিলেন, পূজা হতে হবে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে। খুশিজল পান করে নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে একদম চলবে না। পূজা করতে হবে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে। তরুণেরা অবাক হয় তার মেটামরফসিস দেখে। লোকটা কী নিজের তারুণ্যের কথা ভুলে গেলেন!
তরুণেরা পূজায় আনন্দ করার দাবিতে মিছিল করলে; সোনার ছেলেরা গিয়ে হামলা করে। তখন আবার অতীতে পূজার বিরোধিতা করা জামায়াত এই হামলার প্রতিবাদ জানায়। একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে। অবশ্য জামায়াতকে আমরা ভারতের উত্তর প্রদেশে বিজেপির আদিত্য যোগীর নির্বাচনী প্রচারণা করতে দেখেছি। আবার অত্র এলাকায় ক্ষমতার সোনার ছেলেরা ডানে গেলে তারা তো বামে যাবেই।
পুলিশও বলে দেয়, ভাবগম্ভীর পরিবেশে পূজা হতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বড্ড তেতে উঠেছে। প্রতিটি পূজামণ্ডপে টাঙ্গানো থাকবে নামাজের সময় সূচি। এই তল্লাটে থাগস অফ বেঙ্গলেরা খুব মনোযোগ দিয়ে নামাজ পড়ে। তারা মনে করে ইসলাম হচ্ছে খ্রিস্টিয় ক্যাথলিক ধর্মের মতো। মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে হাউ মাউ করে কাঁদলে ঘুষ-দুর্নীতি-দখল-খুন-ধর্ষণের সাত অপরাধ মাফ হয়ে যাবে। আর ৭০০ ইঁদুর মেরে বিড়াল তপস্বী হজ্বে গেলেই সে বড্ড সাধু হয়ে ফিরবে।
এই তল্লাটে ধর্ম কিংবা দল কোন একটা দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই তখন সংখ্যায় যারা কম এমন দল ও ধর্মের লোকের ওপর হুকুম চাঁড়ার বদ অভ্যাস রয়েছে। দেশটা যেন কারো বাপের তালুক।
ফলে এবারের পুজোতে ভাবগাম্ভীর্যের আশুরা শুরু হয়ে যায়। ঢাক-ঢোল বাজানোর সময় এমনভাবে বাজে যাতে কোনভাবেই ক্ষমতা দৈত্যের ঘুমে ব্যাঘাত না হয়। কাউকে পূজার শুভেচ্ছা জানানোর সময়ও আস্তে জানাতে হয়; যাতে ক্ষমতার বাচ্চার ঘুম ভেঙ্গে না যায়।
এমনিতেই হিন্দু বুড়োদের নস্টালজিয়ার ঝামেলা থাকে অন্যবছর, “এই ছেলেরা তোমরা হিন্দি গান বাজাচ্ছো কেন; মান্নাদে কিংবা সৈয়দ হাদী বাজাও।” আমার পূজার ফুল কিংবা কেউ কোন দিন আমারে তো কথা দিলো না টাইপের ছ্যাকা খাওয়া গান দাদুদের খুব পছন্দ। কারণ তাদের ছেড়ে যাওয়া দিদারা অন্য দাদুর বধুয়া হয়ে পুজো দিতে এলে; দেবদাস দাদুরা বিরহের গান শুনে বুকের কষ্ট প্রশমন করে। কষ্টে অনেকের হুপিং কাশি উঠে যায়।
আর এবার যুক্ত হয়েছে মুসলিম বুড়োদের এঁড়ে ছেলের বায়না; “চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ; কথা বলো না; তুমি আমি পূজা করছি কেউ জানেনা” হয়ে উঠলো যেন উতসবের দিনগুলো। এরা আসলে আনন্দের শত্রু। নিজেরা ইনসমনিক ও ভোটসমনিক বলে; সবার জীবন থেকে আনন্দ কেড়ে নিতে চায়।
প্রবাদপ্রতিম বাম রাজনীতিক জ্যোতিবসু বলেছিলেন, কোন দেশের সরকার না চাইলে কক্ষণো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে পারে না।
জানি না, কেন যেন, পূজার প্রতিমা ভেঙ্গে কেউ ধরা পড়লেই পুলিশ বলে, অপরাধী মানসিক ভারসাম্যহীন। হয়তো পূজার ছুটিতে মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় অনেকে। মনে পড়ে চীনারা পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় নির্মাণ এলাকায় প্রায়ই ধরা পড়তো মানসিকভারসাম্যহীন; উদ্দেশ্যমূলক ঘোরাঘুরির সময়। এদের আবার হাত ও পায়ের নখ ঝকঝক করতো।
মুসলমান বুড়োরা পূজার ভাবগাম্ভীর্য পরিদর্শনে এসে হিন্দু বুড়োদের সঙ্গে বসে চুক চুক করে চা খায়। অথচ এরাই বয়সকালে খুশিজল পান করে গাইতো, “হয় যদি বদনাম হোক আরো; আমি তো এখন আর নই কারো।” এদের দেখলে এখন থ্রি ইডিয়টস মুভির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রিন্সিপাল “ভাইরাস”-এর কথা মনে পড়ে। তরুণদের জীবন বোরিং করে ছাড়াই যাদের কাজ। একে গ্রিক সাহিত্যে অডিপাল কমপ্লেক্স বলে। গোষ্ঠীপিতা সমস্ত আনন্দ কেবল নিজের উপভোগ্য মনে করে। আর তাতে সন্তানের প্রজন্মের কোন অধিকার অস্বীকার করে।
পুলিশ রাস্তায় তরুণদের শ্বাস পরীক্ষা করে তারা খুশিজল পান করেছে কীনা! অবশ্য ফেনসিডিল বা ইয়াবাতে সমস্যা নাই; ওগুলো মেশিনে ধরা পড়েনা; দেশেরও সর্বনাশ হয়; তরুণদের অপিয়াম ঘুমে চুর রেখে শাসন ও ত্রাসন যজ্ঞ চালানো যায়। ব্যবসাও হয় ক্ষমতা মাফিয়া ও গড ফাদারের।
ভাবগাম্ভীর্যের ঘোষণাটা শোনার পর; সেইসব অনিচ্ছুক নারী যাদের প্রেম ও বিবাহের স্বাধীনতা দেয়া ভুল হয়েছে যেন; তারা সুযোগ বুঝে স্বামী ও প্রেমিকের কাছে আসার অনিচ্ছা দেখায়। সোজাসাপটা বলে দেয়, পুজোর ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখো; উহ বড্ড মাথা ধরেছে; এখন একটু ঘুমাতে দাও।
“Imagine all the people living life in peace.” – John Lennon
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।