মাসকাওয়াথ আহসান
আজ ভাতের হোটেলের পরিবেশে তুমুল আন্তর্জাতিকতা। ভারতীয় সংগীতকার এ আর রহমান আর শ্রীলংকার ক্রিকেটার এঞ্জেলো ম্যাথিউসকে ধরে আনা হয়েছে।
হোটেল মালিক একটি কালো চশমা পরে দুই হাত দুই পকেটে দিয়ে খাবার টেবিলের চারপাশে ক্যাটওয়াক করছে। হোটেলের ম্যানেজার, বেয়ারা, বাবুর্চি সবার চোখে কালো কালো চশমা।
কিছুক্ষণ পর পর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা লোককে এনে পাশের একটি ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। এ আর রহমান কিছুটা ঘাবড়ে গেলে, হোটেল মালিক তাকে আশ্বস্ত করে, আমরা কোমল হৃদয়ের লোক, আমরা জানি, পেটে খেলে, পিঠে সয়।
বলিউডের প্রোপাগান্ডা মুভি পিপ্পা’তে এ আর রহমান কবি কাজি নজরুল ইসলামের “কারার ঐ লৌহ কপাট” গানটি নিয়ে কোমল এক্সপেরিমেন্ট করেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই দ্রোহের গান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া” চলচ্চিত্রে এই গানটি খান আতার সংগীত আয়োজনে; পাকিস্তান উপনিবেশের কারাগার ভেঙ্গে ফেলার উদ্দীপনা-সংগীত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিলো। এ আর রহমান গানটির প্রচলিত সুর থেকে দ্রোহ শুষে নিয়ে পেলব ও কোমল সুরারোপ করেছেন। গানটির কথা “কারার ঐ লৌহ কপাট” ভেঙ্গে ফেলতে বলছে; অথচ এ আর রহমানের সুরের কোমলতা যেন বলছে , “এই উন্নত কারাগার, বারবার দরকার।”
গানটি ইউটিউবে রিলিজ করার পর অযুত ভিউ পেয়ে প্রথমে এ আর রহমান উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। কিন্তু পরে কমেন্টগুলো গুগল ট্রানসলেটরে ফেলে দেখে, গালি দিয়ে ভুত ছুটিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। এর পরেই তাকে এই ভাতের হোটেলে ধরে আনা হয়েছে।
ভাতের হোটেলের মালিক একজন সংগীত বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে বলে, কবে থেকে গান শেখা হয়!
–শিশুকাল থেকে
–দেখে তো তা মনে হয় না, মিরপুরে শতবর্ষের কনসার্টে বিসিবির টেকাটুকা নিয়া যা গাইছিলেন, আমার তো সেবারই আপনাকে ভাতের হোটেলে নিয়ে আসার ইচ্ছা হইছিলো।
এমন সময় হিরো আলম এসে পড়ে সংগীত শিল্পীর বেশে, সঙ্গে কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী। হোটেল মালিক তাকে অনুরোধ করে এ আর রহমানের “মোস্তফা মোস্তফা” গানটি গাইবার জন্য।
হিরো আলম “মোস্তফা মোস্তফা” গান শুরু করলে এ আর রহমান নিজের কান চেপে ধরে। তার মাথা বন বন করে ঘুরতে থাকে। মনে হয় কেউ যেন, মাথার মধ্যে তেলাপোকা ছেড়ে দিয়েছে; তা ঘুরে বেড়াচ্ছে গেরিলা যোদ্ধার মতো।
হোটেল মালিক হেসে বলে, এখন বুঝলেন তো, একটা ভালো গানের বারোটা বাজাইলে কেমন লাগে; আপনার সুরে “কারার ঐ লৌহ কপাট” গান শুনে আমাদের ঠিক ঐ রকম লেগেছে।
ফাস্ট এইড বক্স এনে কালো চশমা পরা হোটেল ম্যানেজার বেসুরে আহত এ আর রহমানের দুই কানে ব্যান্ডেজ করে দেয়।
এ আর রহমান শুধু একবার বলে, শতবর্ষের কনসার্টে এসে দেখলাম সুখ চুইয়ে পড়ছে আপনাদের দেশে; সবাই ঝুমুর তালে উন্নয়ন নৃত্য করছে। তাই ভাবলাম “কারার ঐ লৌহ কপাট” দ্রোহের সুরে আর দরকার নাই। এইজন্য সহমতের সুরে গানটা কম্পোজ করেছি। এখন দেখছি আমার বোঝার ভুল ছিলো। বেশিরভাগ লোকই কারাগার ভাঙ্গতে চায়। কে জানতো এ দেশটা পুরোটাই একটা বড় কারাগার!
এরপর শ্রীলংকার খেলোয়াড় এঞ্জেলো ম্যাথিউসকে এনে বসানো হয় এ আর রহমানের সামনে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তার হেলমেটের স্ট্র্যাপ বিপর্যয়ের কারণে; সাকিবের আপিলে টাইম আউট হয়ে ব্যাটিং না করেই আউট হয়ে যায় সে। এতে ম্যাথিউস রেগে গিয়ে খেলা শেষে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেনি। উপরন্তু সে সাকিবের আচরণকে অখেলোয়াড়সুলভ বলে মন্তব্য করে।
এরপর থেকে তার ফেসবুক পেজে মিছিল করে গিয়ে গালাগাল করে আসে সাকিব ও আইনের ভক্তরা। ম্যাথিউসকে আইনের গুরুত্ব সম্পর্কে নিয়মিত জ্ঞান দিতে শুরু করে সাকিব সমর্থকরা। ম্যাথিউস বিস্মিত হয়, বাংলাদেশে আইনের প্রতি যে এতো ভক্তি তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
হোটেল মালিক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে ম্যাথিউসকে জিজ্ঞেস করে, ক্রিকেট কবে থেকে শিখছেন?
–শিশুকাল থেকে।
–টাইমলি মাঠে আসতে পারেন না, আসলেও ছেড়া দড়ির হেলমেট নিয়া আসেন; কী শিখছেন শিশুকাল থিকা!
–মাঠে আমি টাইমলিই এসেছিলাম। কিন্তু হেলমেটের স্ট্র্যাপ ছেঁড়া ছিলো; খেলোয়াড় জীবনে এটা প্রথম ঘটেছে। তাই বলে তার সুযোগ নিতে হবে!
–ক্যান আপনি ম্যানকাডিং করেন নাই। ম্যানকাডিং কী বোঝেন তো!
–ম্যানকাডিং তো প্রচলিত। বল করার পর রান নেবার নিয়ম, বল করার আগেই অর্ধেক রান করে রাখা আটকাতে এই আইন।
–থাক থাক আইন শিখাইয়েন না! টাইম আউটও আরেকটা আইন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। আমরা সবসময় আইনকে গুরু মানি।
–তাই বলে ডিসেন্সি বলে কিছু থাকবে না।
–রাখেন মিয়া ডিসেন্সি, প্রেম-যুদ্ধ-নির্বাচনে ডিসেন্সির কোন জায়গা নাই। শোনেন নাই, সাকিব বলছে, সে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছিলো। আমাদের এখানে প্রেম-যুদ্ধ-নির্বাচন এমনকী শান্তি-সম্মেলন সব কিছুতে হেলমেট লাগে। বাচ্চা ছেলেরাও হেলমেট পরতে পারে। এই তোমরা আসোতো।
একদল তরুণ হেলমেট পরে এসে দাঁড়ায়; হাতে হাতুড়ি ও লাঠি।
–এই একটু দেখাওতো শান্তি সম্মেলনে যাবার আগে কীভাবে হেলমেট পরো।
তরুণেরা একযোগে হেলমেট খুলে টেবিলে রেখে তারপর আবার হেলমেট পরে মাত্র দশ সেকেন্ডে।
হোটেল মালিক গর্ব করে বলে, দেখছেন, দেখছেন তারা হেলমেট পরতে কীরকম ওস্তাদ। কিছু শেখেন এই বাচ্চা পোলাপানগো থিকা।
এ আর রহমান ও এঞ্জেলো ম্যাথিউস ফ্যালফ্যাল করে তাকায় পরস্পরের দিকে।
ম্যাথিউস হাত জোড় করে বলে, আমার ভুল হয়ে গেছে; আসলে শ্রীলংকায় আপনাদের মতো এতো সুন্দর আইনের শাসনও নাই; আর আমরা এতো অল্প বয়স থেকে হেলমেট পরা প্র্যাকটিসও করিনা।
হোটেল মালিক গর্ব করে বলে, সময় অমূল্য, সময় নষ্ট করতে নেই। সময়ের মর্যাদার ওপর আপনাদের একটা জাদু দেখাতে চাই। যাতে “ভ্যালু অফ টাইম” ব্যাপারটা ম্যাথিউস সাহেবের মাথায় গেথে যায়। কই আজাদ কোথায়!
আজাদ কতগুলো ব্যালট পেপার আর সিল নিয়ে এসে দ্রুততম গতিতে ব্যালটে সিল মারতে থাকে।
হেলমেট পরা ছেলেরা এ আর রহমানের সুরে সহমতের গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করে ব্যালটে সিল মারা আজাদকে।
“এইটা কীরে ভাই, কারার ঐ লোহকপাট
ভোট সব কররে লোপাট!
রক্তজমাট
নৌকা পূজার পাষাণ বেদি
ওরে ও হেলমেট ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
বিজয় নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি!”
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।