মাসকাওয়াথ আহসানঃ
শৈশব থেকে সংস্কৃতিচর্চা জীবন চর্যার সঙ্গে মিশে থাকায় আমার এই ফেসবুকের প্রাত্যহিক কালচারাল ওয়ার বুঝতে বেশ অসুবিধা হয়। বৈশাখের প্রথম দিনটাতে আব্বা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ঈশ্বরদী বাজারে। পরিচিত দু’চারটা দোকান সেদিন সাজানো হতো রঙ্গিন কাগজকে ত্রিকোণ করে কেটে। তারা পরিবেশন করতো মিষ্টি। এদিন লক্ষ্য করেছি জীবনের নানা হাঁটাপথের মানুষ আসতেন সেখানে। সামান্য প্রতীকী টাকা পরিশোধ করে লাল খাতায় বাকি হালনাগাদ করে সবাই আপ্যায়িত হতেন। এ দিনটি আসলে ছিলো বিক্রেতার তার সারাবছরের ক্রেতাকে আপ্যায়ন করার দিন।
এই পর্ব শেষ করেই যেতাম প্রেসক্লাবের সামনে জমা হওয়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গ্রুপের সমন্বিত বৈশাখি শোভাযাত্রায় যোগ দিতে। কিছুক্ষণ এই শোভাযাত্রায় হাঁটা হলেই আব্বা সঙ্গে করে ফেরার পথে কালীমন্দিরের সামনে বসা বৈশাখি মেলা থেকে ভেঁপু, চরকি, মাটির হাতি-ঘোড়া, চিনির তৈরি বিভিন্ন পাখি ও প্রাণী ছাঁচের মিষ্টি কিনে দিতেন।
বাসার কাছাকাছি এলে আব্বার সহকর্মী ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক নর নারায়ণ রায় তার বাসায় নিয়ে গিয়ে মিষ্টান্ন পরিবেশন করতেন। এরপর উনাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলে থাকতো বৈশাখি আহারাদির ব্যবস্থা। নর-কাকা আব্বা-আম্মাকে বিকালের সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদের বৈশাখি কবিতা পাঠের আসরে ডাকতেন। আম্মা সেখানে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করতেন। আব্বা ছিলেন প্রবন্ধের মানুষ। তিনি ছোট করে বক্তৃতা দিতেন।
সন্ধ্যাটা থাকতো আমার জন্য আরো ব্যস্ততার। আব্বা তার ছাত্রদের সংস্কৃতি গ্রুপগুলোর উপদেশক। কখনো কখনো উনি গীতিনৃত্যনাট্য ও থিয়েটারের নির্দেশনা দিয়ে দিতেন। আমি দেখা যেতো বিভিন্ন মিলনায়তনে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও অভিনয় করে বেড়াতাম। এরপর বাসায় ফিরে বিটিভি ও দূরদর্শনের একটি দুটি অনুষ্ঠান দেখে ঘুমিয়ে যেতাম।
আজকের ফেসবুকে যে কালচারাল ওয়ার দেখি; ওরকম সাংস্কৃতিক বিতর্ক আমাদের বাসায় নিয়মিত হতো। আম্মা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী আর আব্বা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র। ফলে সাংস্কৃতিক বিতর্ক হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক আগেই আমার দাদা ও নানা পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের দু’জন তরুণ কলকাতায় একসঙ্গে মুভি দেখে ও আড্ডা দিয়ে এক গভীর বন্ধুত্বে উপনীত হয়েছিলেন। দাদা বেঙ্গল রেনেসাঁ প্রভাবিত ছিলেন আর নানা পূর্ব বঙ্গের যে সুফি দর্শনের ঐতিহ্য তাকে আত্মস্থ করেছিলেন। নানা সেই বৃটিশ আমলে থিয়েটার করতেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা পূর্ব বঙ্গ কোন একটি জায়গার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি আমাদের বাসায় টিকতো না।
আমার বেড়ে ওঠার পরিবেশে ধর্ম কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি ছিলো না। পুরো রোজার মাসে আব্বা খুব মন দিয়ে রোজা করতেন। আম্মা আব্বার শৈশবের সঙ্গে মিশে থাকা খাদ্য সংস্কৃতি অনুযায়ী বেশ কিছু খাবার দাবার তৈরি করে পরিবেশন করতেন। ঈদের আহারাদিতে একই ব্যাপার ঘটতো। আম্মা কখনো নামাজ মিস করেছেন বলে আমার মনে হয়না।
আম্মা আব্বাকে সঙ্গ দিতে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতেন। কারণ নানা কলকাতার সিনে ম্যাগাজিন উলটোরথ রাখতেন। ফলে শৈশব থেকেই আম্মার বিস্তর জানা ছিলো সে শোবিজ সম্পর্কে। আব্বাও আম্মাকে সঙ্গ দিতেন রীতিমতো সিনেমায় গিয়ে ঢাকার ছবি দেখতে। আবার হলিউডের পুরোনো ছবি এনে বাসায় দেখার চল ছিলো।
বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় একটা গুরুত্ব আমার দাদা ও নানা উভয়ের পরিবারেই ছিলো। এ কারণেই রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো তাদের পথে বসাতে পারেনি। আব্বা-আম্মা দুজনেই ছিলেন সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার পুরোপুরি বিরোধী। স্বীকার না করলেও এটা বোঝা যায় ষাট ও সত্তরের বিকাশমান সাম্যবাদি ভাবনা তাদের জীবন চর্যাকে হয়তো প্রভাবিত হয়ত করেছিলো। আমি এ কারণে ভি আই পি কালচারকে কখনো বুঝতে পারিনি। এটা স্পষ্ট করেই জানতাম দক্ষিণ এশিয়ায় কেউই বৃটিশ রাজা-রাণীর আত্মীয় নয়। আব্বাকে দেখতাম, সমাজের সব মানুষের সঙ্গে একইরকম ব্যবহার করতে। ঢাকায় পড়তে যাবার সময় আব্বা বলেছিলেন, কারো জাঁকজমক দেখে ঘাবড়ে যেওনা। কার্টিয়াস লোক পেলে বুঝবে অনেক আগে তার মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড পূরণ হয়ে; এখন জ্ঞান সাধনা করছে। আর আনকার্টিয়াস লোক দেখলে বুঝবে নতুন পয়সা। আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে রুক্ষ্ম আচরণ করছে। সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া বোকামি।
এ কারণে ফেসবুকে কেউ যখন অভিজাত সংস্কৃতি বোঝাতে আসে; আমার ভীষণ কৌতুককর লাগে। যার দাদা জ্বর হলে রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠ করতেন; যার নানা সিয়েস্তার সময় শাস্ত্রী সংগীতের লং প্লে রেকর্ড চাপিয়ে দিতেন; তারপক্ষে ফেসবুকে নতুন রবীন্দ্রনাথ ও নতুন বেগম আখতারের হামবড়া দেখা খুবই কঠিন। যার নানার পরিবারের সদস্যরা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে লড়াই করেছে; মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে সরদহ থানা পাড়া ম্যাসাকারে; যার দাদার বাড়ি ও সংলগ্ন কুঠি বাড়ি যুদ্ধকালে হয়ে উঠেছিলো শরণার্থী শিবির; যে এক বছর বয়সে মায়ের কোলে শরণার্থী হয়েছে; সে কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গপ্পো শুনবে মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে ভাগ্য বদলানো লোকজনের।
আমি ঐকান্তিক শ্রেণীহীনতায় বিশ্বাসী। বৈষম্যহীন সমাজ আমার সমুদয় লেখালেখির গোড়ার কথা। বৃটিশ কলোনির আঘাতে হারিয়ে যাওয়া সম্পন্ন পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের কৃষক ও কারিগরের জীবন ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে না। জুলাই বিপ্লবে হঠাত আলোর ঝলকানির মতো তরুণ-তরুণীর নেতৃত্বে যে সাহসী জনমানুষ পথে নেমে এসেছিলো; একজন গুলি খেলে বাকি নয়জন দাঁড়িয়ে থাকার যে অসম সাহস; তা আসলে সামষ্টিক আভিজাত্যের অহম। বাংলাদেশের মানুষ আনন্দভূক; সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সার্বভৌম জীবন যাপন করতে চায়। মানবিক মর্যাদা ও আত্মসম্মান বোধ এই জনপদের মানুষের অন্তঃশক্তি। এদেশের প্রান্তিক মানুষের কর্মমুখর একটি সাংস্কৃতিক জীবন রয়েছে। রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। খোদা তাদের সঙ্গে আছেন বলেই বৃটিশ-পাকিস্তান কিংবা ভারতীয় ঔপনিবেশিক খাঁচায় তাদের বন্দী রাখা যায়নি। এমনকি আর্থিকভাবে দরিদ্র গৃহেও অতিথি এলে আতিথেয়তার যে আপ্রাণ প্রয়াস; ঐখানে হাজার বছরের সম্পন্ন ডিএনএ প্রবাহের ইন্সটিংকটিভ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। গত ঈদে কিংবা এই বৈশাখে ফ্যাসিজমমুক্ত পরিবেশে নাগরিক শোভাযাত্রায় যে মানুষের ঢল নেমেছে; তা বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্গত সাংস্কৃতিক আকাংক্ষার প্রতিফলন।
সুতরাং যারা নতুন নতুন সংস্কৃতি শিখেছেন; সংস্কৃতিকে ধর্মে রুপান্তর করে সারাদিন কালচারাল ওয়ারে প্রাণপাত করছেন; যারা নতুন এফলুয়েন্ট হয়েছেন, আমাদের শেখাতে এসেছেন আধুনিকতা, তারা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবুন তো, আপনার জটিল ও কর্কশ শৈশবের শুল্ক কেন আনন্দভূক সহজ মানুষদের দিতে হবে। যাদের শৈশবে কোন কিছুর বাড়াবাড়ি ও জোরাজুরি ছিলো না; তারা কি করে বুঝবে আপনার কট্টর ধর্মীয় চিন্তার পরিবারের শেকল ছিঁড়ে কট্টর লিবেরেল হবার চিন্তা!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।