মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ললিতাদি ফেসবুকে আর্তনাদ করে, এমন দম বন্ধ করা নববর্ষ আগে আসেনি কো। এটা কোন বর্ষবরণই নয়।
আলপনা এসে কমেন্ট করে, দাওয়াত পান নাই বইলা কি আঙ্গুর ফল টক লাগতেছে!
শিবব্রত দাদা এসে হিতোপদেশ দেয়, কক্ষণো দাওয়াত বলবে না আলপনা। নেমন্তন্ন বলবে। দাওয়াত ফাওয়াত এসব অমঙ্গলজনক শব্দ বখতিয়ারের ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলো।
আনারকলি এসে ফেসবুকে বলে, লজ্জা লাগছে না তোমাদের; মেট্রোরেলে চড়ে বৈশাখের আয়োজনে যাচ্ছো।
এটা বলেই ক্ষোভে দুঃখে অপমানে অজ্ঞান হয়ে যায় আনারকলি।
সহমত ভাই তাকে বলে, ওঠো আনারকলি ওঠো প্রোপিক কালো করতে হবে।
জগলু টিপ্পনী কাটে, এবার আর শুভ নববর্ষ বলার দরকার কি! কও খোশ আমদেদ; শুভ নওরোজ।
এক যে সহমত সেই শরিয়ত ভাই চারুকলায় হাসিনাৎসির দানব মোটিফে আগুন দেয়ায় সে ভেবেছিলো; দুই কূল রক্ষা হলো, বুবুর ভাবমূর্তি বাঁচলো আবার পৌত্তলিকতার হাত থেকে রক্ষা পেলো মুসলিম জাহান।
অথচ আবার রাতারাতি হাসিনাৎসির ভয়ংকর মোটিফ তৈরি হলে; মহিলা লীগের শেফালি ছুটে গিয়ে বুবুর ভাবমূর্তি বাঁচাতে বলে, এটা দেখছি হুবহু আমার শাশুড়ির মুখ।
বিবিসি বাংলার মনটা খারাপ। সে কুঁচ কুঁচ করে বলে, মঙ্গলশোভাযাত্রা যেমন রাজনীতিমুক্ত বিশুদ্ধ আয়োজন ছিলো; তা আর রইলো কই! আনন্দশোভাযাত্রায় রাজনীতি ঢুকে পড়লো।
রুচির মোহন ছোঁয়া নিয়ে সংস্কৃতি মামা ও খালা চুকচুক করে উঠলো, বইমেলাটা নষ্ট হয়েছিলো আস্তাকুড়ে বুবুর ছবি দিয়ে; বৈশাখটা মলিন হলো বুবুর মোটিফ বানিয়ে। এতো প্রতিশোধ প্রবণ হিংস্র সমাজ নিয়ে আমরা কি করবো।
একই সংস্কৃতি মামা ও খালা জুলাই মাসে রোদ ঝড় বৃষ্টিতে বুবুর সঙ্গে থেকে বৈষম্যবিরোধী দুবৃত্ত নির্মূল করতে উস্কানি দিয়েছিলো কাব্যের তালে তালে, নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষ নিঃশ্বাস ইত্যাদি ভাটের আলাপ করে।
শহরময় নানা রঙের মানুষের জীবন মিছিল দেখে জগন্নাথ বলে, এইবার লোক কম হইলো। এর আগে অনেক লোক হইতো।
একটা তরুণ ছেলে মনে করিয়ে দেয়, আগে পুলিশ বেশি ছিলো শোভাযাত্রায়; আপনি মনে হয় সেই হিসাব করতেছেন।
জুলাই-অগাস্টের অমঙ্গলের দোসরেরা ৭২ ঘন্টা ধরে মঙ্গল শব্দের আভিধানিক অর্থ নিয়ে আলাপ করে; মঙ্গল লীগের কর্মীদের এক নেমন্তন্নতে প্রণয়ে ঢলে পড়ে। ইনডোরের অল্প স্পেসে এতোগুলো প্রণয়াবনত সংস্কৃতি মামা খালা দেখে চোখে অশ্রুসিক্ত হয় শিবব্রত দাদা। সহমত ভাই তাকে টিস্যু এগিয়ে দেয়।
যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মুখ দেখানোর জো নেই; তাই ফিউশানের একটি পার্কে মঙ্গল উতসবে পৃথক মণ্ডপ করে দুধের সাধ ঘোলে মেটায় ” আমরা একটু এলিট হয়ে উঠেছি; তাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাই না” লীগের আসরে।
সংস্কৃতি মামা ও খালারা পরিচিতদের ফেসবুক ইনবক্সে নববর্ষে মঙ্গল চেয়ে মঙ্গল এক্টিভিজিমের পাশাপাশি ছায়ানটের গান শেয়ার করে বুঝিয়ে দেয়, আমরা একটু উচ্চাঙ্গের লোক; আমাদের ব্যাপারটাই আলাদা।
বুবু পালিয়ে গেলে গেরুয়া উপনিবেশের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না; এতোদূর ভাবতে পারে নি যে সুষুপ্ত ভক্তেরা, তারা চড়াও হয় ফারুকির ওপর। তাকে হুমকি ধামকি দিয়ে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টা চলতে থাকে।
এটাই এ শহরের নিয়ম। বেঙ্গল রেনেসাঁর এঁকে দেয়া শত বছরের বাঙালি সংস্কৃতির লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করলেই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি আল মাহমুদের প্রগতিশীলতার পৈতে কেড়ে নেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা ডা জাফরুল্লাহকে শহীদ মিনারে আক্রমণ করা হয়। শক্তপোক্ত লিবেরেল শফিক রেহমান, ফরহাদ মজহারদের নিয়ে মওলানা সগিরুদ্দিনের ইদানীং লিবেরেল সাজা ছেলে-মেয়েরা রগড় করে। পুরোহিত শংকরানন্দের ইদানিং সেকুলার সাজা ছেলে-মেয়েরা গালি দেয়।
আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক লেটুর দল বংকিমচন্দ্র সেজে প্রগতিশীলতার সনদ বিতরণের কাজটা অবিরাম করতে থাকে। ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক; ফ্যাসিজমের চাদর পেতে অপেক্ষা করে।
পনেরো বছরের হাসিনাৎসি শাসনের পিঠপুলি খেয়ে যারা চারিদিকে উন্নয়নের ধুতরা ফুল দেখতো; তারা আট মাসেই ইউনুস সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণে গান্ধা কইরা দেওয়া অর্কেস্ট্রায় সারিন্দা হয়। এর আগে বিএনপিকেও তারা একবছরেই খারিজ করে দিতে কমলা সুন্দরী হয়ে নাচতো।
দেশের সাধারণ মানুষ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে; উৎসবে মিলিত হয়; আবার ফিরে যায় কাজে। কিন্তু বুবুর লেটুর দল ফেসবুকে, ইউটিউবে, টকশোতে, কলামে, ভারতের গদি মিডিয়ায় ঝুনঝুনি বাজিয়ে যায়। বংকিমের ঝুনঝুনিটা জগন্নাথ ও জগলুল আপ্রাণ বাজাতে থাকে; এক মূহূর্ত তার বিরাম নেই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।