মাসকাওয়াথ আহসানঃ
বাংলাদেশের পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারত সরকারের আতিথেয়তায় ভিডিও ভাষণ দেবেন; এই ঘোষণাটি বিবিসি বাংলা এমন গুরুত্বের সঙ্গে পোস্টার বানিয়ে প্রচার করেছে; যা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা আচরণবিধির পরিপন্থী।
পেশাদার সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দীন ডয়চেভেলে বাংলা ছেড়ে যাবার পরে সেটি আনন্দবাজারের সাইট বলে ভুল হয়। বাংলাদেশকে মৌলবাদি রাষ্ট্র প্রমাণে রিপাবলিক বাংলার মতোই সক্রিয়তা ডয়চেভেলে বাংলার। খোদ জার্মানিতে প্রচলিত সাংবাদিকতা আচরণবিধির লংঘন করেছে এই ওয়েব পোর্টাল।
ভয়েস অফ এমেরিকা বাংলা যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ৫ অগাস্টের পরে আওয়ামী কন্ঠ হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে।
যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ আন্তর্জাতিক এই সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে; এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এরাই ছিলো খবর পাবার ঠিকানা; তাই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ার সাংবাদিকদের রিক্রুটমেন্ট শুরু হয় সেখানে। যারাই এর ব্যতিক্রম; নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকতা করতে চান; তাদের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক হয়নি; সেখানে কাজ করা। এরকম নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকদের বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমল থেকে নিষ্ক্রিয় দেখেছি। কেউ কেউ সাহস করে ফ্যাসিস্টের রাতের ভোট; দিনের দুর্নীতি নিয়ে সাহসী রিপোর্টও করেছে। সেগুলো বিবিসি বাংলার কাছে ভারসাম্যের খেলা; যাতে জনগণের সামনে আওয়ামী প্রীতি স্পষ্ট না হয়; “আওয়ামী লীগ না থাকলেই বাংলাদেশ মৌলবাদী” এই ভারতীয় দর্শন ধরা না পড়ে বিবিসি বাংলার হৃদস্পন্দনে। মাঝে পাঠকের সামনে আপার সৈনিক হিসেবে ধরা পড়ে কিছুদিন নৈর্ব্যক্তিক থেকে এবার রীতিমতো পোস্টার বানিয়ে নেমেছে যে, আপা আজ রাতে দিল্লি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
ডয়চেভেলে ইংলিশ জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ফ্যাসিজমের স্বরুপ উন্মোচন করলেও; ডয়চেভেলে বাংলা খালেদকে ফেয়ারওয়েল দিয়েই শুরু করে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা, বাংলাদেশ জঙ্গীদের দখলে চলে গেলো গানখানা গাইতে। এসময় আনন্দবাজারের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে গেরুয়া খেমটা নাচ দিতে শুরু করে ডয়েচেভেলে বাংলা। ইংলিশ সার্ভিস বাংলাদেশ সিচুয়েশান নিয়ে প্রতিবেদন রচনার জন্য বাংলা বিভাগের কাছে সাহায্য চাইলে; বাংলাদেশ কি তালিবান রাষ্ট্র টাইপের সেই হিন্দুত্ববাদী বয়ান বানিয়ে দিয়ে এসেছে বলে চোখে পড়লো।
ভয়েস অফ এমেরিকা বাংলা ইউনুসের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের নিহত-আহতদের ব্যাপারে কোন কনসার্ন না দেখিয়ে আওয়ামী কনসার্ন নিয়ে প্রশ্ন করে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কয়েনেজ রিসেট বাটন নিয়ে আজো আওয়ামী লীগের সাইবার বটেরা চেবানো চুইংগাম চিবিয়ে চলেছে।
ভারতের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যাগুরুদের একটি অংশ সংখ্যালঘুদের ওপর মাস্তানি দেখায়; ফলে শৈশব থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে তিক্ততা নিয়ে বড় হয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েরা। তারা বিবিসি বাংলা, ডয়চেভেলে, ভয়েস অফ এমেরিকায় কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের সাংবাদিকদের চেয়েও বেশি ইসলামোফোবিক হয়ে পড়ে। ফলে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ার বাংলাদেশ নীতি উঠে আসে তাদের সাংবাদিকতায়।
আর বাংলাদেশে বৃটিশ আমল থেকে হিন্দুত্ববাদী বংকিম চন্দ্রের চোখে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দেখাকেই প্রগতিশীলতা হিসেবে মনে করা হয়। কলকাতার সংগীত-নৃত্য-সাহিত্যকেই বেঙ্গল রেনেসাঁর আলো হিসেবে বরণ করা হয়। ইতিহাসের ন্যারেটিভ থেকে মুছে যায়, সুলতানি ও রোসাং রাজসভার বাংলা সাহিত্য ও শিল্প। মুঘল ও নবাবী আমলকে চিত্রিত করা হয় তরবারির শাসন হিসেবে। শাস্ত্রীয় সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলার মুসলিম ঐতিহ্যকে লুকিয়ে ফেলা হয়; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নতুন জমিদারের নতুন সংগীত ও নৃত্য অনুরাগের গল্প দিয়ে। ফলে বাংলাদেশে আধুনিক মুসলিম তরুণ-তরুণীরা; বৃটিশ আমলে তৈরি হওয়া এই হিন্দু জমিদারি কালচারকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে বুঝতে শেখে। বৃটিশ বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রধান উপাদান ইসলামোফোবিয়া। কারণ নবাব ও মুঘলদের মন্দ শাসক বলে প্রমাণ না করতে পারলে বৃটিশকে ভালো শাসক বলে প্রমাণ করা যাবে না।
এই মনোভঙ্গিকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে আনে বিভাজন ও শাসন প্রক্রিয়ার মূল উপাদান হিসেবে। আর ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর জন্য এটা পূর্ববঙ্গের হারানো জমিদারি ফিরে পাওয়ার আকুলতা। এরফলে বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদই প্রগতিশীলতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অথচ প্রগতিশীলতা মানেই ধর্ম-গোত্র-জাতীয়তাবাদের বিভাজন এড়িয়ে মানুষ পরিচয় উদযাপন। মানবিক ঐক্যের সমাজ গঠন; যেখানে যে যার ধর্ম-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য চর্চা করবে আনন্দের সঙ্গে। মনে কোন শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত ধারণা না রাখাই প্রগতিশীলতা।
কিন্তু আওয়ামী লীগের কালচারাল সফট পাওয়ার হচ্ছে পূজাকে প্রগতিশীল কর্ম আর নামাজকে মৌলবাদি সংস্কৃতি মনে করা। ফলে বিবিসি বাংলা, ডয়চেভেলে বাংলা, ভয়েস অফ এমেরিকা বাংলার চোখে রাস্তায় নক্সী পাঞ্জাবি পরা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের লোকের পাশাপাশি কিছু দাড়ি টুপিওয়ালা লোক দেখা গেলেই; বাংলাদেশ তালেবানি রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া। এই যে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স; দাড়ি-টুপি নিয়ে হেসে বংকিম বাবুর বৈঠকখানায় সেকুলারের মর্যাদা লাভ; এর মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের বিংশ শতকের কথিত সেকুলার গোষ্ঠী আউটডেটেড হয়ে পড়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানে রংপুরে প্রাণ দিয়েছে সাঈদ, সিলেটে প্রাণ দিয়েছে রুদ্র; হিজাবি তরুণীর হাতে লাঠি তুলে দিয়েছে টপস ও জিনস পরা তরুণী; এইভাবে প্রগতিশীলতার উদ্ভাস আর ঐক্যের ঠিকানা তৈরি হয়েছে।
জেন জি প্রমাণ করবে আওয়ামী লীগের আঁকা বিভাজন রেখা মুছে দিয়ে কিভাবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-মুসলমান-আদিবাসী মিলে বাংলাদেশ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে নতুন সভ্যতা বিনির্মাণ করা যায়। খুব বেশি দূরে সেসময় নয়; যখন কট্টরচিন্তার মানুষেরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। যে কোন সাম্প্রদায়িক উস্কানি আর উপনিবেশের ছায়া বিদেশি মিডিয়ায় উঁকি দিলে; সাধারণ মানুষ বলবে, বুঝছি ভাই; আপনি আসলে কি করতে চান!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।