মাসকাওয়াথ আহসানঃ
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় থেকে বাঙ্গালিত্বকে কলকাতার কথিত আর্য কল্পনার হিন্দুরা নাকচ করেছিলো; আর মুসলমানিত্বকে নাকচ করেছিলো এলাহাবাদের কথিত আর্য কল্পনার মুসলমানেরা। বৃটিশ শাসকদের সঙ্গে ক্লাবিং করার সুযোগে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ ও আলীগড় রেনেসাঁ; সাহেবি কেতাগুলো শিখে ফেলেছিলো। ইংরেজি শিক্ষায় খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলো। কেউ কোথাও এগিয়ে গেলে তা আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সেই এগিয়ে যাওয়া থেকে ফাঁপা অহম তৈরি হলে; আর তা নিয়ে অপরকে ছোট করলে তা আপত্তিজনক।
বাঙালি মুসলমানের শিল্প-সাহিত্য চর্চার ইতিহাস অনেক পুরোনো। কিন্তু কলকাতার হিন্দু বাঙ্গালিরা, বাংলা শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস থেকে সুলতানী আমল ও আরাকান রাজসভার সমস্ত সাহিত্যকর্মকে বাদ দিয়ে; একটি সাম্প্রদায়িক বাংলা শিল্প সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করে। আর বাঙালি মুসলমানের সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিকে অবজ্ঞা করে রাজনীতির ইতিহাস রচনা করে উত্তর প্রদেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি। বাঙালি মুসলিমকে সংখ্যালঘু হিন্দু সাংস্কৃতিক শক্তি ও সংখ্যালঘু মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি এভাবে প্রান্তে ঠেলে দেয়।
১৯৪৭-এ মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হতে পেরেছিলো পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক শক্তির কারণে। পূর্ব বঙ্গই পাকিস্তান তৈরি করেছিলো। পূর্ব বঙ্গের মুসলিম ভোটের ম্যান্ডেটের ভিত্তিতেই উত্তর প্রদেশের মুসলিম নেতারা পৃথক রাষ্ট্রের দেন দরবার করতে পেরেছিলেন। শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাব অবশ্য ছিলো মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ এলাকায় পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে। কিন্তু ভারত বিভাগ না হলেও বাংলাকে বিভাজিত করতে হবে; কলকাতার আর্য কল্পনার নেতা শ্যামাপ্রসাদের ছিলো এমন ধনুক ভাঙ্গা পণ। বাংলা পৃথক রাষ্ট্র হলে জিন্নাহ’র কোন আপত্তি ছিলো না। জিন্নাহ’র নেতিবাচকতা ছিলো শেরে বাংলা ও সুহরোয়ার্দিকে সাইড লাইনে বসিয়ে নিজে কায়েদে আজম হয়ে ওঠার আত্মম্ভরিতায়। কিন্তু কলকাতার সাম্প্রদায়িক ন্যারেটিভ শ্যামাপ্রসাদকে ঢেকে রাখতে জিন্নাহ’কে বাংলা বিভাগের জন্য দায়ী করে তা পারিবারিক শিক্ষায় প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
মুসলিম ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে পূর্ব বঙ্গের পরিবর্তে উত্তর প্রদেশে স্থাপন করা জিন্নাহ ১৯৪৭-এর পরপরই মারা গেলে; পাঞ্জাবের মুসলমানেরা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। শুরু হয় বাঙালি মুসলমানের উপার্জিত অর্থে খেয়ে পরে তার ওপরেই নিগ্রহ। শৌর্য ও জিদে পাঞ্জাবের মুসলমান ও বাঙালি মুসলমান কেউ কারো চেয়ে কম নয়। ফলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে নেয় বাঙালি মুসলমান। কিন্তু ভারত ১৯৪৭ সালে পূর্ব বঙ্গ হাতছাড়া হবার কথা একদিনও ভুলেনি। তাই ১৯৭১ কে সে দেখে বাংলাদেশে ১৭৯৩-এর জমিদারি ফিরে পাবার সুযোগ হিসেবে। ১৯৪৭-৭১ পাকিস্তান উপনিবেশের যন্ত্রণা পার হতেই এসে পড়ে বাংলাদেশে ভারতের ছায়া উপনিবেশের যন্ত্রণা।
বাঙালি মুসলমানের জীবন কথিত আর্য কল্পনার মুসলমান ও কথিত আর্য কল্পনার হিন্দুদের হেজিমনির ল্যাবিরিন্থ বলে মনে হয়। এখানে হাজার বছরের পুরোনো নিজস্ব সংস্কৃতি থাকার পরেও কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের কালচার আর আলীগড়ের সৈয়দ পরিবারের কালচার কাল্পনিক সুপিরিয়রিটি নিয়ে মনোজগতে রাজত্ব করতে থাকে।
পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতিকে আমি শৈশব থেকে উদযাপন করেছি। কলকাতা ও আলীগড়ের কালচার সম্পর্কে পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মির্জা গালিবকে আকন্ঠ পান করেছি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় অল্পবয়সে। কিন্তু বাংলাদেশে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে কৃষক-কারিগরের যে অন্তর্গত আলোকায়ন দেখেছি; তাতে মনে হয়েছে পশ্চিম, কলকাতা, এলাহাবাদ থেকে ঝাঁপিতে করে প্রথম আলো নিয়ে আসার দরকার নেই। গ্রামের চা-খানাগুলো এরিস্টোটলের পাঠশালার মতো। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের মতো রাজনীতি সচেতন মানুষ দক্ষিণ এশিয়া বা ইউরোপের কোথাও নেই। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন ও ভারত বিরোধী আন্দোলনে প্রতিটি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের দীর্ঘদিনের সম্প্রীতিময় বসবাস। যেহেতু সেখানে আর্য কল্পনার হেজিমনি নেই; ফলে সেখানে কোন প্রতিক্রিয়াশীলতা নাই।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আসলে নানারকম আর্যকল্পনার কুরুক্ষেত্র। যেহেতু এইখানে শেখানো হয়, পূর্ব বঙ্গের নিজস্ব সংস্কৃতি দুর্বল; তাই বলশালী কলকাতা, এলাহাবাদ ও বিলেতি কালচার শেখানোর পালোয়ানদের দেখে শিখতে হবে। ঢাকায় যেরকম কলকাতা কালচারের ভোক্তা, এলাহাবাদ কালচারের ভোক্তা ও বিলেতি কালচারের ভোক্তা আছে; এইরকম কালচার আজকের কলকাতা-এলাহাবাদ ও বিলেতে নেই। পৃথিবীর সব জায়গার মানুষ এভলভ করে সহজ হচ্ছে; আর ঢাকায় চলছে জটিল হবার প্রতিযোগিতা।
ঢাকা মহানগরী থেকে যদি আর্য কল্পনার অবসান ঘটানো যায়; আত্মপরিচয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা যায়; তাহলে সমাজের অন্যান্য সংকট এমনিতেই কমে আসবে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে কলকাতা-এলাহাবাদ-লন্ডনের সাহেবেরা কাস্ট সচেতন ছিলো। গৃহকর্মীদের দাস হিসেবে বিবেচনা করতো। কিন্তু আজ প্রজন্মের পরিবর্তনে সে অবস্থা নেই। কিন্তু ঢাকায় নতুন আর্য কল্পনা গৃহকর্মীকে দাস হিসেবে বিবেচনা করে। ফেসবুকে এ আই দিয়ে নিজের চেহারা আর্য বানানোর গভীর মনোস্তত্ব আছে। এ নেহাত ছেলেখেলা নয়।
ফেসবুকে যে আওয়ামী লীগ ও বামের অহংকার লক্ষ্য করা যায়; এটা কলকাতার বংকিমচন্দ্রের অহংকার, শিবির ও ইসলামপন্থীদের যে অহংকার, তা এলাহাবাদের সৈয়দের অহংকার। এইজন্য এদের পোশাক আশাক অষ্টাদশ শতকের; এদের শিল্পচর্চা ঊনবিংশ শতকের। আমরা আসলে ফেসবুকে জাদুঘরের মানুষদের দেখি, যাদের স্বকীয়তা নেই। আমাদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েগুলোর আচার আচরণ ইংরেজি সাহিত্যের রেস্টোরেশন যুগের ওয়াইচার্লির নাটকের নট নটীদের মতো। একবিংশ শতক থেকে অনেক পেছনে এসব আর্য কল্পনার খেলনা মানুষেরা। একটু রবীন্দ্র সংগীত শুনলেই, একটু গালিবের কবিতা পড়লেই, একটু ইংলিশ ভিংলিশ বলতে পারলেই ঘাড় কাত করা প্রোপিক। আর অন্যকে ছোট করা সুইপিং কমেন্ট। ন্যাশনালিজম, সোশালিজম, ক্যাপিটালিজম, ফেমিনিজম যাই এনে দিন; এরা সব সামন্ত আর্য কল্পনার আদিম মানুষ।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।