এটা আঁচ করা যাচ্ছিলো; গোধূলীর আশে পাশে সন্ধ্যা নামার সব চিহ্নই ছিলো। আমার দাদা কিংবা নানার কল্পনার ‘চন্দন পালংকে শুয়ে’ গ্রামাফোন রেকর্ডে “এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’ সেই স্নিগ্ধ সুরের ছিমছাম সময়টা ছিলো মন্দ্র লয়ের। আম্মা সেসময় নানার সাবস্ক্রিপশন করা সিনে পত্রিকা পড়ে চলচ্চিত্র আর সংগীত গেজেট হয়ে উঠছিলেন। আব্বা তখন কলকাতায় উত্তম-সুচিত্রার প্রেম-বিরহের ছবি দেখে চোখ ভিজিয়ে কারমাইকেল হোস্টেলে ফিরছিলেন। “আমি তার ছলনায় ভুলবো না” বলে বান্ধবীরা কফি হাউজ থেকে ফিরে গেলে; উত্তমের মতো বসে ধোয়ার রিং বানিয়ে ছাড়তেন। এরফলে আকাশবাণীতে ‘হয়তো কিছুই নাহি পাবো, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাবো’ শুনে তারা বড় হলেন।
তারপর ক্যাসেট প্লেয়ার এলে আমাকে চেপে ধরে ‘সন্ধ্যাকে ভালোবাসতে বললেন’। অথচ আমি তখন কুমার বিশ্বজিতের ‘যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার শুনছি। সোলসের মন শুধু মন ছুয়েছে শুনে পাড়া মাথায় তুলছি। সঙ্গে বিটলস এসে হানা দিয়েছে দুপুরের জানালায়, উই আর লিভিং ইন আ ইয়েলো সাবমেরিন। আব্বা একদিন ইনস্টুমেন্টাল চাইকোভস্কি শুনে জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধে যাচ্ছো নাকি! এসময় আমার ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া নাসিম মামা, লম্বা চুলে নেচে নেচে ফেরদৌস ওয়াহিদের গান গাইতেন, আর আমাকে বলতেন দুটো ডেকচি উপুড় করে রেখে কাঠি দিয়ে বাজাও; দেখবে ব্যান্ড মিউজিক হয়ে যাবে।আব্বা একদিন বসলেন, সংগীত কী তা বোঝাতে। শুরু করলেন নিটশে দিয়ে, সংগীত ছাড়া জীবন একটি ভ্রান্তি। কিন্তু এই সংগীত সুরপ্রধান হতে হবে। ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখে তারপর ব্যান্ডের গান গাইলে সেটা শুনতে ভালো লাগলে; নইলে শুধু ঝন ঝন আওয়াজ আর বেসুরো চিৎকার মনে হবে।
হেমন্ত, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, জগন্ময় মিত্র, কলিম শরাফি, মাহমুদুন্নবী, সন্ধ্যা, আশা, লতা, ফেরদৌসি রহমান, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন নিয়ে আম্মা তার ক্যাসেট কালেকশানের হেজিমনি উপস্থিত করলেন। আমি তখন ম্যাক ভাইয়ার ‘মৌসুমী কারে ভালোবাসো তুমি’, ‘ডাক পিয়নের অসুখ হয়েছে, শেখ ইশতিয়াকের নীলাঞ্জনা ঐ নীল নীল চোখে চেয়ে দেখোনা, আর বেতোফেন-মোতসার্ট-অক্সিজেন মিউজিক; এমনকী বাপ্পী লাহিড়ির চটুল গান দিয়ে আমার কাউটার হেজিমনি গড়ে তুলেছি। আব্বা আমার রুমে আসা বন্ধ করে দিলেন, বললেন, এখানে গানস এন্ড রোজেস, এসিডিসি হেভিমেটালের মাতমে উনার মাথা ঘুরে। আম্মা অনেকটাই সহ্য করে নিলেন। কৌশলে উনার পছন্দের রবীন্দ্র সংগীত-নজরুল সংগীত বাজিয়ে শোনাতেন। আব্বা ভিডিও ক্যাসেটে উত্তম-সুচিত্রা-সুপ্রিয়ার মুভি এনে আমাকে জোর করে দেখাতেন। আর গানের সময় বলতেন, দেখ কী সুন্দর সুর এসব গানের।
কিছুদিন ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখে রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় ‘ওয়ানটন’ বা ‘উচ্ছৃংখল’ নামে ব্যান্ড খুললাম আমরা। ড্রইং রুম ভরে গেলো কী বোর্ড-ড্রাম-গীটারে; বন্ধুরা এলে শুরু হতো অনুশীলন। আমার দু একটি বন্ধু আগবাড়িয়ে কানে দুল, গলায় মালা, হাতে ট্যাটু করে ফেললো। আম্মা একদিন বললেন, বন্ধ করো এসব বেসুরো ব্যান্ড।সকালে উঠে বাজিয়ে দিলেন, কী মিষ্টি, দেখো মিষ্টি, কী মিষ্টি এ সকাল। আমার এ গান শুনে তেতো লাগলো সকালটাকে। ব্যান্ড ব্যান হয়ে যাবার শোকে আব্বা-আম্মার পছন্দের গান আমার শত্রু হয়ে গেলো।
পরে সিভিল সার্ভিসে ঢুকে বাংলাদেশ বেতারে সংগীত বিভাগে দায়িত্ব পাবার পর, অডিশনে সুজেয় শ্যাম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অজিত রায়, নীলুফার ইয়াসমীনের সঙ্গে অন্যতম জুরি হিসেবে বসতে হলো পদাধিকার বলে, জুরি বোর্ডের সদস্য সচিব যেটাকে বলে। এ সময় কাজে লেগে গেলো নানা-দাদা-আম্মা-আব্বার সঙ্গীতের কান। সুর-তাল-লয় ঠিক আছে কীনা; জিজ্ঞেস করতেন শ্যাম দা, নীলুফার আন্টি। অজিতদা বলতেন, তুমি বলো একে নেয়া যাবে কীনা। বন্যা আপা মিট মিট করে হাসতেন। কারণ আমার একটা প্যারালাল অডিশন চলছিলো যেন।
তবে ওয়ার্ল্ড মিউজিকে আমার কৈশোরের পছন্দ ইংরেজি গান, ব্যান্ডের গান বাজিয়ে বিমল আনন্দ পেতাম। কিন্তু শ্যামদা-অজিতদা স্টুডিওতে গান কম্পোজ করার সময় আমাকে বসিয়ে রাখতেন; বলতেন, ওপিনিয়ন দিবা কিন্তু। এইভাবে সুরের প্রেমে পড়ে গেলাম। বাংলা গানের বেলা তখন প্রায় পড়ে এলো। সুজেয় শ্যামদা বলতেন, গান শেখা নয়; শুধু সিডি বের করার তাল যাদের, তাদের দিয়ে কী গান হয় নাকি! আমি শুভ্র দেবের ভক্ত ছিলাম। শ্যামদা বলতেন, ওয়ার্ল্ড মিউজিকে তোমার শুভ্রদার গান বাজাও; আমাদের সংগীত অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যের কাছে থাকো। সুবীর নন্দী, রফিকুল আলম, ফেরদৌস আরা, ফাতেমা তুজ জোহরাকে আমন্ত্রণ জানাও। অনেকেই ভাবেন, টিভির যুগে রেডিওতে কী তারকা যায়, এন্ড্রু কিশোর বললেন, রেডিও হচ্ছে গানের মন্দির। মিউজিক ডিপার্টমেন্টের দুলাল ভাই, আর শামীম আপা মোস্ট ওয়েল কানেক্টেড মিডিয়া ম্যানেজার। আমি যে কোন সংগীত অনুষ্ঠান আয়োজন করলে উনারা বলতেন, কাকে আনতে হবে বলো! আর সুজেয় শ্যাম ছিলেন প্রধান সংগীত পরিচালক। উনাদের সঙ্গে সাড়ে ছয় বছর কাটিয়ে সুরের ভেতরটা সামান্য বুঝলাম।
লতাজি চলে গেলেন, তারপর সন্ধ্যা। এসব রাজকীয় প্রস্থানে, বাংলা গানের জগতে যে শুন্যতা নামে; তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। এইসব কিংবদন্তীর সঙ্গীত শিল্পী হারিয়ে যাবার সমান্তরালে সংগীত শোনার কানগুলো হারিয়ে যাবার বেদনা আচ্ছন্ন করে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের চলে যাবার ক্ষণে “আকাশ প্রদীপ জ্বলে, দূরের তারার পানে চেয়ে’ চিত্রকল্পটি দেখতে পাই বারান্দা থেকে দূর অন্তরীক্ষে তাকিয়ে।