বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদের আড্ডায় রাইসুর সঙ্গে প্রথম দেখা। ওর বোহেমিয়ান ও আভাগার্দ জীবন যাপন দেখে খুব ভালো লেগেছিলো। আমি নিজে কেয়ারফুলি কেয়ারলেস ছিলাম, কিন্তু রাইসু ছিলো কেয়ারলেস; আর ছিলো আদিত্য। এরা খালি পায়ে হাঁটতো শহরজুড়ে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ ছিলো মজার স্কুল। সেখানে তসলিমা নাসরিন বসে তার কবিতার ছন্দ নিয়ে আড্ডা দিতেন সমসাময়িকদের সঙ্গে। রিটন ভাই মাঝে মাঝে এসে সবগুলো আড্ডার টেবিলে নির্মল আনন্দ সঞ্চার করতেন। আর আমাদের শিল্প-সাহিত্যের গুরু ছিলেন, সাজ্জাদ শরিফ। উনার সাহিত্য আলোচনা গোগ্রাসে গিলতাম আমরা। সাজ্জাদ ভাই তখন লিটল ম্যাগাজিন করেন। ভালো কবিতা লেখেন। রাইসুও সেসময় নতুন ধরণের কবিতা লিখতো।
রাইসু তখন থেকে “রবীন্দ্রনাথ কিছুই জানেনা” বলে আমাদের চটিয়ে দিতো। কিন্তু ভূমি বাস্তবতার সে আড্ডাগুলো ছিলো সহিষ্ণু। যেহেতু রাইসু কোন স্ল্যাং ব্যবহার না করে বড় বড় ধ্রুপদী কবি-লেখককে বাতিল করে দিতো; আমাদের রাইসুকে ধুয়ে দেবার প্রবণতাগুলোও ছিলো স্ল্যাং হীন।সাজ্জাদ ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাইসু এমন করে কেন! সাজ্জাদ ভাই বলেছিলেন, সাহিত্যের ইতিহাস খুঁজে দেখো প্যারিসে একদল সাহিত্য সমালোচক পাবে, যারা নিজেরা তেমন কিছু লিখতো না; কিন্তু ধ্রুপদী লেখককের নাকচ করে দিতো।রাইসুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিলো না; তবে সখ্য ছিলো।
পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকমে কাজ করতে গিয়ে দেখি, রাইসু সবাইকে এমনভাবে চটিয়ে রেখেছে যে, কেউ তাকে কোন সহযোগিতা করে না। পারলে অসহযোগিতা করে। রাইসু আর্টস পেজ বানাচ্ছে; কিন্তু সার্বিক অসহযোগিতায় সেটা এগোচ্ছে না। আমার পুরোনো সখা সে, তাই আমি ওর সঙ্গে প্রতিদিন আড্ডা দিতে শুরু করলাম।আমি একটু ঘন সর দেয়া চা এনে খেতাম মাঝে মাঝে, রাইসু সেটা খেতে খেতে বলতো, অই তুই এইরকম ক্ষিরের মতো চা খাস ক্যান! রঙ চা খাইতে পারস না! এরকম গল্পে গল্পে রাইসুর কাজ এগিয়ে চললো। কী যে অসাধ্য সাধন করলো সে। একা হাতে সাজালো নান্দনিক সেই আর্টস পেইজ। সবাই ভাবতো এই পেজ কোনদিন হবে না। কিন্তু আমার আশা ছিলো রাইসুকে নিয়ে। আমি ওকে লিটল ম্যাগাজিন করতে দেখেছি, স্কেচ করতে দেখেছি নোটবুকে। কবিতা লিখতে দেখেছি।
নিউজরুমে প্রিয় অনেক অনুজ আমার এই আইসক্রিম সেলার হ্যাবিট অপছন্দ করতো । ওদের অনুযোগ, রাইসুর লগে এতো ফ্রেন্ডশিপ কেন আপনার! আপনারা তো ভিন্ন ধরণের মানুষ!
রাইসু ফেসবুকেও কিছুদিন বন্ধু ছিলো। তারপর সেলিব্রেটি পেইজ করায়; আমাদের আর যোগাযোগ নেই। আমি কখনোই সেলিব্রেটিদের ট্র্যাক রাখতে পারিনা। কিন্তু ওর নানারকম চটিয়ে দেয়া পোস্টে লোকের গালাগাল দেখি। এতো হবেই; সেই সোনালী ঢাকা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, চারুকলার নির্মল আড্ডা, নিউমার্কেটের বইয়ের দোকান, আজিজ মার্কেটের বইয়ের আড্ডা, টিএসসির সবুজ ঘাসে শুয়ে, আকাশে কালিদাসের লগে ম্যাঘ দেকতেছি”-র আকাংক্ষার শহর তো আর নেই।এ হচ্ছে গালাগালির শহর। আগে ঢাকায় থিংকট্যাংক ছিলো চিন্তার উদ্ভাস নিয়ে; এখন আছে মাউথ ট্যাংক। আমি সাজ্জাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, থিংকট্যাংক-এর বাংলা কী চিন্তাকামান বলবো! উনি হেসে বলেছিলেন, বলো, জিনিসটা সার্কাস্টিকও হয় বেশ।
আজকের ফেসবুকের স্ল্যাং-এর ডিসকোর্স দেখে এদের মুখ কামান ডাকতে ইচ্ছা করে।লতাজির গান আমাদের ভালো লাগলেই যে রাইসুরও ভালো লাগতে হবে, এমন কোন কথা নেই। রুমী আমাদের মুগ্ধ করে বলে রাইসুকেও মুগ্ধ হতে হবে; এমন কোন কথা নেই। রাইসু ভিন্নমতপোষণ করে বলেই তাকে গালি দিতে হবে; এ কোন সভ্যতা আমাদের!